Ameen Qudir

Published:
2016-12-09 23:19:30 BdST

মোহিনী মালদ্বীপ : এক বাঙালি রবিনসন ক্রুসোর দিনলিপি



ডা. মোরশেদ হাসান
____________________________

 

গতকাল রাতে প্লেনে মালে থেকে ইফুরু এয়ারপোর্টে এলাম। গন্তব্য আমার কর্মস্থল রাজগিথিম আইল্যান্ড। প্লেনটি ছিল ডমেস্টিক প্লেন। আকারে অনেক ছোট। সমস্যা দেখা গেল লাগেজ নিয়ে। আমি দেশ থেকে যে লাগেজ নিয়ে এসেছি এবং এর যে ওয়েট তা এই ডোমেস্টিক প্লেনের জন্য প্রযোজ্য নয়। অতিরিক্ত ওয়েট হলে জরিমানা দিতে হবে বা মাল ফেলেও যেতে হতে পারে । আমি এমনিতেই ঘরকুনো মানুষ। তার ওপর আবার এই ধরনের বিষম পরিস্থিতিতে পড়লে কুলকুল করে ঘামতে শুরু করি। যা-ই হোক কুলকুল করে ঘেমে নেওয়া

সারা হলে অভিজ্ঞ মানুষের পরামর্শ নিলাম। পরামর্শটি ছিল "বি কুল"। আমি বিস্মিত হয়ে ভাবলাম কুলকুল করে ঘামার ভয় থেকে বাঁচতে আবারও সেই 'কুল' শব্দের শরণাপন্ন হওয়া!

যা-ই হোক গোলাম হোসেনদের যে উপায় নেই সে তো ইতিপূর্বেই বলেছি। এয়ার পোর্টে লাগেজের ওজন নিতে গিয়ে অফিসারের প্রশ্নবোধক দৃষ্টি দেখে আমি মধুর হাসি দিলাম। কিন্তু আমার মধুর হাসিতে মিছরি গলার কোনো লক্ষ্মণ দেখলাম না। তখন শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করলাম ঠোঁটের কোণে বিলীয়মান মধুর হাসির অবশিষ্টাংশ বহুকষ্টে ধরে রেখে বললাম,

স্যার, একটুয়ালি আই এম নিউ ইন ওভারসিজ ট্রাভেলিং। আই এম ক্যারিং সো ম্যানি বুকস।

অফিসারের মন গলল বলে মনে হলো না। সে নির্বিকারভাবে বলল, আই ক্যান্ট ডু এনিথিং।
অফিসারের কথা শুনে আমার এতক্ষণ কষ্ট করে ধরে রাখা মধুর হাসি ততক্ষণে বিকৃত রূপ নিতে শুরু করেছে।
তবু হাল ছাড়লাম না। সন্যাসীসুলভ প্রচেষ্টায় অফিসারের চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে বললাম,
- স্যার, আই হ্যাভ সো ম্যানি বুকস উইথ মি রিগার্ডিং মেডিক্যাল সায়েন্স। ইফ ইউ এলাউ মি টু টেইক…।
অফিসারের মুখের কাঠিন্য দেখি কমতে শুরু করেছে।
-- ওকে লেট মি সি হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ। বাট ইউ হ্যাভ টু পে সাম ফর ওভার ওয়েট।

ওভার ওয়েটের জরিমানা দিতে গিয়ে দেখলাম এটা মাত্র ৯০ রুফিয়া অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় ৪৫০ টাকা। আগে যে কোনো বিপদ দেখলে কুঁকড়ে যেতাম। এখন দেখি আরে বাপ!যত মুশকিল তত আসান।

ডোমেস্টিক ফ্লাইটের জন্য ছোট প্লেন। জার্নিও নাতিদীর্ঘ। চল্লিশ মিনিট। প্লেন যখন আকাশে তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। সিট বেল্ট বেঁধে নিয়েছি আগেই। ভাগ্য ভালো আমার সিটটা ছিল উইন্ডোর পাশে। ডোমেস্টিক প্লেন খুব বেশি ওপর দিয়ে ওড়ে না। প্লেনের জানালা দিয়ে আমি পাখির দৃষ্টিতে নিচে তাকালাম। গাঢ় অন্ধকার। আমি জানি নিচে ভারত মহাসাগরের অথৈ পানি। মালার মতো অসংখ্য দ্বীপ পানির বুকে জেগে আছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম বিয়েবাড়িতে গাছকে যেমন আলোকশয্যায় সজ্জিত করা হয় তেমনি কিছুক্ষণ পরপর সোডিয়াম লাইটের আলোয় ভেসে যাওয়া দ্বীপগুলোকে একছড়া হীরার হারের মতো মনে হচ্ছে। অন্ধকারে যেন কোনো রাজকন্যার গলায় জ্বলজ্বল করে দ্যুতি ছড়াচ্ছে।
মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিলাম। ঘোর ভাঙলো এনাউন্সমেণ্টে।
অ্যাটেনশন প্লিজ উই আর নিয়ার টু ইফুরু। প্লিজ ফিক্সড ইয়োর সিট বেল্ট।
প্লেন থেকে নামতেই দেখি আমাকে রিসিভ করতে হাসপাতালের একদল কর্মী অপেক্ষারত। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে চারপাশে তাকাতে তাকাতে যাচ্ছিলাম।

চারদিকে সারি সারি নারকেল গাছ। এয়ার পোর্টের পিচঢালা হাইওয়ে বনের ভেতর দিয়ে চলে গেছে। কোনো সিকিউরিটি গার্ড বা পুলিশ দেখলাম না। শুনলাম এখানে নাকি কোনো ক্রাইম নেই। অতএব সিকিউরিটির অত বালাই নেই। এয়ারপোর্টের শেষ মাথায় আবার সাগর। সেখানে বেশ বড় একটা স্পিডবোট বাঁধা আমার জন্য। সিটে বসলাম। আকাশভরা তারার নিচে গহীন সাগরের বুকে উথাল-পাথাল ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্পিডবোট চলা শুরু করল।
প্রথমে স্পিডবোট এসে থামল আঙ্গুফারো দ্বীপে। এখানে রিজিওনাল হসপিটাল আছে। স্পিডবোট থেকে নামতেই দেখলাম মেডিসিন স্পেশালিস্ট ডা. প্রকাশ দাঁড়িয়ে আছেন। ভদ্রলোক ভারতীয় ডাক্তার। তিনি আন্তরিকভাবে হাত বাড়িয়ে আমার সঙ্গে করমর্দন করে কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। আঙ্গুফারোতে এলাম নয় জুলাই। সে রাতটি কাটিয়েছিলাম হাসপাতালের ডাকবাংলোতে।


পরদিন বিকালে আমাকে নিয়ে স্পিডবোট আবার যাত্রা শুরু করল সাগরপথে। এবারের গন্তব্য আমার কর্মস্থল রাজগিথিম আইল্যান্ড।
যখন দ্বীপে এসে স্পিডবোট থামল তখন সন্ধ্যা হয় হয়। আমাকে রিসিভ করার জন্য হেলথ সেন্টারের ম্যানেজার, দোভাষী ও ড্রাইভার অপেক্ষায় আছেন। পাশেই ঝকঝকে একটি অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়ালো একটি প্রাচীরঘেরা বাসার সামনে। নামতে হল। বুঝতে পারলাম এটিই আমার নতুন বাসস্থান। শুরু হল আমার নতুন জীবন। তখন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনীভূত হয়ে এসেছে। ড্রাইভার লতিফ আমার মালপত্র বাসায় তুলে দিল। আন্তরিক ধন্যবাদ জানালাম তাঁকে। লতিফ চলে যাওয়ার পরেই আমি সত্যিকারের অথৈ সাগরে পড়লাম। গতকাল গভীর সাগরে প্রবল ঝড় উঠেছিল। সে মুহূর্তে ক্রুরা আমাকে কেবিনের ডকে নিয়ে যায়।
সাগরের উথাল-পাথাল ঢেউ দেখে সে মুহূর্তে ততোটা অসহায় বোধ করিনি। বরং অবাক দৃষ্টিতে সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব বিস্ময়লীলা দুচোখ ভরে দেখে নিয়েছিলাম। এই পৃথিবীতে কার ভয় যে কীসে এ সত্যি এক আশ্চর্য বিষয়।

রাতে খাবার খেতে দ্বীপের একমাত্র রেস্টুরেন্টে গেলাম। গাছের পাতায় ছোট ছোট বিদ্যুৎ বাতির আলোয় চমৎকারভাবে সজ্জিত রেস্টুরেন্টটি। বাশমতি চালের ফ্রাইড রাইস ও অমলেট দিয়ে ডিনার।
ফের ফিরে এলাম কোয়ার্টারে। পুরো দ্বীপে শুনশান নির্জনতা। রেস্টুরেন্ট থেকে আসার সময় একটি শিশুকে পর্যন্ত রাস্তায় দেখলাম না। একটি শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনলেও মনে হতো জগতের মধুরতম সংগীতের মূর্ছনা শুনলাম। শূন্য ঘরে একা একা বসে রইলাম। টিভি আছে, চালাতে ইচ্ছে করল না। একফাঁকে উঠে বাসার আসবাবপত্র দেখলাম। ওয়াশিং মেশিন আছে কি না দেখলাম। রান্নাঘরে গেলাম। মনটা ফাঁকা হয়ে গেল। এ রান্নাঘর দিয়ে আমি কী করব? ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। কীভাবে কীভাবে যেন সিলিন্ডারের গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে এক কাপ কফি বানালাম।
কফির মগ হাতে নিয়ে বিছানায় বসে ধীরে ধীরে চুমুক দিই। চারদিকে ভয়াবহ নির্জনতা। চারপাশের নির্জন অন্ধকার রাতের প্রহরের সংগে পাল্লা দিয়ে জমাট বাঁধে। কখন যে দুচোখের পাতা বন্ধ হয়ে এল জানি না।

জানালার গরাদ ভেদ করে ভোরের মিষ্টি আলোর রশ্নি চোখে পড়তে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। চোখেমুখে জল দিয়ে বারান্দার কপাট খুলে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। ভোরের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। রাস্তায় একটি মানুষও নেই। এ কেমন আইল্যান্ড!
দুপা এগোলেই সাগর। হেঁটে হেঁটে চলে এলাম। দূর সাগরের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। আদিও নেই অন্তও নেই।

এ নির্জন দ্বীপে আমাকে থাকতে হবে! কেন আমি কি রবিনসন ক্রুসোর ছোট ভাই?
দূর সাগরের পানি আমার চোখে টলমল করে ওঠে। রবিনসন ক্রুসো নাকি ডায়েরির পাতায় দাগ কেটে বছরের হিসেব রাখত, আমি হৃদয়ের শূন্য পাতায় রেখা টেনে দিনের সময় রাখি।
সে কবে আসবে? তার মৃদু পায়ে হেঁটে আসার মূর্ছনায় আমার হৃদয়ের শূন্য ঘরটি এক লহমায় হেসে উঠত।

_______________________

 

লেখক ডা. মোরশেদ হাসান ।
Works at Medical College, Assistant Professor.
Past: Works at Ministry of Health, Maldives and ICDDR,B

আপনার মতামত দিন:


ভ্রমণ এর জনপ্রিয়