SAHA ANTAR

Published:
2023-12-23 08:29:25 BdST

ওসিডি ডায়েরি নতুন পর্ব " তুই বাথরুমে গেলে তোর ক্ষতি হবে,ছেলেমেয়েকে জবাই করে কোরবানী দিতে হবে"


প্রফেসর ডা. সুলতানা আলগিন মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ,কনসালটেন্ট ওসিডি ক্লিনিক এবং জেরিয়াট্রিক ক্লিনিক, প্রধান, সাইকোথেরাপি উইং, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় , ঢাকা

 

প্রফেসর ডা. সুলতানা আলগিন

মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ,কনসালটেন্ট ওসিডি ক্লিনিক এবং জেরিয়াট্রিক ক্লিনিক, প্রধান, সাইকোথেরাপি উইং,

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় , ঢাকা
---------------------------------
ভদ্রমহিলার ৪৮ বৎসর বয়স। সাথে মেয়ে ২জন এসেছে। উনার বড় মেয়ে বলছিল যে ইদানিং তার মা বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। মেয়ে কথার সূত্র ধরে তিনি বললেন যে, তরকারিতে লবণ বুঝি না, কতটুকু রান্না করব তার পরিমাণ আন্দাজ করতে পারি না, কোথাও যেতে এমনকি গোসলের পরে কি পরব সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। বাইরে বের হতে পারি না।
গত ২০-২২ বছর যাবৎ তার এই সমস্যা। চিকিৎসা নেওয়া হয় নি। তারা জেনেই এসেছে যে তার মা অবসেসিভ কম্পালসিভ বা শুচীবাই রোগে ভুগছেন। এখন সমস্যা প্রকট হওয়াতে উনি আসতে রাজী হয়েছেন। মেয়েরা বলছিল যে, আমার মা আমাদের শীত গ্রীষ্মবর্ষা কোন কিছু মানতেন না। আমাদের ছাদে একবার গোসল করানোর পর আবার ঘরের ভেতর নিয়ে গোসল করাতো। আমাদের ২ সেট করে বই থাকতো। একটা সেট বাসায় পড়ার জন্য অন্যটা স্কুলে কোচিংএ নিয়ে যাওয়ার জন্য। স্কুলের ব্যাগ নিয়ে কখনোই বাসার ভেতর ঢুকতে পারতাম না। পাশের বাড়ীর কুকুর দেখলে পুরো ঘর মোছা শুরু করতেন।
তাকিয়ে দেখি মায়ের চেহারায় দুঃখী অপরাধী ভাব । নিজের দোষ ঢাকবার জন্য অনেক রকম অজুহাত খুঁজছিলেন। বললেন, আমার বাচ্চারা অনেক কষ্ট পেয়েছে। আমি ওদের সাথে অনেক অত্যাচার করেছি।

ওদের বাবাও আমার ওপর প্রচন্ড বিরক্ত। নিতান্ত ভদ্রলোক বলে এখনও আমরা একসাথে আছি।

ভদ্রমহিলা বলছিলেন কেউ মোবাইলে কথা বললে আগে তিনি মোবাইলটা পানি দিয়ে মুছে নেবেনই। উনার মনে হয় স্পীকার দিয়ে নাপাক জিনিস ঘরে ঢুকে পড়বে। কেউ অামাকে হাজার বুঝিয়ে বললেও আমি নিজেকে মানাতে পারতাম না। পাশ থেকে মেয়ে ফোড়ন কাটে। বলে, এসব নিয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের বাসায় নাটক চলে। একরুম থেকে আরেক রুমে মায়ের চোখের আড়ালে গিয়ে সবাই কথা বলে। রীতিমত হাইড এন্ড সিক খেলা। দুইমেয়ে একসাথে হেসে উঠল।

এরপর আরেক মেয়ে বলল যে, ওর মা একা হলেই হাত পা ঘাড় নাড়াচাড়া করতে থাকে। ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞাসা করলাম কেন করেন? উত্তরে উনি জানালেন তার মনে যতসব অদ্ভুত বাজে চিন্তা আসে। সেই চিন্তাগুলো সরানোর জন্য এমন করি।
আমি জানতে চাইলাম সব চিন্তা খুলে বলেন। একটু অস্বস্তি বোধ করলেন মনে হলো । সাহস দিয়ে বললাম আপনি মন খুলে বলেন। এত আপনার কোন ক্ষতি হবে না। এটা আপনার রোগ। ডাক্তারের সাথে শেয়ার না করলে আপনার চিকিৎসা ঠিকমত হবে না।

এরপর অস্বস্তি কাটিয়ে উনি বললেন মনে চিন্তা আসে যে চুলের আগা কাটলে ওর বাবার ক্ষতি হবে। বাথরুমে গেলে সন্তানদের ক্ষতি হবে। ছেলেমেয়ে, আপনজনদের কোরবানী দিতে হবে। ছেলেমেয়ের চেহারা ভেসে ওঠে। প্রচন্ড কান্না পায়। একা একা কেঁদে ভাসাই। কিন্তু খারাপ চিন্তা যায় না।
কেউ যেন বার বার বলে,
" তুই বাথরুমে গেলে তোর ক্ষতি হবে,ছেলেমেয়েকে জবাই করে কোরবানী দিতে হবে"।

তখন এই ওলটপালোট ভাবনাগুলো সরানোর চেষ্টা করি। ঘাড় হাত পা নাড়িয়ে চিন্তাভাবনাগুলো সরাতে চাই। এসব করতে করতে আমি ক্লান্ত। আমার ঘাড় হাত পায়ে এখন প্রচন্ড ব্যথা। যখন আর পারি না তখন রান্নাঘরে গিয়ে তরকারীগুলোর ওপর পোচ দিতে থাকি। কুচাতে শুরু করি। কোরবানির দেওয়া সেখানেই সারি।
আরও বললেন হঠাৎ করে চোখের সামনে ২টা রং আসে। রং দুইটার ইনটেনসিটি মেলাতে মেলাতে আমার সময় লেগে যায়।
আমি প্রশ্ন করলাম কি রং? আর কেনইবা মিলাতে হবে?
উনি বললেন যে কোন রং। ইনটেনসিটি মেলাতে না পারা পর্যন্ত আমি জায়গা ছেড়ে উঠতে পারি না। আমাকে মিলাতেই হবে। নতুবা আমার সন্তানদের ক্ষতি হবে -- ভাবনাটা মনের মধ্যে গেঁথে বসে। আর মা হিসেবে আমিতো তা করতে পারি না।

মায়ের দুরাবস্থার কথা শুনে তাঁর মেয়েও দেখি কাঁদছে।

এসবই হলো রোগীর একমাস আগের বক্তব্য। ওষুধ পত্র প্রেসক্রিপশন দেওয়া হল। পরের বার যখন মা-মেয়েরা আসল জিজ্ঞাসা করলাম কেন আছ তোমরা?

মেয়েরা হেসে উত্তর দিল হাইড এন্ড সিক খেলা অনেকখানি কমেছে। আমাদের সাথে যে রাগারাগি করতেন তা কমেছে। বাবার সাথে মায়ের সম্পর্ক আগের থেকে কিছুটা হলেও ভালো। ভদ্রমহিলার চোখমুখের স্বস্তি আমারও ভাল লাগল।

বললাম আপনার রোগটাতো অনেক বছরের। চিকিৎসাও শুরু করেছেন দেরীতে। তারপরও এইটুকু বুঝতে পারছি যে ওষুধগুলো যা আপনাকে আমি প্রেসক্রাইব করেছিলাম তা আপনি গত একমাস ধরে নিয়মিত খেয়েছেন বলেই এই উন্নতিটুকু হয়েছে। এইরোগের চিকিৎসা চলবে বেশ ক বছর। ওষুধ বন্ধ করা যাবে না। এখন কিছুটা ভাল বোধ করছেন বলে নিজের মতো কিছুদিন পর ওষুধ বন্ধ করে দিলেন। এটা ভুলেও করবেন না। একবেলা খাবার খাওয়া বাদ গেলেও ওষুধ বাদ যেন না যায়। কোন সমস্যা অনুভব করলে তা জানাতে ভুল বা দেরী করবেন না।

যে কোন অপারেশনের সেলাই শুকাতে কমপক্ষে সপ্তাহ দুই সময় লাগে। ব্রেনের কর্টিকো-স্ট্রায়েটো-থেলামোকর্টিকাল লুপের/সার্কিটের কাজে অসামঞ্জস্য থাকায় এই সমস্যার সৃষ্টি হয়। নিউরোট্রান্সমিটার সিরোটনিন, ডোপামিন, গ্লুটামেট কমবেশি হয়। যাদের এই লুপের কাজ স্বাভাবিক তারা এই ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। এসব খালি চোখে দেখা যায় না। কোন পরীক্ষা নিরীক্ষাও নাই যা আপনাকে করতে বলব। এই সার্কিটের হিলিং হতে অনেক সময় লাগে । প্রত্যেক রোগীর ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা সময় লাগে। তাছাড়া যার মনের জোর যত বেশী তার উন্নতিও তত দ্রুত হয়। তাছাড়া পরিবারের সকলের সহায়তা সাহচার্য আপনাকে সাহায্য করেছে। তাই আমি আপনাকে এবং আপনার পরিবারের সকলকে ধন্যবাদ জানাই ।

সবশেষে বলি দিনে দুই থেকে আড়াই লিটার পানি খাবেন। রাতে ৬-৭ঘন্টা ঘুমাবেন। কোল্ড ড্রিংকস, ফাস্ট ফুড সহজে খাবেন না। শাকসব্জি দেশীফলমূল সালাদ খাবেন। মেয়েরা শোন এটা শুধু তোমার মার জন্য নয় । সুস্থ থাকতে এগুলো প্রত্যেকটি মানুষের করণীয়।

আপনার মতামত দিন:


মন জানে এর জনপ্রিয়