Ameen Qudir
Published:2019-11-12 04:58:33 BdST
হোটেল ব্যাবসা নাকি অতিথি নারায়ণ ?
ডা সুরেশ তুলসান
_____________________
সাল ১৯৯৬ -
আমি তখন ভেলোরে -
ব্যাক্তিগত চিকিৎসার কারণে। -
অন্যান্য সকল প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে ছোট্ট একটা গল্প বলবো,
তাতে যদি আমাদের হোটেল ব্যাবসায়ীদের একটু হলেও চোখ খোলে
আর হৃদয় গলে।
ভেলোরের সিএমসি হাসপাতালের আশেপাশে অনেকগুলো খাবারের হোটেল।
বিভিন্ন মানের,দামের আর বিভিন্ন ধরনের।
এমনকি বিকালের পরে ফুটপাতে কিছু অস্থায়ী খাবার দোকানও।
তবে ফুটপাতের খাবার দোকান হলেও মনে হচ্ছিলো কোথাও যেন একটা আন্তরিকতা ছোঁয়া এবং খুব বেশি Unhygienic মনে হয়নি। লোকজন খাচ্ছেও বেশ সাচ্ছন্দে। সত্যি বলতে কি আমিও একবেলা খেয়েছি। খারাপ লাগেনি।
তবে একটা বিষয় খুব সহজেই লক্ষনীয়, এবং সেটা হলো প্রত্যেকেরই প্রচেষ্টা সামর্থ্য অনুযায়ী নিজ নিজ কাস্টমারদের সন্তুষ্ট করা।
রোগী এবং রোগীর স্বজনরাই মুলত তাদের খরিদ্দার ( খরিদ্দার না বলে আসলে অতিথি বলা উচিত, এবং কেন সেটা গল্পটা শেষ হলেই বুঝতে পারবেন)।
হোটেল গুলোর অধিকাংশেরই খাবারের দাম মানের তুলনায় ভারতের অন্যান্য শহরের চাইতে বেশ কম।
তবে খাবারের প্রকার বা ধরন কিন্তু আমাদের থেকে একদমই আলাদা।
অধিকাংশ দোকানেই দক্ষিণ ভারতের ডিশ যেমন দোসা, ইডলি, মেদু বড়া,খিচডি (মানে আমাদের খিচুড়ি তবে স্বাদ আরা ঘ্রাণে বিস্তর তফাৎ), উত্তপম ইত্যাদি।
প্রায় সব খাবারের সাথেই সাম্বার ( কয়েক প্রকার ডাল আর নানারকম সবজি মিশিয়ে রান্না করা টক ঝোল জাতীয় এক ধরনের তরকারি) আর নারিকেল এর চাটনি।
এইসব উদ্ভট উদ্ভট নাম, স্বাদ আর ঘ্রাণের খাবার একবার দুবার শখ করে খাওয়া সম্ভব, তবে দিনের পর দিন স্টেপল ফুড হিসাবে খেয়ে বেঁচে খাকা অসম্ভব তো দুরের কথা এক্কেবারেই বেসম্ভব।
সিএমসি হাসপাতালের আশেপাশের রাস্তাগুলো বেশ অলিগলিতে বিভক্ত।
আমি ১৩ দিন ছিলাম ভেলোরে।
অবস্থানের ৩য় দিন এমনই এক গলিতে আবিষ্কার করলাম একটা খাবার হোটেল।
হোটেলের কি নাম বা আদৌ কোন সাইনবোর্ড ছিলো কিনা মনে নেই।
হোটেলটা নিরামিষ, অর্থাৎ সেখানে কোন প্রকার মাছ-মাংস বা ডিম রান্না হয় না।
তবে ডাল-ভাত সবজির আয়োজন দেখেই আমি খুশী।
দুপুরের খাবার ২৮ টাকা, এবং রাতের খাবার ২৫ টাকা।
এই টাকায় একজন মানুষ একবেলায় যতটা ইচ্ছে ততটা খাবার পেটপুরে খেতে পারবে।
খেতে বসলাম, বেয়ারা আমার সামনে টেবিলের উপর বেশ বড় আকারের একটা ঝকঝকে স্টেইনলেস স্টিলের থালা রাখলো।
থালার উপর হাত রাখতেই বুঝলাম থালাটা বেশ গরম, বেয়েরাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম একটু আগেই গরম পানি দিয়ে ধোয়া তাই গরম।
বেয়ারা এসে জিজ্ঞাসা করলো
"পহলে চাওল লেঙ্গে য়্যা রোটি"
অর্থাৎ আমি খাওয়া শুরু করতে চাই কি দিয়ে, ভাত না রুটি ?
দেখলাম ওরা সবাইকে খাবার পরিবেশন করছে অনেকটা মেজবান বাড়ির স্টাইলে।
একে একে ভাত, রুটি, তরকারি, ডাল, টকদই, আচার, পাপড় ইত্যাদি সবারই থালায় দিয়ে যাচ্ছে।
কারও থালায় কোন একটা পদ শেষ হয়ে গেলে সেই পদ তার আর লাগবে কিনা খেয়াল রাখছে।
কেউ ঠিকমতো না খেলে বলতে শুনলাম আপনি তো কিছুই খেলেন না, রান্না কি ঠিক হয়নি ?
কিংবা আর এক চামচ চাওল ( ভাত) অথবা একটা রুটি বা কোন সবজি বা ডাল দেওয়ার জন্য মৃদু পিড়াপীড়ি।
যারা খাবার পরিবেশন করছে তাদের পাশাপাশি একজন সার্বক্ষণিক দাঁড়িয়ে আছে কারও কিছু লাগেবে কিনা তদারকি করার জন্য।
আমি বরাবরই অল্প খাই, আর রান্না আমাদের মত না হওয়ায় আরও কম খাচ্ছিলাম দেখে একজন বললো " কুছভি তো নেহি খায়া, লো এক আওর পাপড় খাও "( কিছুই তো খেলে না, এই নাও আরও একটা পাপড় খাও)।
এরপর থেকে প্রতিদিন দুইবেলা এই হোটেলই এসে খাই।
দেখি কেউ একটু কম খাচ্ছে তো আরেকজন একটু বেশি খাচ্ছে। আর প্রতিদিনই এমন কিছু মানুষ চোখে পড়ে যারা অনেকক্ষণ ধরে বসে বসে গোগ্রাসে গিলতেই থাকে যেন টাকাটা কিভাবে আসল+লাভ সহ শতভাগ হালাল করা যায়।
প্রতিদিন দুইবেলা খাওয়া আর আসাযাওয়ার সুবাদে হোটেলের মালিক রঘুনাথ মহাশয়ের সাথে পরিচিত হলাম।
বেশ মিশুক ভদ্রলোক, যে চরিত্রটা সাধারণত ভারতীয়দের মধ্যে সচরাচর চোখে পড়ে না।
ক্যাশ কাউন্টারে নিজেই বসেন।
আর যে ছেলেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অতিথিদের খাওয়াদাওয়ার তদারকি করছে সে তার বড় ছেলে ( নাম মনে নেই এতদিন পর )।
প্রতিদিন খাওয়ার পর বিল দেয়ার সময় ভদ্রলোকের সাথে একটু একটু করে আলাপ জমানোর চেষ্টা করতে থাকি।
একদিন সুযোগ বুঝে গোগ্রাসে গিলতে ব্যাস্ত কয়েকজনকে ইশারায় দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম এই যে মানুষগুলো প্রতিদিন মাত্র ২৮ টাকায় তোমার দোকানে এসে রাক্ষসের মতো করে খেয়ে যায় এতে করে কি তোমার কোন কষ্ট হয় না। তিনি অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে উত্তর দিলেন কষ্ট হবে কেনো ?
আমি প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষের খাওয়ার আয়োজন করি।
আমার লাভ সহ মাথা পিছু গড়ে ২৮ টাকা দাম হিসাব করা।
কেউ একটু কম খায়, কেউ একটু বেশি খায়, নির্দিষ্ট সংখ্যক অতিথি খেলেই হলো।
এভাবে আমার যে মুনাফা হয় তাতে আমার বেশ আয়েশেই চলে যায়।
কে কম খেলো, কে বেশি খেলো আমার দেখার দরকার আছে কি ?
আমার অতিথি নারায়ণের সেবা হলেই হলো।
সামর্থ থাকলে এতোগুলা অতিথি নারায়ণ সেবা প্রতিদিন মুফতে ( Free of cost ) করতাম।
সামর্থ্য নাই, প্রভুর ইচ্ছে নাই তাই টাকা নেই।
এভাবেই বেশ কাটছিলো দিনগুলো।
একদিন রাতের খাওয়া শেষে বিল দেওয়ার সময় বললাম আগামী পরশু চলে যাবো ভেলোর থেকে।
শুনে বললেন আগামীকাল দুপুরের খাওয়াটা যেন আমি তার বাড়ীতে খাই।
আমাকে বললেন, তুমি কাল দুপুরে আসো আমি দোকানেই অপেক্ষা করবো তোমার জন্য।
পরের দিন আমি যথাসময়ে হোটেলে উপস্থিত।
তিনি ক্যাশ কাউন্টারেই বসেছিলেন।
আমাকে দেখে ছেলের হাতে ক্যাশ কাউন্টারের দায়িত্ব দিয়ে আমাকে নিয়ে চললেন বাড়িতে।
বাড়ি দোকানের পিছনে এবং সাথেই লাগোয়া। মাঝে হোটেলের রান্নাঘর।
স্ত্রীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
বড়ছেলে বিবাহিত, পুত্রবধূ দুই নাতি সহ বাপেরবড়ি গেছে তাই বাড়ি ফাঁকা।
মেজ ছেলে আর ছোট মেয়েটা যথাক্রমে কলেজে আর স্কুলে।
রঘুনাথজির সাথে খেতে বসলাম।
গৃহকর্ত্রী নিজেই পরিবেশন করছেন।
খাবারের উপকরণ দেখে তো আমার চোখ কপালে।
দাওয়াত পেয়ে ভেবেছিলাম এতোদিন হলো হোটেলে খাচ্ছি, আজ অনেকদিন পর বাড়ির রান্না পেটে পড়বে।
কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি।
রোজ হোটেলে যে খাবারগুলো খাই সেই একই খাবার শুধু পরিবেশের ধরন আর বাসনকোসন আলাদা, সাথে কিছু মিস্টি, কাটা ফল আর ফলের রস।
একরাশ বিস্ময় নিয়েই খাওয়াটা শেষ করলাম।
সত্যিকার অর্থে উদরপূর্তি করেই খেলাম।
তবে খাওয়ার সময় কিন্তু মনে হয়নি হোটেলের খাবার খাচ্ছি।
মনে হচ্ছিলো যেন অনেকদিন পর সত্যিকারের বাড়ির রান্না করা খাবারই খেলাম।
রঘুনাথজি মনে হয় আমার মনের কথা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন,
তাই বললেন তুমি ভাবছো তোমাকে বাড়িতে দাওয়াত করে ডেকে নিয়ে হোটেলের খাওয়া খাওয়াচ্ছি ?
বিষয়টা কিন্তু উল্টা।
আমাদের আলাদা কোন রান্নাঘর নেই। হোটেলের যে রান্নাঘর সেটাই আমাদের বাড়ির রান্নাঘর। আমারা রোজ এই খাবারই খাই। আমাদের জন্য আলাদা করে কোন রান্না করা হয় না।
বাইরে আমার হোটেলে বসে যে মানুষগুলো খাচ্ছে তারা আসলে আমার বাড়িতে, আমার বাড়ির খাবার খাচ্ছে।
তুমি যতদিন খেয়েছো আমার বাড়িতেই খেয়েছো, পার্থক্য এই যে এতোদিন টাকা দিয়ে খেয়েছো।
অতিথি হচ্ছেন সাক্ষাৎ নারায়ণ।
অতিথি সেবা করা মানেই ঈশ্বরের সেবা করা।
ঈশ্বর আমাকে সেই সৌভাগ্য দিয়েছেন তাই এতোগুলা মানুষ প্রতিদিন আমার আঙ্গিনায় খেতে আসেন।
তবে তার ইচ্ছে নেই তাই হয়তো তিনি আমাকে এতোটা সামর্থ্য দেননি যে প্রতিদিন মুফতে (ফ্রী) এতোগুলো মানুষকে সেবা করবো।
এরপর তিনি তার হোটেল, রান্নাঘর, বাসন মাজার ব্যাবস্থা, পরিস্কারের পর গরম পানি দিয়ে বাসন ধোয়ার ব্যবস্থা ইত্যাদি ঘুরে দেখালেন।
খাবার পানির ব্যাবস্থাতেও বেশ বুদ্ধিমত্তা আর আন্তরিকতার ছোঁয়া।
বেশ বড় পানির ট্যাংক।
একজন কর্মচারী রাত্রে সব কাজ শেষে পানির ট্যাংক পরিষ্কার করে তাতে পানি ভরে পানিতে ফিটকিরি গুলিয়ে রাখে। (বোতলজাত পানির এতটা ব্যপক প্রচলন হয়নি তখন।)
এতোগুলা মানুষের খাবার দাবার আয়োজনের কেনাকাটা, বাজার সদাই আগে তিনি নিজেই করতেন।
এখন এই কাজ তার স্ত্রী আর বড় ছেলে মিলে করে।
বাকি সব কাজ করে কর্মচারীরা।
আমি সচরাচর হোটেলে খাই না।
তবে নিতান্তই বাধ্য হয়ে যখন কোন হোটেলে খেতে বসি তখনই আজো মিস করি ২৩ বছর আগের সেই রঘুনাথজি কে।
( বি.দ্র- আমার এই স্টাটাস পড়ে একজন ফোন করে জানালেন যে, তিনিও সেই হোটেলে খেয়েছেন ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে, তবে খাবারের দাম তখন এতো ছিলো না। দুপুরের খাবার ১৪ টাকা এবং রাতের খাবার ১২ টাকা। অনেকদিনের কথা আমারই হয়তো ঠিকঠাক মনে নেই )।
ডা সুরেশ তুলসান।
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ।
আপনার মতামত দিন: