Ameen Qudir

Published:
2019-12-29 05:16:34 BdST

মোগলদের বাদশাহি দেখে আসি শিউলি সেনের সঙ্গে


আগ্রায় , দিল্লীতে বসে মহাপ্রতাপে বাদশাহি করেছে মোগলরা। সেসব নিয়ে , নেপথ্যের নানা তথ্য নিয়ে এই আয়োজন।

শিউলি সেন
_________________________

আগ্ৰা ফোর্ট যদিও আমরা এককথায় মোগলদের কীর্তি বলে থাকি, কিন্তু ইতিহাস অন্য কথাই বলে। ইতিহাস অনুযায়ী এগারো শতকে এ স্থানে একটি দুর্গ ছিল। রাজা বাদল সিংয়ের সামরিক দুর্গ ‘বাদলগড়’। পরবর্তীতে গজনীর বাহিনী এ দুর্গ দখল করেছিল। এরপর একসময় সিকান্দার লোদি দিল্লি থেকে রাজধানী এখানে স্থানান্তরিত করেন। এ সময় সিকান্দার লোদি এ দুর্গে বেশ কিছু ইমারত ও ইজারা নির্মাণ করেন।

তারপর সিকান্দারপুত্র ইব্রাহিম লোদীর হাতে এ দুর্গ আসে। পানিপথের যুদ্ধে বাবরের কাছে পরাজিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ইব্রাহিম লোদীর কাছে থাকে। এরপর বাবর ১৫২৬ সালে এ দুর্গের দখল নেন এবং একটি বাউলি (সিঁড়িযুক্ত ইজারা) নির্মাণ করেন। ১৫৩০ সালে এখানেই হুমায়ূনের রাজ্যভিষেক হয়েছিল। ১৫৪০ সালে হুমায়ূন শেরশাহ সুরীর কাছে পরাজিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এটি হুমায়ূনের কাছে ছিল। এরপর এটি শেরশাহের হাতে চলে যায়।

১৫৫৫ সালে হুমায়ূন আবার আকবরের রণকৌশলের জোরে এ দুর্গের দখল পায়। কিন্তু পরবর্তীতে হুমায়ূনের মৃত্যু এবং আকবর সে সময় পাঞ্জাবে থাকার কারণে কয়েক দিনের জন্য এটি আদিল শাহের সেনাপতি হেমুর দখলে চলে যায়। আকবর হেমুর সাথে যুদ্ধ করে আবার এ দুর্গের দখল নেয় এবং ১৫৫৮ সালে আগ্রায় রাজধানী স্থানান্তরিত করে। বিভিন্ন যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত দুর্গের তিনি পুনর্নির্মাণ শুরু করেন। রাজস্থান থেকে বেলে পাথর এনে চার হাজার কর্মীকে কাজে লাগিয়ে আজকের আগ্ৰা ফোর্ট নির্মাণ করেন।


এতে তিনি খরচ করেছিলেন সাড়ে তিন মিলিয়ন টাকা। তিনটি গেট যদিও বর্তমানে একটি গেট দিয়েই প্রবেশ করা যায়। যার নাম অমর সিং গেট। ১৬৪৪ সালে এ গেটের পাশে যোধপুরের মহারাজ অমর সিংয়ের মৃত্যু হওয়ায় স্মারক রূপে গেটটির নাম অমর সিং গেট রাখা হয়। এখানে ঘোড়ার পিঠে মহারাজের মূর্তিও তৈরি করা হয়েছে।

আকবর গেট নির্মাণের বিষয়ে মূল লক্ষ্য রেখেছিলেন বহিরাগত সৈন্যের দিকে। তাই বিসর্পিল পথে এমনভাবে তিনি আগমন সড়ক বানিয়েছিলেন, যাতে দুর্গরক্ষীর দল সহজে অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়েও বহিরাগত বিশাল বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে পারে। যার জ্বলন্ত উদাহরণ ১৫৯৯ এবং ১৬২২ সালে দু’ বারই জাহাঙ্গীর পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বিশাল বাদশাহী ফৌজ নিয়ে আগ্রা কেল্লা আক্রমণ করে প্রবেশে ব্যর্থ হন। গেটের দু’পাশে দুটি অষ্টভুজাকৃত ইমারত।


আগ্রা ফোর্টের প্রবেশ পথে হিন্দু ও মধ্য এশীয় স্থাপত্যের সমন্বয়ে তৈরি ১৫৭০ সালের জাহাঙ্গীর মহল। দুর্গের বৃহত্তম এ মহল (৭৮ বর্গমিটার) আকবর তৈরি করান তার প্রিয় পুত্রের জন্য। তার পাশেই আকবরের প্রিয় মহিষী এবং সেলিমের মা যোধবাঈয়ের মহল। পরবর্তীতে এর উওর অংশে গড়ে ওঠে শাজাহান মহল। এরপরে আছে দেওয়ান-ই-আম। এর আগের রূপকে আমূল পরিবর্তন করে নতুন রূপে সাজিয়েছেন শাজাহান। এটি প্রজাদের সাথে মিটিং হল। তিন দিক খোলা লাল বেলে পাথরের তৈরি মেঝে, মর্মর খচিত জালি দেওয়াল, ছাদটিও লাল পাথরের। চল্লিশ পিলারে ভর করা মর্মরে অলঙ্কৃত প্যাভিলিয়নে সুসজ্জিত সিংহাসনে বসে প্রজাদের কথা শুনতেন।

১৬০৯ সালে দেওয়ান-ই-আমেই বিট্রিশ প্রতিনিধি উইলিয়াম হকিন্সের সাথে জাহাঙ্গীরের যোগসূত্র ঘটে। সম্রাট ব্যক্তিগত অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখতেন দেওয়ান-ই-খাসে। ১৬৩৬-৩৭ সালে দেওয়ান-ই-খাস তৈরি হয়। ১০৭ মিলিয়ন টাকার ময়ূর সিংহাসনটিও ছিল দেওয়ান-ই-খাসে। পরবর্তীতে যখন শাজাহান রাজধানী দিল্লি নিয়ে যান; তখন ময়ূর সিংহাসনটিও দিল্লি যায়। দেওয়ান-ই-খাসের লাগোয়া বামে মমতাজের জন্য শাজাহান তৈরি করিয়েছিলেন মণিমানিক্য খচিত দ্বিতল মুহম্মদ বুর্জ বা অষ্টকোণী টাওয়ার। ছেলে আওরঙ্গজেবের হাতে বন্দি পিতা শাজাহানের জীবনের শেষ আট বছর ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত এখানেই কেটেছে দেয়ালে তাদের প্রতিবিম্ব দেখে। তাই একে প্রিজনার্স টাওয়ারও বলে।


এরপর বিভিন্ন সময়ে মারাঠা ও তাদের শত্রুরা আগ্রা দুর্গের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। ১৭৬১ সালে আহমেদ শাহ আবদালি পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মারাঠাদের পরাজিত করলে পরবর্তী এক দশক মারাঠারা এ দুর্গ দখলের কোন চেষ্টা করতে পারেনি। পরে এ দুর্গ ব্রিটিশরা দখল করে নেয়।


ইংরেজ আমলে সিপাহি যুদ্ধের সময় ১৮৫৭ সালে এ ফোর্টে প্রায় ৬ হাজার ব্রিটিশ, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ও সংশ্লিষ্ট মানুষ সপরিবারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ব্রিটিশরা সে সময় এর ব্যাপক পরিবর্তন করে। ব্রিটিশ সৈন্যদের ব্যারাক নির্মাণের ফলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চলে এ দুর্গে। কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে অনেক ভবন। কোথাও কোথাও ক্ষয়ে গেছে এর ইট-পাথর-সুরকি। তাই এখনই ঘুরে আসুন আগ্রা ফোর্ট থেকে।

ফতেহপুর সিক্রি নামের সঙ্গে সম্রাট আকবরের নাম জড়িত। যদিও শহরটির ইতিহাস আরও পুরোনো। আকবরের দাদা সম্রাট বাবর জায়গাটির নাম সিক্রি রাখেন। সীমান্ত অঞ্চলে সংগ্ৰাম সিংহের সাথে যুদ্ধের সময়ে বাবরের সৈন‍্যরা এখানকার শুকরী ঝিলের পানি ব‍্যবহার করতো। সেই যুদ্ধে বাবরের জয় হয়েছিল। তাই আল্লাহকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন অর্থাৎ শুকরিয়া জানানো থেকে সিক্রি নামকরণ হয়।

সে সময় বাবর এখানে প‍্যাভিলিয়ন ও বাগিচা গড়েন। বাগানের নাম দিয়েছিলেন ‘বিজয় উদ‍্যান’। গুলবদন বেগমের ‘হুমায়ূননামা’তে লেখা আছে, বাবর সেই বাগানে একটি আটকোণা চাতাল বানিয়েছিলেন। যা তিনি বিনোদন ও লেখার জন্য ব‍্যবহার করতেন। একটি ঝিলের মাঝখানে একটি বেদীও নির্মাণ করেছিলেন। কিছুটা দূরে একটি পাথরের চড়াই ছিল, যার তলায় বালি ছিল। এখানে একটি পাথরের ফলকে খোদাই করা ছিল বাবরের বিজয়ের ইতিহাস। পরবর্তীতে যত্নের অভাবে তা নষ্ট হয়ে যায়।

এরপর আকবর যখন সন্তানের আশায় বিচলিত হয়ে উঠেছিলেন; তখন একদিন জানতে পারেন যে বাবরের নামকরণ করা সেই জায়গায় এক অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন ফকির আছেন। তার আশীর্বাদে ‘অপুত্রের পুত্র হয় আর নির্ধনের ধন হয়’। আকবর তখন ফকিরের কাছে আগ্ৰা থেকে পদব্রজে গিয়ে ধরনা দেন। ফকির তখন আকবরের আরজি শুনে আশীর্বাদ করেন। এর কিছুদিন পরই আকবরের স্ত্রী যোধাবাঈ সন্তানসম্ভবা হন। আকবর তখন সেই গ্রামে রানীর জন্য একটি ঘর নির্মাণ করেন। ১৫৬৯ সালের ৩০ আগস্ট তাদের পুত্র জন্ম নেয়। ফকির ‘শেখ সেলিম চিস্তি’র নামানুসারে আকবর ছেলের নাম রাখেন সেলিম।

আগ্রা শহর থেকে ৩৯ কিলোমিটার দূরের গ্রামটি আকবরের পচ্ছন্দ হয়। সেলিমের জন্মে খুশি হয়ে আকবর এখানে নতুন মহানগরী স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। নগরীর নাম হয় ‘ফতেহবাদ’। যা পরবর্তীতে ‘ফতেহপুর সিক্রি’ নামে পরিচিত হয়। আকবরের প্রতিষ্ঠিত ফতেহপুর সিক্রি ছিল শিল্পী ও গুণী ব্যক্তিদের আদর্শ স্থান।


আকবর পূর্বপুরুষ তৈমুরের মতো পারসিক আদলের সঙ্গে স্থানীয় আদলের মিশ্রণ ঘটিয়ে এক যুগান্তকারী স্থাপত্যকলার প্রচলন করেন। মাইল দুয়েক লম্বা এবং মাইল খানেক চওড়া ফতেহপুরে নতুন রাজধানী গড়ে ওঠে। শহরের চৌহদ্দি প্রায় দশ কিলোমিটার। ইংরেজ পর্যটক র্যালফ ফিচ ১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দে শহরকে লন্ডন শহর অপেক্ষা বৃহৎ ও জনবহুল বলে বর্ণনা করেন। তিন দিক প্রাচীরে ঘেরা- নয়টি গেট, চতুর্থ পাশে তৈরি করা হয়েছিল কৃত্রিম লেক। নয়টি দরজা হলো- বুলন্দ, দিল্লি, লাল, আগ্রা, বীর পোল, চাঁদ পোল, গোয়ালিয়র, টেরা এবং আজমিরি দরজা।

আগ্রার দিক থেকে এলে প্রথমে পড়বে আগ্রা দরজা। এটি পার হয়ে এগিয়ে সামনে নহবতখানা। সে সময়ের চহার-সুখ। তার ভেতর দিয়ে রাজপথ। ডানে একটি সড়ক। যা দিয়ে এগিয়ে গেলে তানসেন বারাদরী, তানসেনের আবাস। এসব কয়টা দরজার মধ্যে প্রধান হলো বুলন্দ দরজা। ১৫৭৩ সালে আকবর গুজরাট বিজয়ের স্মৃতিতে এটি তৈরি করেছিলেন।


ফতেহপুর সিক্রি নির্মাণের জন্য খরচ হয়েছিল ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এতে ২ হাজার ৯০০টি অট্টালিকা ছিল। সে সময় ফতেহপুর সিক্রি দুর্গে ৬০ হাজার সৈন্য বাস করতো। দিল্লির লালকেল্লা বা আগ্ৰা কেল্লার চেয়ে ফতেহপুর সিক্রির আকার অনেক বড় এবং অনেক জাঁকজমকপূর্ণ ছিল।

আকবর ফতেহপুর সিক্রির প্রধান দরজা বুলন্দ নির্মাণ করেছিলেন দক্ষিণাত‍্য, বিশেষ করে গুজরাট বিজয়ের প্রতীক হিসেবে। এটি বিশ্বের বৃহত্তম দরজা। বুলন্দ দরজা মানে বড় দরজা। বলা হতো, এত বড় দরজা দিয়ে মানুষ কেন, হাতিও প্রবেশ করতে পারে। দরজাটি খুলতে একসাথে কুড়ি-পঁচিশ জন সৈনিক দরকার হতো।


রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করার জন্য দরজাটি তৈরি হতে এক বছরের মতো লেগেছিল। প্রায় চল্লিশ ফুট উঁচু বেদীর উপর বুলন্দ দরজাটির উচ্চতা ৫৪ মিটার। দরজাটি এমন স্থানে; যেখানকার জমির ঢালের জন্য সোপান নির্মাণ জরুরি ছিল। যার ফলে এ সোপানযুক্ত দরজা তার নিজের গঠনশৈলীতে আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছে।

দরজাটির সামনে ৮৬ ফুট চওড়া একটি কেন্দ্রীয় দ্বারপথ ও দু’পাশে কোণাকুণিভাবে পেছনে সরানো আরও দুটি পথ। বিশ্বখ‍্যাত এ দরজায় কুরআনের আয়াত খোদিত আছে। এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো- এটি বাইরে থেকে দৈত্যাকৃতির হলেও ভেতরের দিকে তুলনামূলক ছোট। তাই অন্য দরজার চেয়ে এটি গঠনশৈলীর কারণে দর্শকের চোখে আলাদা জায়গা করে নিয়েছে।

 

সেলিম চিস্তির দরগা: সেই সেলিম চিস্তি; যার আশীর্বাদে রাজা হওয়ার চৌদ্দ বছর পরেও আকবর-যোধাবাঈ সন্তান লাভের সৌভাগ্য লাভ করেন। তাই আজও দর্শনার্থীরা চিস্তির সমাধিতে এসে শ্রদ্ধাস্বরূপ মাথা ঢেকে ঢোকে। তাকে প্রণাম করে, প্রার্থনা করে, মনের ইচ্ছা পূরণের জন্য জালিতে লাল সুতা বাঁধে।

১৫৭১ সালে ৯২ বছর বয়সে আকবরের এই পরম শ্রদ্ধেয় ফকির সেলিম চিস্তির ইন্তেকাল হয়। আকবর তখন নির্দেশ দেন চিস্তির স্মৃতিসৌধ নির্মাণের। একতলা এ দরগা তৈরি হয় মার্বেল পাথরের চৌকাকৃত ইমারতের আকারে। এর ভেতরে শায়িত করা হয় সেলিম চিস্তির মরদেহ।

ভারতের যাবতীয় মর্মর সৌধের মধ্যে এটি অনন্য। শুভ্র মর্মর নির্মিত এ সমাধির চতুর্দিকে মর্মর গবাক্ষ এবং প্রত্যেকটি গবাক্ষ হস্তিদন্ত শোভিত। ভেতরে শুক্তিকা খচিত সমাধি এবং তাতে বিচিত্র বর্ণের কৃত্রিম পুস্পলতা সুক্ষ্ম প্রস্তর সংযোগে তৈরি করা হয়েছে। সেইসাথে ইমারতের ছাদের প্যারাপেটগুলো এমন চওড়া করে বানানো হয়েছে। যেন সিক্রির কড়া রোদ ভেতরে যেতে না পারে। আর প্যারাপেটের ভার বহন করার জন্য প্রতিটি কোণে সাপের মতো প্যাচানো স্ট্রাকচার। সেইসাথে সৌধের গম্বুজের উপরে বৃষ্টির ধারা যে পড়বে, তার যেন কোন জলনিকাশি নালি দিয়ে সমাধি চত্বরের মেঝেতে নেমে না আসে। তাই এ দলকে ভারবাহী এ ফাঁপা মর্মর স্তম্ভের ভেতর দিয়ে ভূগর্ভস্থ পয়ঃপ্রণালি বাইরের জলধারে ফেলা হয়েছে।

সেইসাথে মকবরাজুড়ে পাথরের জালি কাজগুলো দেখার মতো। জালিগুলো দিয়ে যখন বাইরে থেকে দেখা হয়, তখন ভেতরের কিছু দেখা যায় না। কিন্তু ভেতরের থেকে বাইরের সব কিছু ছবির মত দেখা যায়। তাই এ সমাধি দর্শন শেষে মনে হয়, আকবর যেন একটি ভক্তিমণ্ডিত শুভ্র সুকুমার ফুল গুরুর চরণে নিবেদন করেছেন। সেলিম চিস্তির দরগার ব্যাপারে এ কারণে সৈয়দ রিজভী লিখেছেন, ‘চিস্তির মকবরার কাব্যময় রূপটিকে বর্ণনা করবার উপযুক্ত বিশ্লেষণের সত্যিই বড় অভাব।’ ভারতের যাবতীয় মর্মর সৌধের মধ্যে এটি অনন্যই।

এরপর আমরা আকবরের মহল পরিদর্শন করেছি। যেখানে একাধারে আছে আকবরের বেগমদের মহল এবং আকবর মাতা হামিদা বানু বেগমের মহল। আকবর জননী হামিদা বানু বেগমের মহলের নাম সুনহারা মকান বা গোল্ডেন হাউস। ইংরেটি ‘টি’ বর্ণের আকারে নির্মিত এ মোকামের দু’দিকে দু’টো সিঁড়ি আছে দ্বোতলার চবুতরায় উঠে যাওয়ার।

এরপরে আসা যাক আকবর মহিষীদের মহল। এরমধ্যে সুনহারা মকানের লাগোয়া গুজরাট থেকে শিল্পী এনে গড়া যোধাবাঈ মহল। যোধাবাঈ যিনি ছিলেন আকবরের প্রধান মহিষী, জাহাঙ্গীরের মা এবং অম্বরকন্যা মান সিংহের বোন। যোধাবাঈয়ের এ চতুষ্কোন প্রাসাদের বাইরের দিকে অন্ধপ্রাচীর, ঘরের থেকে বাইরে বা বাইরের থেকে ভেতরে তাই কিছুই দেখা যেতো না। এ মহলের ভেতরে আছে যোধাবাঈয়ের পূজার ঘর, বসার ঘর। এসব কিছুতেই রাজস্থানি শিল্পকলা বর্তমান। যোধাবাঈ মহলের সাথে লাগোয়া গোয়া থেকে আসা আকবরের খ্রিষ্টান বেগম মারিয়ামের গোল্ডেন প্যালেস। কাশ্মিরি শৈলীর দারু খচিত সুলতানা লুকায়া বেগম বা তুরস্কের বিবি সুলতানা বেগম কোঠি।

এরপর সবার আগে বলি, বাদশাহের বিচারসভা দেওয়ান-ই-আম। কিংস গেট দিয়ে ঢুকে আয়তকার বিশাল সভা দেওয়ান-ই-আম। এর পশিচম দিকের অলিন্দের কেন্দ্রস্থলে দ্বিতলে একটি ঝোলা বারান্দায় পাশাপাশি পাঁচটি কক্ষ। কেন্দ্রস্থ অলিন্দের ঝরোকায় বসতেন বাদশাহ। বাইরের দিক থেকে অন্যান্য আমির-ওমরারা অন্য সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে সভায় বসতেন। দেওয়ান-ই-আমের উওর-পশ্চিম দিকে একটি লোহার আঙটা পাষাণ চত্বরে সুদৃঢ়ভাবে আটকানো। বলা হয়, এটিতে একটি সুশিক্ষিত হাতি বাঁধা থাকতো। কোন অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড হলে হাতির পদতলে পৃষ্ট করা হতো। যদিও সেই শাস্তি দিনে কার্যকর হতো। মাহুতের কাজ ছিল প্রতিদিন হাতিকে সভায় নিয়ে আসা।

বাদশাহের এ অনবদ্য কারুকার্যময় মন্ত্রণাসভা ভ্রমণার্থীদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। সমচতুষ্কোন ইমারতটি বিখ্যাত তার কেন্দ্রস্থ স্তম্ভটির কারণে। হিন্দু ও মুসলিম স্থাপত্যের মিলন হয়েছে এতে। একে আকবরের গোপন মন্ত্রণাসভা মনে করা হয়। আবার কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, এখানে বসে আকবর হীরা-জহরতগুলো পরীক্ষা করতেন। তাদের এ মতের কারণ, এর ঠিক পশ্চিমেই দৌলতখানা।

এছাড়া অসহ্য গরমের হাত থেকে বাঁচতে তৈরি করা হয়েছিল পাঁচ মহল। গরম থেকে মুক্তি পেতে প্রতিটি তলা ক্রমশ সংকীর্ণ হয়েছে। মোট ১৭৬টি স্তম্ভে তৈরি পাঁচ মহলের নিচু তলায় স্তম্ভের সংখ্যা ৮৪, তারপর কমে ৫৬, তারপর ২০, তারপর ১২ এবং সবশেষে ৪ শিরে গম্বুজ। পিলারগুলো একটি আরেকটি থেকে স্বতন্ত্র। অতীতে প্রতি তলায় বাইরের অংশ দিয়ে জালি কাজের নকশা সমন্বিত পাথরের দেয়াল ছিল, তাই থেকে ঝুলতো খসখস। সূর্যাস্তের উপক্রম দেখলেই দাসিরা সেগুলো ভিজিয়ে দিতো। যার ফলে সন্ধ্যায় স্নিগ্ধ হয়ে থাকতো এ পাঁচ মহল। গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে চলত মহিলা মহলের গুলতানি, কোথাও খাসগল্প তো, কোথাও গজলি।
_________________
লেখক
ভ্রমণ উপদেষ্টা, দিল্লি

আপনার মতামত দিন:


ভ্রমণ এর জনপ্রিয়