তৈমুর চৌধুরী

Published:
2016-11-08 07:07:37 BdST

কি টানে, ভুটানে!


পারো এয়ারপোর্টে লান্ডিং এর আগে প্লেন যখন নিচু হয়ে দুই পাহাড়ের মধ্য দিয়ে আকাবাকা হয়ে উড়ছিল, যাত্রীদের সবাই তখন চমকিত, কেউ কেউ আতংকিত! ল্যান্ডিং এবং ফ্লাইঙের জন্য পৃথিবীর অন্যতম কঠিন এয়ারপোর্ট এটি। সাত হাজার ফুট উচু ভ্যালি। সেই ভ্যালীতে রানওয়ের দুইপাশে আরো চার-পাচ হাজার ফুট উচু পর্বতের সারি। তারমধ্য দিয়েই ল্যান্ডিং এর আগে অনেক নিচুতে নেমে আকাবাকা হয়ে উড়তে হয় প্লেনকে। বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাইলট ছাড়া অন্যদের এই এয়ারপোর্টে ল্যান্ডিং এবং ফ্লাইঙের অনুমতি নেই। ভ্যালিটি দৈর্ঘ্যে কম বলে, রানওয়েটিও লম্বায় ছোট। বড় প্লেন এখানে আসে না, সর্বোচ্চ এয়ারবাস। শুধুমাত্র দিনের আলোতেই এখানে প্লেন উঠে, নামে।

 

 

 

আমরা এসেছি সুখী মানুষের দেশে। বলা হয়ে থাকে ভুটানের মানুষেরা পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। পৃথিবীর সব দেশ তাদের উন্নতি হিসাব করে জিডিপি (gross domestic product)দিয়ে। অর্থাৎ তাদের বাৎসরিক আভ্যন্তরীণ উৎপাদন দিয়ে। অর্থনীতিতে এটাই স্বীকৃত পদ্ধতি। একমাত্র ভুটান তাদের সমৃদ্ধি পরিমাপ করে জিএনপি (Gross National Happiness) দিয়ে। অর্থাৎ দেশের মানুষ কতটা সুখে আছে তা দিয়ে। ভুটানের চতুর্থ রাজা জিগমে সিগহি ওয়াংচু ১৯৭২ সালে প্রচলন করেন এই জিএনপি, সুখ পরিমাপের মাপকাঠি। ভোগ নয়, মানিসিক প্রশান্তিই হলো সমৃদ্ধির চাবিকাঠি – এই বিশ্বাস থেকেই নির্ধারিত হয় ভুটানের রাষ্ট্রীয় নীতি। আন্তর্জাতিক ভাবে এখন স্বীকৃত এখন এই জিএনপি। মনের গভীরে গোপন ইচ্ছা, ভুটান ঘুরতে ঘুরতে সুখের সেই চাবিকাঠিটি যদি খুজে পেয়ে যাই! ভুটান সম্পর্কে দুর্বলতার আরেকটি বড় কারন হলো স্বাধীন বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল এই ভুটান।

ছোট্ট ছিমছাম এয়ারপোর্ট, অনেকটা আমাদের কক্সবাজারের এয়ারপোর্টের মত। রানওয়ে থেকে হেটেই চলে গেলাম ইমিগ্রেশনে। আমরা বাইশ জনের গ্রুপ। ভূটান ভ্রমনে আগে থেকে ভিসা নিতে হয় না। পোর্ট এন্ট্রি ভিসা। এয়ারপোর্টে তার জন্য আলাদা কোন ডেস্কেও যেতে হয় না। ইমিগ্রেশন অফিসারই ভিসার সীল দিয়ে দেন। কাস্টমস চেকিং নিয়ে তেমন কড়াকড়ি নেই। এমনকি আমাদের লাগেজ গুলোও স্ক্যানারে দেয়া হলো না। কাস্টমস চেকিং নিয়ে একটু দুশ্চিন্তায় ছিলাম। ভুটান পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে আইন করে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এদেশে কোথাও সিগেরেট বিক্রি হয় না। সিগেরেট নিয়ে এদেশে ঢুকাও যায় না। ট্যুরিস্টরা চাইলে অল্প কিছু প্যাকেট সাথে নিতে পারে। তার জন্য কাস্টমসে ডিক্লারেশন দিয়ে দুইশত পারসেন্ট ট্যাক্স দিতে হয়। আমাদের গ্রুপের বেশ কয়েকজন স্মোকার। সবাই লুকিয়ে কিছু প্যাকেট নিয়ে এসেছি। ধরা না পড়াতে সবাই বেশ উৎফুল্ল! চুরি করে, ধরা না পড়ার সুখ দিয়েই আমাদের ভুটান সফর শুরু!

চমৎকার ঝকঝকে রোদ। বাতাসে শীতের ছোয়া। অক্টোবরের শুরু - সাধারনত এই সময়টায় এখানে বৃষ্টি শেষ হয়ে আসে, শীতও পুরোপুরি শুরু হয় না। ভুটান বেড়ানোর জন্য ভাল সময়। আরেকটা পিক সিজন হলো – মার্চ, এপ্রিল, মে, যখন এখানে বসন্ত। যদিও এই সময়টায় বৃষ্টি শেষ হয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু ওয়েদার ফোরকাস্টে দেখেছি, যে কয়দিন আমরা ভুটানে থাকব, সে কয়দিনই বৃষ্টিপাতের সম্ভবনা ৬০-৭০ ভাগ! এটা নিয়ে মনের মধ্যে একটু অস্বস্তি ছিল। ঝলমলে রোদ দেখে সেই শঙ্কা কেটে মনটা আনন্দে নেচে উঠল।

 

 

 

প্লেনে আমাদের সগর সঙ্গী ছিল বাইশ জনের আরেকটি গ্রুপ। সবাই পঞ্চাশ থেকে ষাট বৎসর বয়সী ভদ্রমহিলা। গুলশান পার্কে একসঙ্গে হাটেন। হাটতে হাটতে হৃদতা। বছরে দুএকবার দলবেঁধে ঘুরতে যান। সংগে কোন পুরুষ সঙ্গী বা বাচ্চা-কাচ্চা নেই, শুধু নিজেরা নিজেরাই। সুখের সন্ধানে এবার ভুটান এসেছেন। এই বয়সী এতজন ভদ্রমহিলাকে দলবেঁধে বেড়াতে দেখে ভাল লাগে, একটু অবাকও লাগে। আমাদের দেশের নারীরা কি সত্যিই এতটা স্বাবলম্বী, এতটা মুক্ত হতে পেরেছেন! অবশ্য এরা সবাই সমাজের একটা বিশেষ শ্রেণীর। এদের মধ্যে আছেন, দেশের শীর্ষ ব্যাবসায়ী, শীর্ষ রাজনীতিবিদ, অবসরপ্রাপ্ত আমলা বা উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের স্ত্রীগন। সমাজের একেবারে উচুতলার মানুষ। প্লেনে আমাদের কয়েকজনের সাথে উনাদের আলাপ পরিচয় হয়েছে। এয়ারপোর্ট থেকে বেড়িয়ে উনাদেরকে বিদায় জানাই। উনারা পারোতেই থেকে যাবেন। আমরা চলে যাবো থিম্পু।

আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে একটা টুরিস্ট বাস। পারো থেকে চলে যাবো থিম্পু, ৫০ কিলোমিটার পথ। সেখানে দুইরাত। থিম্পু থেকে পুনাখা, একরাত। পুনাখা থেকে আবার পারো। দুইরাত থেকে, পারো ঘুরে সেখান থেকে ঢাকার প্লেন।

পাহড়ী পথ ধরে এগিয়ে চলল বাস। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে একে বেকে চলে গেছে রাস্তা। কখনো ক্রমাগত উঠে যাওয়া, কখনো বা অনেকদুর নেমে আসা।। পথের বেশীরভাগ অংশে একপাশে উচু পাহাড়, অন্যপাশে পাহাড়ের নিচু ঢাল কয়েক হাজার ফুট নিচে নেমে গেছে। কোথাও কোথাও রাস্তার একপাশে খাড়া গভীর খাদ। খাদের নিচ থেকে মাথা তুলে আছে বিরাট উচু উচু সব পাইন গাছ। চলন্ত বাস থেকে খাদের নিচের দিকে তাকালে শরীর শিউরে উঠে। যারা পাহাড়ে বেড়াতে ভালবাসেন, তারা জানেন সব পাহাড়ী এলাকাতেই পথের এই সাদৃশ্যটুকু রয়েছে।

আমরা ঢাকা থেকে রওনা হয়েছি সকাল নয়টায়। মাত্র ৪৫ মিনিট ফ্লাইং টাইম। এগারোটার আগেই পারো থেকে বাস ছেড়েছে আমাদের। ঝকঝকে রোদে চারপাশে অপুর্ব সব ল্যান্ডস্কেপ। সবাই কিছুক্ষন মুগ্ধ হয়ে দেখে, তারপর জমে উঠে গল্প, আড্ডা।
বাইশ জনের গ্রুপে আছি আমি, আমার স্ত্রী দীপু, ছোট কন্যা আনাহী। বড় কন্যা ফারিশতে আসতে পারেনি। সাধারণত কোথাও বেড়াতে গেলে আমরা চারজনই একসাথে যাই। ফারিশতের জন্য বুকের ভিতরটা কেমন জানি করছে। এই গ্রুপের বাকীদের মধ্যে তাহমীদ, কনক, তাদের দুই পুত্রকন্যা কল্প, গল্প আমাদের অতি ঘনিষ্ট, আত্মার অংশ। কল্প গল্প আমাকে ‘মাচা’ ডাকে। মামা ডাকবে না চাচা ডাকবে সেই বিভ্রান্তি দূর করে তারা নিজেরাই এটা বানিয়ে নিয়েছে। গ্রুপের অন্যদের মধ্যে রয়েছে চির আর তার স্ত্রী ববি। এই গ্রুপের দলনেতা বুলবুল। সংগে তার স্ত্রী ফারজানা আর কন্যা মৃত্তিকা। নেতৃত্বগুণ বুলবুলের সহজাত, চমৎকারভাবে সবকিছু ম্যানেজ করছে, সেইসংগে সবার দেখভাল। বুলবুলের বন্ধু সিমাব, তার স্ত্রী শিউলী, কন্যা তিনাব। শিউলীর বড় বোন সীমা এবং তার পুত্র অর্কও আমাদের সাথী। অর্ক কিছুটা অস্বস্তিতে রয়েছে, ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে ও, তার সমবয়সী এখানে কেউ নাই। আমাদের গ্রুপের বাকী বাচ্চাদের বয়স পাচ থেকে বারোর মধ্যে। গ্রুপের সবচেয়ে নীরব সদস্য মানিক। সংগে তার স্ত্রী স্বপ্না, কন্যা অর্থী, পুত্র সামির। দলের একমাত্র ব্যাচেলার জিনাত। সে বাকী জীবন একা থাকার পন করেছে।

 

 

আমি আর দীপু ছাড়া বাকী সবারই পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পারস্পরিক বন্ধুত্ব বহু বছরের। গ্রুপের মধ্যে আরেকটা বড় সাদৃশ্য রয়েছে, এখানে যে কজন আছি, তাদের অধিকাংশই প্রাক্তন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী। সেই মানসিক নৈকট্যের কারনে ঘনিষ্টতা হতে সময় লাগে না, গল্পের টপিকেরও অভাব হয় না, জমে উঠে তুমুল আড্ডা। একাডেকিম ডিসিপ্লিনে দারুন বৈচিত্র রয়েছে এই গ্রুপে। হিস্ট্রি এবং জিওগ্রাফী ব্যাকগ্রাউন্ড রয়েছে কয়েকজনের – বেড়াতে বেডাতে তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু জানা যাবে।

চিরর গল্প বলার ঢং চমৎকার। শুনতে ইচ্ছে করে। কোন একটা গল্প বলে, আড্ডার প্রসঙ্গের সাথে তার যোগসূত্র তৈরী করে দারুন মুন্সিয়ানার সাথে। রসবোধও অসাধারন। নিজেকে নিয়ে রসিকতা করতে সাহস লাগে, সেটা চিরর আছে। তাহমীদ, বুলবুল, সিমাব, কনক, শিউলি, জিনাত এরা কাছাকাছি বয়সী, দীর্ঘ দিনের বন্ধুত্ব, পারস্পরিক অনেক মজার স্মৃতি আছে তাদের, আড্ডায় উঠে আসে সেসব গল্পও। হাসি তামাশায় সময় কেটে যায়।

বাসের জানালা দিয়ে প্রকৃতির রুপ দেখতে দেখতে মানুষ খুজি। অনেকক্ষন পর পর দুইএকজন করে মানুষ চোখে পড়ে। ভুটানের জনসংখ্যা খুবই কম। মাত্র সাড়ে সাত লক্ষ। আমাদের কোন কোন উপজেলাতেই এর চেয়ে বেশি মানুষ আছে। অথচ আয়তন কিন্তু কম নয়, বাংলাদেশের তিন ভাগের এক ভাগ। পুরোটাই পাহাড়ী এলাকা। দক্ষিনে ইন্ডিয়ার প্রান্তে পাহাড়ের গড় উচ্চতা তিন থেকে চার হাজার ফুট। এর প্রায় পুরোটাই বন। উত্তরে হিমালয়ের কাছে এই উচ্চতা বিশ হাজার ফুটেরও বেশি। মাঝে পাহাড়ের উচ্চতা গড়ে সাত, আট হাজার ফুট। যেখানে আমরা এসেছি। পাহাড়ের মাঝে মাঝে কিছু ভ্যালী, যেগুলোতে গড়ে উঠেছে নগর, গ্রাম। ভ্যালী গুলোর আয়তন এত ছোট যে এয়ারপোর্টের জন্য একটা রানওয়েরও জায়গা হয় না। তাই রাজধানী থিম্পুতে কোন এয়ারপোর্ট নেই। পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে পারোতে এয়ারপোর্ট করতে হয়েছে। অন্যান্য পাহাড়ী শহর গুলোতে দেখেছি পাহাড়ের গায়ে থাকে থাকে ঘরবাড়ী, জনবসতি। কিন্তু এখানে পাহাড় জুড়ে শুধু পাইনের বন, সবুজে সবুজে ছাওয়া। ঘরবাড়ী শুধু ভ্যালীতে। মাঝে মাঝে পাহাড়ের চুড়ায় দুইএকটা মনেস্ট্রি চোখে পড়ে, এরা বলে জং। প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট না করা ভুটানের সরকারী নীতি। প্রকৃতিকে তারা শাসন করেনি, প্রকৃতিকে তার মত থাকতে দিয়েছে, তার মাঝে নিজেরা জায়গা করে নিয়েছে।

হিমালয়ের পাদদেশে এই ভুমিতে মনুষ্য বসতির ইতিহাস বহু পুরানো। খৃস্টপুর্ব ২০০০ সাল আগে থেকেই এখানে মানুষের বসতি ছিল। ভুটান পৃথিবীর অল্প কটি দেশের মত একটি যারা কখনোই কারো পরাধীন ছিল না, বরাবরই স্বাধীন ছিল এই ভুমি। অষ্টম শতকে তিব্বতে হানাহানির জের ধরে বেশ কিছু মংক নেমে আসে ভুটানে। তাদের হাত ধরেই এখানে গোড়াপত্তন হয় বৌদ্ধ ধর্মের। বৌদ্ধদের ধর্মীয় নেতা লামাগন এবং পঞ্চায়েত নেতারা যৌথ ভাবে সেই রাজ্য পরিচালনা করতেন। সেইসময়ে ভুটান অনেক ছোট ছোট খন্ডে বিভক্ত ছিল। উনবিংশ শতকের শেষ দিকে ইউজায়েন ওয়াংচু বিভক্ত ভুটানকে একত্রিত করেন এবং নিজে অবিভক্ত ভুটানের প্রথম রাজা হন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য যখন পুরো উপমহাদেশ দখল করে নেয়, তখন তারাও চেষ্টা করেছিল ভুটানের দখল নিতে। রাজা উজেন ওয়াংচুক তখন ব্রিটিশদের সাথে এক শান্তি চুক্তি করেন। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ভুটান স্বাধীন থাকবে তবে ব্রিটিশদের কিছু কিছু নির্দেশনা মেনে চলবে। ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর সদ্য স্বাধীন ভারতের সাথেও ১৯৪৯ সালে ভুটানকে একইরকম একটি চুক্তি করতে হয়। সেই চুক্তি মোতাবেক ভারত ভুটানের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না, কিন্ত আন্তর্জাতিক বিষয়ে ভুটানকে ভারতের কথা মেনে চলতে হবে। সেই ব্যবস্থা এখনো চলছে।

 

 

যদিও পৃথিবীবাসী এই দেশকে ভুটান নামে চিনে, কিন্তু ভুটানবাসীর কাছে তাদের দেশের নাম দ্রুক- ইয়ল (Druk Yul)। দ্রুক অর্থ বজ্র-ড্রাগন আর ইয়ল অর্থ আবাসভুমি, অর্থাৎ বজ্র-ড্রাগনের আবাসভুমি। দ্রুক নামটি ভুটানে ব্যাপকহারে ব্যবহৃত হয়। তাদের এয়ারলাইন্সের নামও দ্রুক, যেটাতে করে আমরা এসেছি। ভুটান নামটি দিয়েছে ব্রিটিশরা। ভুটান এসেছে ভারতীয় শব্দ ‘ভুটানিয়া’ থেকে। যার অর্থ ভুত (তিব্বতের অন্য নাম) ভুমির শেষ সীমানা।

দুপুরের কিছু আগে আমরা থিম্পুতে পৌছাই। হোটেলের নাম সাম্ভাভ। এমব্যাসির সুত্রে যারা আসে তারা প্রায় সবাই এই হোটেলে উঠে। মাঝারী মানের হোটেল। তিনতালা হোটেলের একটু পিছেই থিম্পু নদী। রুম থেকে দেখা যায় সশব্দে ছুটে চলেছে পাহাড়ী নদী। নদীর উপরে ব্রীজ। ব্রীজের ওপারে পাহাড়ের গায়ে রাস্তা, একেবেকে উঠে গেছে উপরে।

লাঞ্চ হোটেলেই। সিদ্ধান্ত হয় লাঞ্চের পর তিনটায় বের হবো থিম্পু ঘুরতে। লাঞ্চের পর হাতে কিছুটা সময় থাকাতে চলে যাই হোটেলের উল্টো পাশে একটা সুপার সপে। দীপুর ইচ্ছে প্রয়োজনীয় কিছু টুকটাক সপিং। সুপার সপের নাম মাই মার্ট। ভিতরে ঢুকে একটু অবাকই হই। এই অল্প কিছু মানুষের শহরে এতবড় সুপার শপ! তিনতালা জুড়ে এই সপে ভোগ পন্যের ছড়াছড়ি। কারা কিনে এসব?

অন্যান্য সামন্ততান্ত্রিক এবং পুজিবাদী দেশের মতো, ভুটানেও সম্পদ কুক্ষিগত অল্প কিছু মানুষের হাতে। এদের কেউ কেউ বিশাল সম্পদশালী। অধিকাংশ মানুষ গরীব। পার্থক্য হলো এই গরীব মানুষ গুলো অল্পতেই তুষ্ট, চাহিদা কম, যা আছে তা নিয়েই সুখী। হয়তো তারা বৌদ্ধ ধর্মের চেতনাকে অন্তরে ধারন করতে পেরেছে, নির্বান লাভের কাছাকাছি পৌছে গেছে! ভুটানের সত্তর শতাংশ মানুষই বৌদ্ধ, বাকী বিশ শতাংশের কিছু বেশি হিন্দু, দক্ষিনে ইন্ডিয়ার সীমান্তে এদের বসবাস।

নব্বই ভাগ মানুষের পেশা হলো কৃষিকাজ এবং পশুপালন। যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই তারা চাষ করে। নিজের প্রয়োজন মিটলেই তারা সুখী। বাকী ৭/৮ শতাংশ মানুষের পেশা তাত, কাঠের তৈরী সরঞ্জামাদি, ফল প্রক্রিয়াজাতকরন- এইরকম কিছু কুটির শিল্প। অতি ক্ষুদ্র একটা অংশ চাকরী করে বা ছোটখাট ব্যবসা করে। শিল্পায়নের ছোয়া লাগেনি এখনো। তাই আকাশ এখনো ঝকঝকে নীল, বাতাস বিশুদ্ধ, নদীর পানি অমৃতের মতো!

রাষ্ট্রের প্রধান আয় জলবিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে। যার প্রায় সবটুকুই কিনে নেয় ভারত। এত বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরও ভুটানের সত্তর শতাংশ মানুষ এখনো বিদ্যুতের আওতার বাইরে । অবশ্য শহরের বাইরে মানুষেরা এত দূরে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যে, সেসব জায়গায় বিদ্যুৎ পৌছানোও কঠিন। রাষ্ট্রের আয়ের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ট্যুরিজম। প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এই আশংকায় ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ভুটানে বিদেশী টুরিস্ট নিষিদ্ধ ছিল। এখন প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ ট্যুরিস্ট আসে হিমালয়ের কোলে ছবির মত সুন্দর এই দেশটি দেখতে।

আপনার মতামত দিন:


ভ্রমণ এর জনপ্রিয়