Ameen Qudir
Published:2019-02-10 20:12:23 BdST
মানসিক সমস্যামেয়েটার কাহিনী নেহায়েত মর্মান্তিক
ফাইল ছবি
ডা. সাঈদ এনাম
___________________________
এক.
মেয়েটার কাহিনী নেহায়েত মর্মান্তিক।
'উপরি বাতাস তাড়ানোর নাম করে মেয়েটির দুই আংগুলে নাইলনের দড়ি দিয়ে বেঁধে সুই ফুটিয়ে রক্ত বের করেছে আর বেধড়ক পিটিয়েছে ভন্ড বাবা। মারের চোটে উপরি তখন পালানোর পথ খুঁজে। আর তখনই সুই দিয়ে আংগুলের আগায় কয়েকটা ফুটো করে দিতে। ব্যস খেল খতম। ফোটা ফোটা রক্তের সাথে উপরি বাতাস চলে যায়। বাবা আরো বলেছে, আরো বলেছে মায়ের উপরি চলে গেলে বাচ্চাকেও তার কাছে নিয়ে যেতে হবে। বাচ্চার ও একই ভাবে উপরি তাড়াতে হবে...', কথা গুলো বলছিলেন রহিমার সাথে আসা তার এক আত্মীয়া।
আমি বললাম, "দেখি কোন আংগুলের ডগা দিয়ে উপরি বাতাস বা ভুত রক্তের সাথে বের হয়ে গেলো'?
রহিমার হাত দুটো টেবিলের উপর রেখে আংগুল গুলো মেলে ধরলেন আমার সামনে। রহিমার খালা।
দেখেই আৎকে উঠলাম। তিন তিনটা আংগুল এ ইনফেকশন দেখা দিয়ে সেলুলাইটিস ডেভেলপ করেছে। সুই ফূটানো আগা গুলোতে এখনও লেগে আছে কালচে রক্ত।
বললাম, 'আপনাদের এসবে বিশ্বাস হয়..?'
'কি করবো বলুন? সবাই বললো বাবার অসীম আধ্যাত্মিক ক্ষমতা। তাই বাবার বাড়িতে নিয়ে গেলাম রহিমাকে । গিয়ে দেখি অবাক কান্ড, কেবল যে আমরা তা না। আরো বেশ ক'জন মহিলা নিয়ে হাজির বাবার আসনের সামনে। সবারই একই সমস্যা। অনেকে নাকি সুস্থ হচ্ছে। তাই কেই হাস মুরগী, গরু, ছাগল সাথে বাবার তাবিজের জন্যে কাকের ঠ্যাং, শিয়ালের লেজ, বেজির কান আরো কত কি নিয়ে এসেছে সাথে। এগুলো সবই লাগে উপরি তাড়াতে...' বললেন রহিমার সাথে আসা তার আত্মীয়া।
'তো, রহিমার উপরি কি গেলো', জিগ্যেস করলাম।
'না স্যার। যাওয়াতো দুরের কথা আজ আরো বেড়েছে। সকালে এই দুধের শিশুকে ফেলে দিয়েছে হাটু জল ডোবায় । শিশুকে মেরে ফেললে নাকি শিশুটির ভালো হবে, তাকে কানে কানে প্রেতাত্মারা একথা বলেছে। ভাগ্যিস সে মুহুর্তে পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন পাড়ার মুরুব্বী। ঝাপ দিয়ে তিনি শিশুকে তুলে আনেন। পরে তিনিই আমাদের সবাই কে ধমকালেন। বললেন, ব্রেইনের ডাক্তারের কাছে যাও। রহিমার ব্রেইনের সমস্যা হয়েছে। মুরুব্বী চাচা নাকি আগেও এমন এক রুগী দেখেছেন যে কিনা পরে ব্রেইনের ডাক্তারের চিকিৎসায় পুরো সেরেছে...' রহিমার খালা বিস্তারিত বললেন।
দুই.
রহিমার ক'দিন হলো এক পুত্র সন্তান হয়েছে। দেখতে যেনো চাঁদের টুকরো। প্রসবের এক সপ্তাহ পর থেকেই ওর ঘুম কমতে লাগলো। আনমনা হয়ে বসে থাকতো। বাচ্চার কোন খেয়াল খবর নাই। সাথে একা একা কথা বলা, হাসা, কাঁদা। মাঝেমধ্যে এ বাচ্চাটা কার বলে ফ্যাল ফ্যাল করে সবার দিকে তাকিয়ে থাক্র। আবার বলে এ বাচ্চা নাকি দুস্ট বাচ্চা। একে মেরে ফেলতে হবে। দুদিন আগে নবজাতকের গলা চেপে ধরেছিলো। আবার আজ ডোবায় ফেলে দিয়েছে।
তারা এ সমস্যা কে উপরি আলগা বাতাস প্রেতের আসর ইত্যাদি ভেবে আর চিকিৎসক দেখান নি। কবিরাজ, ঝাড়ফুঁক আর ভন্ড বাবাদের দোয়ারে দোয়ারে এক সপ্তাহ যাবৎ ঘুরছেন।
এমনই এক ভন্ড বাবা তাকে ভুত তাড়ানোর নামে বেঁধে আচ্ছা পিটিয়ে আধমরা করে পাঠিয়েছে।
রহিমার আসলে উপরি বাতাস, আলগা বাতাস, ভুতে ধরা, বান মারা, জাদু টুনা এসব কিছুই রহিমার হয়নি। ওর যে রোগ তার নাম হলো "পোস্ট পারটাম সাইকোসিস"। বাংলায় বলা যায়, 'প্রসুতি মায়েদের মানসিক রোগ। প্রতি ৫০০ জন প্রসুতি মায়ের মধ্যে একজনের এ ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। সাধারণত শিশু জন্মের এক থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে হরমোনের তারতম্যের জন্যে এমন হয়। এছাড়াও প্রসুতি মায়েদের অন্যান্য মানসিক রোগ যেমন ডিপ্রেশন, এংজাইটি এসব খুবই মামুল ঘটনা। পরিবারের রক্ত সম্পর্কিত কোন আত্মীয়ের কোন মানসিক সমস্যা থাকলে এ রোগ হবার ঝুঁকি একটু বেশি থাকে, তাই তাদের প্রতি যত্নবান থাকতে হবে।
সাইকিয়াট্রিক কনসালটেশন আর পরিমিত মাত্রার এন্টি সাইকোটিক ঔষধ সেবনে মাত্র ক'দিনের চিকিৎসায় এ রোগ সেরে যায়। আর তা না হলে অজ্ঞতা, কুসংস্কার, অপচিকিৎসা আর অসচেতনতায়, সামান্য ভুলের কারনে মা কিংবা নবজাতক, যে কারো জীবন সংকটময় হয়ে উঠতে পারে।
বের হয়ে যাবার সময় তার সাথে আদা সহজ সরল স্বামী কে বললাম,
'ভন্ড বাবা বলেছে বাচ্চার ও ভুত তাড়াতে হবে, তাইনা? আমাকে বলো। মারধর এর একটা ব্যাপার স্যাপার আছেনা? আগে ভন্ড বাবার ঘাড় থেকে ভুতটা নামাতে হবে...'।
ডা. সাঈদ এনাম
সাইকিয়াট্রিস্ট
মেম্বার, ইউরোপিয়ান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন
মেম্বার, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন
আপনার মতামত দিন: