SAHA ANTAR
Published:2023-12-06 13:27:55 BdST
"আমি যেখানেই যাই না কেন, আমার চোখ সবসময় পুরুষলোকের প্রাইভেট পার্টের দিকে চলে যায়"
প্রফেসর ডা. সুলতানা আলগিন মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ, কনসালটেন্ট ওসিডি ক্লিনিক এবং জেরিয়াট্রিক ক্লিনিক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় , ঢাকা
প্রফেসর ডা. সুলতানা আলগিন
মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ,কনসালটেন্ট ওসিডি ক্লিনিক এবং জেরিয়াট্রিক ক্লিনিক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় , ঢাকা
________
একজন ভদ্রমহিলা বয়স ৫৬। সাথে মেয়ে নিয়ে চেম্বারে এসেছেন। মেয়ের বয়স ২৩-২৪ হবে । জিজ্ঞাসা করলাম সমস্যা কার? মেয়ে বলল আমার মায়ের। মেয়েটি নিজে থেকেই বলল আপনার সাথে আমার মা একা কথা বলবেন। আমি বললাম ঠিক আছে। তুমি বাইরে গিয়ে বস । এরপর ভদ্রমহিলা বললেন মেয়েটাতো বড় হয়ে গেছে । ওর সামনে এসব কথা বলতে অস্বস্তি লাগে। তাই সময় চেয়ে নেয়া আর কি।
আমি বললাম আপনি ধীরে সুস্থে নিশ্চিন্তে বলতে পারেন।
বলতে শুরু করলেন তিনি।
কি ভাবে যে বলব ! তারপর বললেন আমি যেখানেই যাই না কেন আমার চোখ সবসময় পুরুষলোকের প্রাইভেট পার্টের দিকে চলে যায়। যতই অস্বস্তি লাগুক না কেন আমি চোখ সরাতে পারি না। এমন কি ছোট ছেলে বাচ্চাদের প্রাইভেট পার্টেও দিকে নজর চলে যায়। আমার এই যে মেয়েটা দেখলেন ,ওর ছোট ছেলে মানে আমার নাতির দেখভাল আমারই করতে হয়। নাতিকে রেখে মেয়ে ক্লাশে যায়। সারাদিন আমার সাথেই থাকে। ওর দেখভাল আমিই করি। কিন্তু আমার এই সমস্যার জন্য আমার আপনার কাছে আসা। মেয়ের বা অন্য কারো সাথে যে সমস্যাটা শেয়ার করবো তাও পারছি না।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম এসই সমস্যা কতদিন ধরে? উনি বললেন ৪-৫ বছর ধরে। তবে আগে থেকে আমার ভিন্ন সমস্যা ছিল।
প্রশ্ন করলাম, কি রকম ?
বললেন আমি রাস্তা দিয়ে যখন যাই তখন মানুষের চোখের দিকে আমার চোখ চলে যায়। তখন আমি যদি কোনরকম অস্বস্তি অনুভব করি তখন বার বার ঐ লোকটির চোখের দিকে চেয়ে দেখি। কি আছে চোখটাতে? লোকটার তাকানোতে কি সমস্যা ছিল? ওরকম করে কেন তাকালো? ফালতু ফালতু সব চিন্তা এসে ঐ সময়টা আমার মাথা ভারী করে ফেলে। রাস্তার পাগল দেখলেও আমার অদ্ভুত চিন্তা আসে। তার ডান হাত হয়তোবা চোখে পড়ল । বাঁ হাত না দেখা পর্যন্ত আমার মনে সব আতংক ভর করে। মনে হয় খারাপ কিছু ঘটবে। আমি ডানেবামে পিছনে ফিরে যেভাবেই হোক আরেকটা হাত দেখার চেষ্টা করি। অনেক সময় নেমে গিয়ে দেখে আসি। যেদিন দেখতে না পারি মনের মধ্যে যে ভয় ঢুকল তা কাটাতে খুব কষ্ট হয় আমার।
আপনি আমার হিজাব দেখে বুঝতে পারছেন আমি মুসলিম। তবে আমি গোরা ধর্মান্ধ না। সব ধর্মের লোকের সাথে আমার উঠাবসা করতে কোন সমস্যা হয় না। কিছু শব্দ যেমন নিমন্ত্রণ ,অতিথি, জল, পোষাক,ক্ষমা -- এসব শব্দকে কেমন যেন হিন্দু হিন্দু মনে হয়। অথচ ব্রেকফাষ্ট,গেষ্ট বললে এমনটা লাগে না।
আমি একটু অবাক হয়েই তাকালাম উনার দিকে।
উনি বললেন কেউ যদি এইসব শব্দ বলে তাহলে বিরক্ত লাগে। আমি বুঝি এতে বিরক্ত হওয়ার কিছু নাই।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম শব্দের আবার কি ধর্ম? ধর্ম কর্ম মানুষের সৃষ্টি । জীবনযাপনের জন্য। কিন্তু শব্দের কি দোষ?
উত্তরে জানালেন আমার অস্বস্তি লাগে। আমি এসব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। এমনকি কোন মুসলিমের বাসায় মূর্তি, মুখোশ দেখলেও আমার বিরক্ত লাগে। এসবের দিকে চোখ গেলে ক্ষতি হবে - এই অহেতুক চিন্তা তখন মনে আসে। অথচ আমি বুঝি এসব উনারা শখ করে এসব কিনেছেন সুন্দর করে ঘর সাজিয়েছেন।
ম্যাডাম আরেকটা বড় সমস্যা আছে। আমি অনেকের চাইতে বেশী পরিষ্কার। মেয়ে ওর বাবা আমার আত্মীয়স্বজন সবাই বলে। এটা এতদিন আমার কাছে কোন সমস্যা মনে হয় নাই। আমার বোন থাকে দেশের বাইরে। সেখানে যাবো। পাসপোর্ট করেছি। আসার সময় একটা কাগজ উড়ে গিয়ে রাস্তায় কুকুরের পায়খানার উপর পড়ে। সেটা তুলে নিয়ে আমার স্বামী ঝেড়েমুছে পাসপোর্টেও মধ্যে ঢুকিয়ে রাখে। কাগজটা পরে নাকি লাগবে। বাসায় গিয়ে কি যে হলো পাসপোর্ট থেকে শুরু করে সেটা যেখানে রাখা হয়েছিল সবকিছু ধুতে শুরু করলাম। সবাই রাগারাগি শুরু করে দিল। আমি বিদেশে কিভাবে যাবো ? পাসপোর্ট এর চেহারাতো চেনা যায় না। পানি লেগে কোথাও কোথাও লেখা উঠে গেছে। পাতাগুলো মোটা হয়ে গেছে। আমার ভিতরে কেমন যে অশান্তি লাগে আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না।
ভদ্রমহিলা বললেন এখন যেভাবেই হোক আমার নিজের সমস্যার জন্য পরিবারের অশান্তি করতে চাই না। আমার সুস্থ হওয়া দরকার । শুনেছি চিকিৎসা নিলে ভাল হওয়া যায় । তাই আপনার কাছে আসা।
আমি বললাম ঠিকই শুনেছেন। আপনার রোগটির নাম ওসিডি। এটা একটা মানসিক রোগ। আগে আপনার জানা দরকার কেন হয়।
এতে আপনার কোন দোষ নেই। ব্রেনের কর্টিকো-স্ট্রায়েটো-থেলামোকর্টিকাল লুপের/সার্কিটের কাজে অসামঞ্জস্য থাকায় এই সমস্যা মানুষের মনের মধ্যে দেখা দেয়। নিউরোট্রান্সমিটার সিরোটনিন,ডোপামিন,গ্লুটামেট কমবেশি হয়। যাদের এই লুপের কাজ স্বাভাবিক তারা এই ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। কারণ নিউরোট্রান্সমিটার তাদের ব্রেনে স্বাভাবিক মাত্রায় আছে।
আরও বললাম--
ওষুধগুলো অনেকদিন/বছর খেতে হবে। কিছুদিন পর যখন লক্ষণগুলো সহনীয় মাত্রায় আসবে তখন ওষুধ বন্ধ করা যাবে না। আস্তে আস্তে ওষুধের ডোজ কমাতে হয়। ধৈর্যহারা হবেন না। এসব ওষুধ বেশ ধীরে কাজ করে। সময় লাগে। যেহেতু নিজেই চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেছেন ,আপনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হবেন আশা করি। উনার মেয়েকে ডেকে বললাম তোমার মায়ের চিকিৎসার জন্য তোমাদের সহযোগিতা দরকার। ওষুধ চলুক । ফলোআপ ঠিকমত করবে।
বর্তমানে ওসিডির খুব ভাল কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ওষুধ বাজারে পাওয়া যায়।ওষুধ নিয়মিত খাওয়া জরুরী। সুস্থ থাকতে এর কোন বিকল্প নেই। পাশাপাশি কাউন্সেলিং নেয়া যেতে পারে। মোবাইল ব্যবহার যত কম করা যায়। ঘুমের আগে একেবারেই নয়। দিনে দুই থেকে আড়াই লিটার পানি খাবেন। রাতে ৬-৭ঘন্টা ঘুমাবেন। কোল্ড ড্রিংকস ,ফাস্ট ফুড সহজে খাবেন না। শাকসব্জি দেশীফলমূল সালাদ খাবেন।
আপনার মতামত দিন: