Saha Suravi

Published:
2023-11-17 10:21:27 BdST

ওসিডি ডায়েরি : নতুন এপিসোড ২"শ্বাস প্রশ্বাস নিতে গেলে মনে হয় আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি: পেটে বুকে নাকে বার বার হাত দিয়ে চেক করি"


গ বিদ্যা বিভাগ, সাইকোথেরাপি উইং প্রধান;কনসালটেন্ট ওসিডি ক্লিনিক এবং জেরিয়াট্রিক ক্লিনিক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় , ঢাকাপ্রফেসর ডা. সুলতানা আলগিন মনোরো

 

 

প্রফেসর ডা. সুলতানা আলগিন
মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ,সাইকোথেরাপি উইং প্রধান
কনসালটেন্ট ওসিডি ক্লিনিক এবং জেরিয়াট্রিক ক্লিনিক,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় , ঢাকা
_________________________

পেশা পার্শ্বেল পৌছে দেয়া ।বয়স ৩৫। উস্কোখুস্কো চুল ময়লা পাঞ্জাবী পরনে। তার সমস্যা: সে কি করে, কি দেখে, বোঝে না। আজ নয় মাস যাবৎ তার কোন আয়-রোজগার নাই। কোম্পানির সার্ভিস ঠিকমত পৌঁছাতে পারে না। কোন এক সময় এক দেড় মাস চিকিৎসা নিয়েছিলেন । কিন্তু সে চিকিৎসাও নিয়মিত নেন নাই।
তাকে বলেছিলাম সমস্যাটা একটু বিস্তারিত বলতে, যদি অসুবিধা না থাকে । তিনি রাজি হলেন।

উনি বললেন, যাই করতে যাই তাতেই সন্দেহ জাগে। সাইকেল নিয়ে যখন বের হতে যাব মনে হয় এটা সাইকেল নাকি রিকশা নাকি অন্য কিছু ? সেটা ধরে দেখি। বড় বড় চোখে তাকিয়ে দেখতে থাকি। শ্বাস প্রশ্বাস নিতে গেলে মনে হয় আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি। পেটে বুকে নাকে বার বার হাত দিয়ে চেক করি। কাশি দিতে ভয় লাগে। গোসল করা বন্ধ করে দিয়েছি। মনে হয় পানির মধ্যে দম আটকে যাবে।

শার্ট না পান্জাবী পরেছি বুঝতে পারি না। বার বার দেখি। হাটলে মনে হয় হাটি না । মাঝে মধ্যে দৌড় দিয়ে দেখি । তখন মনে হয় আমিতো হাটি না, দৌড়াই। সময়মতো পার্শ্বেল পৌছানোর জন্য সবাই আমাকে আগে ডাকতো। আমার উপর সবার অনেক আস্থা ছিল। এখন সবকিছুতে অনেক দেরী হয় । কাজে এত দেরী হলে তারা কেন ডাকবে? আয়-রোজগার বলতে গেলে নাই। পাগল পাগল লাগে। আমাকে চলন্ত জীবন্ত একটা জীবন দেন মেডাম । এই রোবটের মত জীবন আমার আর সহ্য হচ্ছে না ।

আগে যখন মানুষের বাসায় জিনিষপত্র নিয়ে যেতাম ;তার কন্ঠ আর চেহারা মিলাতে চেষ্টা করতাম। মোবাইলে ঠিকানা যখন বলতেন তখন তার কন্ঠ আমার মনে গেঁথে যেত। প্রতিদিন আমি ৫০-৬০জনের কন্ঠ আর চেহারা মিলানোর অহেতুক প্যারা নিতাম। সঠিক ঠিকানায় পৌছে দেয়া আমাার কাজ। ব্যস শেষ হয়ে গেল। সামনের আর মোবাইলের কাস্টমার যদি এক না হয়- এই উপরি টেনশন নিতাম!
যে সব টাকায় লেখা থাকতো তার ছবি তুলতাম। কত মানুষ কত রকমের কথা এই টাকায় লিখে রাখে। সেগুলো পড়তাম আর ছবি তুলতাম। একটা নেশার মত হয়ে গেল। খারাপ ,মজাদার ,প্রেমের কথা,পাওনাদারের কথা কতকিছুই না মানুষ লিখে! মানুষ তার অনুভূতি লিখে কিন্তু আমি কেন তাদের ছবি তুলি তার কারণ বুঝি না।
রাস্তায় চলার সময় কোন জুতা পড়ে থাকতে দেখলে তার ভিডিও করা লাগবেই। আমার সময় নাই। তাড়াতাড়ি মাল পৌছাতে হবে। তারপরও থেমে যাই। জুম্মার দিনে কোন মসজিদের সামনে দিয়ে গেলে সিড়িতে সারি বাধা এলোমেলো কত রকমের জুতা দেখি। কোনটা সেন্ডেল , কোনটা চামড়ার জুতা, কোনটা দামি নতুন, কোনটা পুরান ছেঁড়া;সব খুটে খুটে দেখতাম। আর ভিডিও করতাম। কেন করতাম ? যখন নিজেকে প্রশ্ন করতাম ,বুঝাতাম এসব কি করছি; কিন্তু চেষ্টা করেও নিজেকে আটকাতে পারতাম না। মানুষ কি ভাবছে- জুতাচোর কিনা? এসব চিন্তাও আসতো।
আমি এখন ঘর থেকে বের হই না। নিজেকে একটা রুমের মধ্যে আটকে রাখি। তারপর চুপ হয়ে গেল। মাথানীচু করে বসে থাকল।
যখন কথা বলা বন্ধ করলেন তখন আমি বললাম, তোমার এই ওসিডির সমস্যা অনেক দিনের। চিকিৎসাও নিয়েছিলে। কিছুটা ভালো বোধও করেছিলে। হতাশ হবে না। আবার তুমি কাজে ফিরে যেতে পারবে। তোমার রোগটি নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু কথা দিতে হবে যে ওষুধ নিয়মিত খাবে।

কেন হয় ?

ওসিডি একটা মানসিক রোগ। । তোমার কোন দোষ নেই। ব্রেনের কর্টিকো-স্ট্রায়েটো-থেলামোকর্টিকাল লুপের/সার্কিটের কাজে অসামঞ্জস্য থাকায় এই সমস্যা মানুষের মনের মধ্যে দেখা দেয়। নিউরোট্রান্সমিটার সিরোটনিন,ডোপামিন,গ্লুটামেট কমবেশি হয়। যাদের এই লুপের কাজ স্বাভাবিক তারা এই ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। কারণ নিউরোট্রান্সমিটার তাদের ব্রেনে স্বাভাবিক মাত্রায় আছে।

যা করণীয়:
ওষুধগুলো তোমার অনেকদিন/বছর খেতে হবে। কিছুদিন পর যখন তোমার লক্ষণগুলো সহনীয় মাত্রায় আসবে তখন ওষুধ ছেড়ে দিও না। ধৈর্যহারা হবে না। এসব ওষুধ বেশ ধীরে কাজ করে। সময় লাগে। আমি জানি তুমি সুস্থ হবে কিন্তু একটু সহযোগিতা দরকার। ওষুধ চলুক । ফলোআপ ঠিকমত করবে।

বর্তমানে ওসিডির খুব ভাল কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ওষুধ বাজারে পাওয়া যায়।ওষুধ নিয়মিত খাওয়া জরুরী। সুস্থ থাকতে এর কোন বিকল্প নেই। পাশাপাশি কাউন্সেলিং নেয়া যেতে পারে। মোবাইল ব্যবহার যত কম করা যায়। ঘুমের আগে একেবারেই নয়। দিনে দুই থেকে আড়াই লিটার পানি খাবে। রাতে ৬-৭ঘন্টা ঘুমাবে। কোল্ড ড্রিংকস ,ফাস্ট ফুড সহজে খাবে না। শাকসব্জি দেশীফলমূল সালাদ খাবে।

***চিকিৎসা বিজ্ঞান এগিয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন সব মেডিসিন ব্যবহারের সুযোগ বাড়ছে। শারীরিক এবং মানসিক রোগ কোনটাই অবহেলা করা যাবে না। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ও সঠিক চিকিৎসা আনতে পারে সুস্থতা। আর সঠিক খাবার ,সুশৃক্সখল জীবনযাপণ,পর্যাপ্ত ঘুম আপনার জীবনে আনতে পারে বেচে থাকার স্বপ্ন।

আপনার মতামত দিন:


মন জানে এর জনপ্রিয়