Ameen Qudir

Published:
2020-01-04 22:49:06 BdST

লোনাভালার চিক্কি, নাটোরের কাঁচাগোল্লা আর মুক্তাগাছার মন্ডা :সততাই সর্বোত্তম পন্থা


 

ডা সুরেশ তুলসান
প্রখ্যাত চিকিৎসক ও সুসাহিত্যিক

__________________


ফিল্মসিটি খ্যাত বোম্বে বা মুম্বাই থেকে উঁচুনিচু আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ বেয়ে যখন ছোট্ট পাহাড়ি জনপদ লোনাভালা পৌছালাম তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা লাগা লাগা ভাব।
ছোট্ট শান্ত নিরিবিলি হিল স্টেশন লোনাভালা।
শহর বলতে প্রধান সড়কের দুধারে বেশকিছু দোকানপাট আর লজ।
দোকানের মধ্যে খাবারের দোকানই বেশি।
আগে থেকে হোটেলের কোন বুকিং না থাকায় স্থানীয় মানুষজনের মুখে খবর নিয়ে যে হোটেলটিতে উঠলাম সৌভাগ্যক্রমে সেটি ছিলো আমাদের প্রত্যাশার চাইতেও অনেক ভালো " Hotel The Otel "।
হোটেলটির কনস্ট্রাকশন এখনও সম্পুর্ণ হয়নি।
ঝাঁ চকচকে হোটেল ভবন পরিস্কার পরিচ্ছন্ন প্রায় নতুন বিছানাপত্তর।
চেক ইন সেরে নিচে নেমে রিসেপশনে জানতে চাইলাম আজ সন্ধ্যায় ঘোরাঘুরি মত কি আছে। ওরা জানালো এই রাতে আর কি ঘুরবেন, সবকিছুই তো বন্ধ হয়ে গেছে।
তবে লোনাভালায় যখন এসেছেন চিক্কি অবশ্যই কিনে নিয়ে যাবেন।
এখানকার চিক্কি খুব ফেমাস। টুরিস্টরা আর কিছু কিনুক আরা না কিনুক চিক্কি অবশ্যই কিনবে।
অবশেষে আমরা তিনজন বের হলাম সেই বিখ্যাত চিক্কি খোজে।
পাহাড়ের সন্ধ্যায় হালকা একটা শীতের আমেজ।
পুরো লোনাভালা শহরের সেন্টার পয়েন্ট মহাবীর স্বামী চকে সারি সারি অসংখ্য হাইফাই ডেকোরেটেড চিক্কির দোকান।
দোকান বললে ভুল বলা হবে, বল উচিত চিক্কির শোরুম। বিভিন্ন নামে বিভিন্ন ব্রান্ডে শোরুমগুলো।
একই নামের অনেকগুলো শোরুম।
বুঝলাম সামান্য চিক্কির ব্যবসাতেও চেইনশপ সিস্টেম।
তবে সবচাইতে বেশী হলো "MAGAN LAL CHIKKI"।
এদের শোরুমের সংখ্যা ৭০ এর উপরে, প্রায় ৮০ এর কাছাকাছি।
চারপাশে অসংখ্য এই সব চিক্কির শোরুমের ভিড়ে হঠাৎই হারিয়ে গেলাম ৪৫ বছর পুর্বের শৈশবে।
কোন এক সন্ধ্যায় নাটোরের রেলস্টেশনে লোকাল ট্রেনের ভিতরে জানালার ধারে বসে আছি।
প্লাটফর্মে হকারদের হাঁক-ডাক "নাটোরের কাঁচাগোল্লা, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, নাটোরের কাঁচাগোল্লা ----------"।


মানুষজন সমানে কিনছে।
দাম জিজ্ঞাসা করা বা দরদাম করা বা কাঁচাগোল্লার মান নিয়ে কোন প্রশ্ন তো বা যাচাই-বাছাই কোন কিছুর কোন বালাই নেই। যার যতটুকু প্র‍য়োজন কিনে নিচ্ছে।
একেবারেই নিয়মিত কিছু যাত্রী ছাড়া প্রায় সকলেই সাধ্যমতো বা প্রয়োজন মত কিছু না কিছু কাঁচাগোল্লা কিনে নিচ্ছে বাড়িতে বা আত্নীয় বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
কেউ কেউ আবার কলাপাতায় মোড়া অল্পকরে কেনা কাঁচাগোল্লা ট্রেনে বসেই খাওয়া শুরু করেছেন।
কেই এমনি এমনি কেউ বা রাজশাহীর পাউরুটি দিয়ে।
তখনকার দিনে এই অঞ্চলে রাজশাহীর পাউরুটির খুব সুনাম ছিলো।
শেষমেশ মগনলাল চিক্কির একটা বড়সড় শোরুমে ঢুকে পড়লাম চিক্কি আসলে জিনিসটা কি সেটা দেখার জন্য।
দোকানদার চিক্কি বলতে যে জিনিসটা বা জিনিসগুলো দেখালেন তা দেখে আমি রিতীমত শকড বা হতাশ।
এতো আমাদের চিনা বাদাম আর চিনি বা গুড়ের তৈরী বাদাম কটকটি বা পাটালীর আধুনিক সংস্করণ।
প্রথমত চিনি জ্বাল দিয়ে ঘন করা হয় তারপর একটা নির্দিষ্ট তাকে পৌছালে এর সাথে ভাজা বাদাম মিশিয়ে থালায় ঢেলে দিলে এটা জমে শক্ত হয়ে যায়।
জমে শক্ত হওয়ার আগে অবশ্য বরফির মত করে কেটে ভিভিন্ন আকার আর সাইজের টুকরো করা হয়।
এটা তৈরির আসল কেরামতি অবশ্য ঐ চিনি জ্বাল দেওয়ার নির্দিষ্ট তাকেই মধ্যেই নিহিতঃ।
আমরা ছোটবেলায় কত খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই।
চিনি অথবা গুড়ের সাথে চিনাবাদাম, বা ছোলার ডাল ভাজা অথবা নারিকেল কুচি দিয়ে বানানো। আমাদের দেশে যেগুলো পাওয়া যায় সেগুলো গোলাকার আর এবরো-থেবরো ( অমসৃণ) আর এগুলো মসৃণ আর সুন্দর করে কেটে প্যাকেট করা।
দোকানদার একে একে দেখাতে লাগলো নানা রকমের নানা দামের চিক্কিগুলো, চিনা বাদাম, কাজু বাদাম, কাঠবাদাম ( Almond), আখরোট, ডালাভাজা, চালভাজা এমন কোন জিনিস নাই যা দিয়ে এরা চিক্কি বানাতে বাদ রেখেছে।
আমার মাথা ঢুকছে না সামান্য এই চিক্কি নিয়ে এত আগডুম বাগডুম এত আড়ম্বর এত্তো বড় ব্যাবসা কি করে সম্ভব।
জানতে চেষ্টা করলাম চিক্কির ইতিহাস।
ভেওরাজজী আগরওয়ালা নামে একজন প্রথমে এই চিক্কি বানানো শুরু করেন।
প্রথমত ভেজে খোসাছাড়ানো চিনাবাদাম আর গুড় বা চিনি দিয়ে চিক্কি নামের এই বাদাম কটকটির তৈরি করা হতো।তারপর যোগ হয়েছে অন্যান্য উপকরনের চিক্কি।
চিক্কির ব্যাবসার সাথে নাটোরের কাঁচাগোল্লার এক অদ্ভুত মিল খুজে পেলাম।
ভেওরাজজী প্রথম চিক্কি বিক্রি শুরু করেন লোনাভালা রেলস্টেশনে শালপাতায় মুড়ে। ঠিক যেভাবে নাটোরের কাঁচাগোল্লা বিক্রি হতো নাটোর রেলস্টেশনে কলাপাতায় মুড়ে।
লোনাভালা রেলস্টেশনে যখন মুম্বাই টু পুনে ট্রেনের যাত্রীদের কাছে চিক্কি বিক্রি হতো তখন নাটোরের কাঁচাগোল্লা কেনার মত করেই চিক্কি কেনার জন্য যাত্রীরা হুমড়ি খেয়ে পড়তো।
অনেকে তো শুধু চিক্কি কিনতে নেমেই ট্রেন মিস করে ফেলতো। পরে রেল কর্তৃপক্ষের লিখিত অনুরোধে ওরা নির্দিষ্ট মাপের প্যাকেট আকারে চিক্কি বিক্রি শুরু করে।
চিক্কি নামটাও এসেছে কাস্টমারদের কথা ভেবেই।
এর আসল নাম গুরধানি।
এটি প্রকৃতপক্ষে একটি রাজস্থানী খাবার। মানুষ যেন সহজেই উচ্চারণ করতে পারে সেই জন্য এর নাম পরে চিক্কি রাখা হয়।
চিক্কির ব্যাবসা আমাদের নাটোরের কাচাগোল্লার চাইতে পুরাতন হলেও ব্যাবসাটি কিভাবে এত বছর ধরে দাপটের সাথে টিকে আছে এবং শুধু টিকে আছে বললে ভুল হবে দিন দিন আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং লোনাভালার গন্ডি পার করে সারা ভারত এমনকি সীমিত পরিসরে হলেও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে একটা যায়গা করে নিয়েছে।
মগনলাল চিক্কি দিয়ে শুরু হলেও পরে আস্তে আস্তে আরও অনেকেই অনেক নামে এই চিক্কির ব্যাবসা শুরু করে।
চিক্কির এই টিকে থাকা এবং বিস্তারের কারণ হিসাবে আমার যে বিষটা মনে এসেছে সেটা হলো এরা কখনোই মানের সাথে আপোষ করে নাই।
অনেকেরই চিক্কি ব্যাবসার সাথে যুক্ত হলেও এদের মধ্যে দাম কমানোর চাইতে মান বাড়ানোর বিষয়ে প্রতি্যোগীতা ছিলো। তাই দিনে দিনে উত্তোরত্তর চিক্কির মধ্যে এই বৈচিত্র্য।
অথচ এতো সুনাম আর এতো প্রতিপত্তি থাকা স্বত্বেও আমাদের নাটোরের কাচাগোল্লা একসময় মুখথুবড়ে পড়লো।
নাটোরের কাঁচাগোল্লার এই মুখথুবড়ে পড়ে যাওয়ার কারণ কিন্তু একটাই, এবং সেটা হলো কাঁচাগোল্লা বিক্রেতাদের মধ্যে মান বজায় রাখার চাইতে দাম কমানোর প্রতিযোগিতা আর মানুষের সাথে প্রতারণা। অনেকেরই সরল বিশ্বাসে কাঁচাগোল্লা কিনে বাড়িতে যেয়ে দেখেন ময়দাগোল্লা। এভাবেই মানুষ একসময় নাটোরের কাঁচাগোল্লা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। মাত্র গুটিকয়েক অতি মুনাফালোভী মানুষের শঠতা আর অসততার কাছে হার মানলো আমাদের নাটোরের কাঁচাগোল্লা।
এখন নাটোরে দুই একটি মাত্র দোকানে মানসম্মত কাঁচাগোল্লা বিক্রি হয়। এবং নাটোরের বাইরের কেউ এখন স্থানীয় মানুষজনের কাছে সঠিক দোকানের খোঁজ খবর না নিয়ে আর কাঁচাগোল্লা কেনেন না। সরল বিশ্বাসে কেনার দিন শেষ। তা না হলে নাটোরের কাঁচাগোল্লাকে কেন্দ্র করেও গড়ে উঠতে পারতো লোনাভালার চিক্কির মত এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। কর্মসংস্থান হতে পারতো অনেক মানুষের।
একই অবস্থা এখন মুক্তাগাছার মন্ডা এবং আরও অনেক আঞ্চলিক খাদ্য পন্যের।

ডা সুরেশ তুলসান।
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ।

আপনার মতামত দিন:


ভ্রমণ এর জনপ্রিয়