Ameen Qudir

Published:
2018-11-22 21:37:15 BdST

স্বপ্নের জাপান ভ্রমণ


 


ডা. মোহাম্মদ জোবায়ের মিয়া


এক ________________


নেট ঘাটতে ঘাটতে গত জুলাই মাসের দিকে হঠাত দেখলাম এলাইড একাডেমি "সাইকিয়াট্রি এন্ড সাইকিয়াট্রিক ডিস ওরডারস " এর ১৯ তম কংগ্রেস আয়োজন করবে ১৯, ২০ অক্টোবর, ২০১৮ তে। সেখানে একটা সেশন থাকবে নিউরো সাইকিয়াট্রি বিষয়ে। আমার একটা কেইস রিপোর্ট তৈরী আছে। বউকে কিছু না জানিয়ে চুপি চুপি তাদের প্রোগ্রাম ম্যানাজার সারাহ ক্যাথ্রিন কে মেইল করলাম। আমার কেইস রিপোর্ট এর এবস্ট্রাকট পাঠালাম। সেই সাথে অনুরোধ করলাম যে আমরা গরীব দেশের লোক তাই যদি সম্ভব হয় ৫০% ডিস্কাউন্ট এ কনফারেন্স রেজিস্ট্রেশন এবং রেডিসন নারিতা হোটেলে(কনফারেন্স ভেন্যূ) ৫ রাতের থাকার ব্যবস্থা করেন তবে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করছি। ২ দিন পরই মেইলের জবাব আসলো এ রকম, তোমার গবেষণা পত্রটি খুবই গুরুত্বপূর্ন এবং এশিয়ান কালচারে এপিলেপ্সি রোগীদের চিকিৎসায় যুক্ত রাখা খুবই কঠিন একটি কাজ। তুমি দেখিয়েছো কিভাবে কুসংস্কার মুক্ত হয়ে আধুনিক চিকিৎসায় এই রোগীর আরোগ্য লাভ করা সম্ভব। আমরা আনন্দের সাথে তোমার এবস্ট্রাকট রিভিউ কমিটির মাধ্যমে এক্সেপ্ট করেছি এবং সেই সাথে তোমাকে নিউরোসাইকিয়াট্রি সেশনের কি নোট স্পিকার হিসেবে নিবা'চন করলাম। তুমি জানো টোকিও একটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল সিটি তবুও তোমার অনুরোধ রাখতে আমরা ৪০% ডিস্কাউন্ট এ রেজিস্ট্রেশন এবং একোমোডেশনের ব্যবস্থা করছি। এই খবর পেয়ে জাপান ভ্রমণের আগ্রহ আরো বেড়ে গেল। বহিঃবাংলাদেশ ছুটির আবেদন করলাম। ১০ দিনের মাথায় ৭ দিনের ছুটি মঞ্জুর হলো। এবার ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যোগাড়ের পালা। এরই মধ্যে সিলেটের সাইকিয়াট্রিস্ট ডাঃ মোঃ সাইদ ইনাম ভাই এর ফোন পেলাম। উনি বললেন, ওয়েব সাইটে আপনার ছবিসহ ঠিকানা সম্বলিত নাম প্রকাশ করেছে এলাইড একাডেমির টোকিও কনফারেন্স ওরগানাইজিং কমিটির তালিকায়।আপনি কি সত্যিই যাচ্ছেন? আমি বললাম, জ্বি।ছুটি মঞ্জুর হয়ে গেছে। যদি ভিসা পাই তবে যাবো ইনশাআল্লাহ। উনি খুশী হয়ে বললেন তাহলে আমিও যেতে চাই। আমি তাকে উতসাহ দিয়ে বললাম। তাহলেতো খুব ভালো হয়। দুই বাংলাদেশী সাইকিয়াট্রিস্ট একসাথে ঘুরতে পারবো। আমার মতো তাকেও মেইল করতে বললাম। উনিও ৪০% ডিস্কাউন্ট পেলেন। তারও এবস্ট্রাকট এক্সেপ্ট হলো। প্রয়োজনীয় ছুটির ব্যবস্থা হলো। আমার ভিসা আগে হওয়াতে আমি সিংগাপুর এয়ারলাইন্স এ এক্টু আগে ভাগে টিকিট কেটে নিলাম। এইবার পরিবারের সবাইকে বললাম যাচ্ছি জাপান দোওয়া করো। সবাই খুব উতসাহ দিলেন। বউকে এবার সংগে নিতে পারছিনা বলে তার একটু মন খারাপ হলো। ১৫/১০/২০১৮ ভ্রমনের তারিখ ঠিক হলো। ডাঃ সাইদ ইনাম ভাই এর ভিসা পেতে একটু দেরী হওয়ায় তিনি টিকিট কাটলেন থাই এয়ার ওয়েজের। তার ফ্লাইট ২ ঘন্টা পরে তবুও দুইজনে এক সাথেই এয়ারপোর্ট এ পৌছালাম। দুই জনে ২ ঘন্টা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের সিটি ব্যাংক এমেক্স লাউঞ্জে খাওয়া দাওয়া করলাম। আড্ডা দিলাম। কনফারেন্স এবং আনুসঙ্গিক ভ্রমনের পরিকল্পনা করলাম। আমার বিমানে উঠার ফাইনাল এনাউন্স মেন্ট এলো। ঠিক কাটায় কাটায় নিধা'রিত ১১.৫০ মিনিটে সিংগাপুর এয়ারলাইন্স টেক অফ করলো। জানালার পাশে সিট চেয়ে নিয়েছিলাম।পাশের জন যাবেন সিংগাপুর হয়ে অস্ট্রেলিয়া। তিনি চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। সিংগাপুর হয়ে আমি যাবো জাপানের নারিতায়। ৩ ঘন্টা বেশ ভালোই কাটলো। ভদ্রলোক বেশ মিশুক। আমার মতো গল্প করার সংগী পেয়ে সেও খুশী। সিংগাপুর এয়ারলাইন্স এর আতিথেয়তায় আমরা মুগ্ধ হলাম। প্লেন ২৫০০০ ফুট উচুতে উঠার পরই গরম তোয়ালে দিলো এয়ার হোস্টেস। হাত মুখ মুছে বেশ আরাম পেলাম। তার কিছুক্ষণ পরই পিনাট, হালকা পানীয়। ১ ঘন্টা পর ডিনার। চিকেন বিরিয়ানি সাথে ব্রেড এন্ড বাটার, ডেসার্ট। আবারো পছন্দমত পানীয়। খেতে খেতেই দেড় ঘন্টা পার হয়ে গেল। এরপর একটু ঝিমুনী আসলো। আবহাওয়া ভালো ছিল।কোন বড় ধরনের ঝাঁকি অনুভব করলাম না। আধা ঘন্টা পর সুন্দরী এয়ার হোস্টেস এর সুরেলা কন্ঠে ঘুম ভাংলো। এনি টি এর কফি প্লিজ! আমি বললাম কফি। ল্যান্ডিং এর আধা ঘন্টা আগে দিলো আইস্ক্রিম। সিংগাপুর এয়ারলাইন্স এ টাকা একটু বেশী লাগলেও নিরাপত্তা ও আতিথেয়তার কোন ঘাটতি পাইনি। ট্রাঞ্জিট এ সহযাত্রীর সাথে আলো ঝলমলে সিংগাপুরের চাংগি এয়ারপোর্ট এ ফটোসেশন করে তাকে বিদায় দিয়ে হাটা দিলাম নারিটার ফ্লাইট ধরতে। ডিসপ্লেতে আমার ফ্লাইট নাম্বারের সাথে গেট মিলিয়ে নিয়ে সেই দিকে হাটতে থাকলাম। পথে দেখলাম ইলেকট্রনিক মেশিনে পায়ের ম্যাসাজ করছে একজন লোক।

আমি ওকে অনুসরণ করে পা রাখলাম নরম পেডে।

 

দেখে ইন্ডিয়ান মনে হলো। তাকে ইংরেজীতে বললাম পাশের সিটে বসতে পারি। সে বললো বেঠিয়ে। আমাকেও ইন্ডিয়ান মনে করলো হয়তো। চেহারার মিল আছে হয়তো। আমি ওকে অনুসরণ করে পা রাখলাম নরম পেডে। তারপর বাটন চেপে স্টার্ট করলাম। প্রথমে একটু অস্বস্তি এবং ভয় লাগলো। হাটুর নীচ থেকে পিছনের মাংসপেশি এবং পায়ের পাতা কেউ যেন আলতো করে মোচড়াচ্ছে। ২/৩ মিনিট পর কায়দা কানন রপ্ত করলাম। কয়েকধরণ এর ম্যাসেজ আছে। ভাইব্রেশন, হট, মাসল মুভমেন্ট। ১৫ মিনিট ধরে বসে বসে অটো ব্যায়াম করলাম ফ্রি। বেশ ভালো লাগলো। প্লেনে বসে থাকার জড়তা কাটলো। পায়ের ব্যথাও কমে গেল।খুধা নেই। এদিকে সিংগাপুর এ তখন সকাল ৮ টা। ব্যাগে একটা স্নিকার চকলেট ছিল তাই দিয়ে নাস্তা সারলাম।এয়ারপোর্ট এ ফ্রি পানি আমার ব্যাগে রাখা খালি বোতলে ভরে নিলাম। সকাল ৯ টায় নারিতার উদ্দেশ্যে প্লেনে উঠলাম। সিংগাপুর এয়ারলাইন্স এ যদিও খাওয়া দাওয়ার অভাব নেই কিন্ত এবারের জানি' ৬ ঘন্টা ৩০ মিনিটের। জীবনে প্রথম বিমানে লম্বা পথ যেতে হবে।৩ ঘন্টা পর পা ব্যথা শুরু হলো। আর ভাল্লাগে না। উঠে পড়লাম সিট থেকে পাশে একজন জাপানি আংকেল। এবার আমি মাঝের সিটে। তাকে এক্সকিউজ মি বলতেই সে মাথা ঝাকিয়ে আমার বের হওয়ার ব্যবস্থা করে দিলো। আমি ৫ মিনিট বিমানে পায়চারী করলাম। ওয়াসরুমে গেলাম। তাতে একটু ভালো লাগলো। সিটে বসে সামনের স্ক্রিনে একটা ইংরেজি মুভি দেখলাম ২ ঘন্টা তাও সময় কাটেনা। জাপানি আংকেল দেখি ল্যাপটপে একটা প্রেজেন্টেশন ঠিক ঠাক করছে। তাঁর সাথে আলাপ করে বুঝলাম উনি সেন্সাই(অধ্যাপক), বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ান। সিংগাপুর এ কনফারেন্স এ লেকচার দিতে গিয়েছিলেন। আমার জাপান যাওয়ার উদ্দেশ্য শুনে আরিগাতো ( অনেক ধন্যবাদ)বললেন। বার বার মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মান জানালেন। আমিও চেস্টা করলাম তাঁকে ইংরেজিতে। ঘোষনা এলো সিট বেল্ট বেধে ফেলুন কিছুক্ষণের মধ্যেই নারিতা বিমান বন্দরে প্লেন ল্যান্ডিং করবে....

দুই
___________________________


নারিতা এয়ারপোর্টে নেমেই একটা অদ্ভুত বিষয় খেয়াল করলাম যে এয়ারপোর্ট উপরে, নীচে রেল স্টেশন। আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল মামাতো ভাই রাব্বির সাথে যে টোকিওতে চাকুরী করে প্রায় ৩ বছর ধরে, সে আমাকে রিসিভ করবে। টারমিনাল -১, তো বিশাল এলাকা। কোথায় সে আছে সেটা জানার জন্য এয়ারপোর্ট ওয়াইফাই সংযোগ এর চেস্টা করতেই পেয়ে গেলাম নেট। মনে সাহস এলো। ওকে অন লাইনে পেয়ে গেলাম। অডিও ফোন দিলাম। সে খুশীতে জিজ্ঞেস করলো ভাই কোথায়? আমি বললাম, আমি নারিতা এয়ারপোর্ট এর টারমিনাল ১ এর ইনফরমেশন ডেক্সের পাশেই দাঁড়িয়ে আছি। তুমি? সে বললো, ভাই ওখানেই থাকেন। আমরা কাছেই আছি। ২/৩ মিনিট অপেক্ষা করুন প্লিজ। আমি বললাম আমরা মানে? সে বললো আপনার বন্ধু ডাক্তার সাঈদ ইনাম ২ ঘন্টা আগে থাই এয়ার ওয়েজে পৌছেছে। সে আমার সংগেই আছে। এই কথা শুনে আরো খুশী হলাম। ঢাকা থেকেই আমরা দুইজন আলাদা হয়ে গিয়েছিলাম। কথা শেষ হতে না হতেই রাব্বির ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম। সাথে দেখলাম ডাঃ সাঈদ এনাম এবং ওর শ্রীলংকান এক বন্ধু। আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো।বললো, ভাই কতোদিন পর কাছের মানুষ দেখলাম! ১৬/১০/১৮ তারিখ তখন সন্ধ্যা ৬ টা বাজে। এবার বের হলাম রেডিসন হোটেলের সাটল (ফ্রি) বাস ধরার জন্য। বাইরে বের হয়ে কন কনে শীতের ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগলো। এয়ারপোর্ট গেটের পাশেই দেখলাম ৩ টা লেন। একটা দিয়ে এয়ারপোর্ট ট্রান্সপোর্ট বাস যাচ্ছে। একটা দিয়ে প্রাইভেট কার যাচ্ছে। অন্যটা দিয়ে ট্যাক্সি যাচ্ছে। কোন গাড়ীর শব্দ নেই। নেই কোন যানজট। আমরা বাসের লেনে দাড়ালাম। আগেই শুনেছিলাম জাপানে ট্যাক্সি ভাড়া অনেক বেশী। আধা ঘন্টার রাস্তা যেতে প্রায় ৩ হাজার বাংলাদেশী টাকার মতো লাগে। ৫ মিনিট পর পর বিভিন্ন হোটেলের নাম লেখা সাটল বাস আসছে, সংগে সংগে ড্রাইভার সাহেব নেমে সেই হোটেলের ইংরেজি এবং জাপানি ভাষায় নাম লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে যাত্রী খুজে বাসে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নেই কোন হেলপার। ড্রাইভার সাহেবরা প্রায় সবাই বৃদ্ধ, বয়স ৬০-৭৫ বছর। তাঁরা এখনো সতেজ, পরিশ্রমী, বিনয়ী। যাত্রীদের লাগেজ তুলতেও সাহায্য করছেন তাঁরা। মাথা বো করে বার বার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন। বিদেশী যাত্রিরা থ্যাংকু বলতেই তাঁরা বলছেন, আরিগাতো গোজাইমাছ! এসব দেখতে দেখতে আধা ঘন্টা পর আমাদের রেডিসন নারিতা হোটেলের সাটল বাস আসলো। আমরা উঠে পড়লাম। গাড়ি যাচ্ছে উচু নিচু পথ বেয়ে।

রেডিসন নারিতা হোটেল টি গাছ পালায় ঘেরা সু শোভিত

 

রাস্তার দু ধারে অনেক নাম না জানা গাছপালা। রাব্বিকে জিজ্ঞেস করলাম এটাই কি টোকিও শহর? আমার কাছে তো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে? সে বললো ভাই, আপনারাতো চিবা এলাকায় আছেন। এটাতো গ্রাম। টোকিও এখান থেকে এক ঘন্টার পথ। সেখানে হাই রাইজ বিল্ডিং বেশী। আমাদের হোটেলে আসতে আধা ঘন্টা লাগলো। রেডিসন নারিতা হোটেল টি গাছ পালায় ঘেরা সু শোভিত, পরিপাটি করে সাজানো একটি ফোর স্টার হোটেল। রিসিপশনে দেখলাম ২ জন জাপানিজ মেয়ে এবং একজন শ্রীলংকান ছেলে ডিউটিতে আছে। আমরা মাঝের জাপানী মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেলাম। তাঁকেই বস মনে হলো। সে সুন্দর হাসি দিয়ে ইংরেজীতে জিজ্ঞেস করলো? রিজাভেশন আছে কিনা। আমরা আমাদের কাগজপত্র দেখালাম। পাসপোর্ট এর ফটোকপি রেখে দিয়ে বললো। সাইন হেয়ার এন্ড গিভ ইউর ই মেইল এড্রেস প্লিজ! শ্রীলংকান ছেলেটি আমরা বাংলাদেশী জেনে খুব উচ্ছসিত হলো। সে দুই গ্লাস ফলের শরবত হাতে নিয়ে এসে বললো, স্যার, হেভ ইউর ওয়েলকাম ড্রিংক। আমরা গলা ভিজিয়ে নিলাম। তারপর হোটেলে লাগেজ রেখে হাতমুখ ধোয়ে তাড়াতাড়ি রাব্বিদের সাথে বেড়িয়ে পড়লাম রাতের খাবারের সন্ধানে।
চলবে...
______________________

ডা. মোহাম্মদ জোবায়ের মিয়া
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
মনোরোগ বিভাগ
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর।

আপনার মতামত দিন:


ভ্রমণ এর জনপ্রিয়