Ameen Qudir

Published:
2017-02-21 03:44:26 BdST

একুশের রাত , শহীদ মিনার : স্বর্নালী কিছু স্মৃতি


 

 

 

 

শিলা চক্রবর্ত্তী
____________________________


আজকের এই রাতটা, একুশের প্রথম প্রহরটা, আমরা জেগে কাটাতাম । আমাদের স‍্যর ইকবাল রোডের বাসাটা শহীদ হাদীস পার্ক থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে ।

সেখানে রাতভর মাইকে কতো গান, কতো কবিতা, সব শুনতাম বারান্দায় বসে । রেকর্ড চালিয়েও দিতাম, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি ... ইকবাল রোডের পথ জুড়ে কী সুন্দর আল্পনা দিতো ছাত্ররা !

একটু রাত হলেই সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পরা, খালিপায়ের নানা মানুষের মিছিল , সাদা ফুলের রিদ, কখনো ফুলের তোড়া, কখনো ভ‍্যানের পরে ফুল দিয়ে সাজানো বিশাল মানচিত্র, তার গায়ে ঝোলানো অ আ ক খ - র বর্ণমালা ! তারা কখনো রেকর্ড চালিয়ে, কখনো স্বকন্ঠে গাইতে গাইতে যেতো । আমরাও যেতাম আমাদের উদীচীর প্রভাতফেরিতে গান গাইতে গাইতে । সাথে ছিলো সকাল সন্ধ‍্যায় অনুষ্ঠান ।

 

ছোটোবেলায় কাকার সাথে বারকয়েক গেছি রাত বারোটার পর মালা দিতে । বড়ো হবার পর সকালেই যেতাম । আমরা যখন মিশু ক্লিনিকের বাড়িটায় থাকতাম, ফেব্রুয়ারি মাস পড়তেই, বাড়িতে আশপাশে আমাদের বয়সী ছেলেপিলে যারা ছিলো, তাদের নিয়ে মাততাম একুশে পালন করতে । সবাই মিলে চাঁদা দেয়া হতো । ইঁট সাজিয়ে ছোটো শহীদমিনার বানানো হতো । রঙীন কাগজ কিনে আনতাম, ছোটো কাকা সেগুলো কেটে সুন্দর করে ঝালর বানিয়ে দিতো । পাড়ার সুবলমামা রূপোলি বর্ডার দেয়া কাগজে, রূপোলি কাগজ কেটে "অমর একুশে" লিখে দিতো । মা আটা জ্বাল দিয়ে আঠা বানিয়ে দিতো । ইঁটের মিনার আমাদের ছোট্ট ছোট্ট হাতের প্রয়াসে সেজে উঠতো রঙীন কাগজে, ঝালরে, পাটের "টোন" দড়ির গায়ে তেকোনা ঝুলকাগজে ‌।


সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো, ছড়া, গান, শহীদদের কথা... প্রতিযোগিতাও হতো । বাড়ির কাছে কেডি ঘোষ রোড থেকে চাঁদার টাকা থেকেই পুরষ্কার কেনা হতো । ছোটদের রাশান রূপকথার বই । রুশ শিশুসাহিত‍্যিক এভা ভাসিলেভ্স্কায়া । বাঙালি ছড়াকারদের ছড়ার বই । একুশের আগের রাতটিতে উত্তেজনায় ঘুম হতোনা সারারাত । যেহেতু আমিই "পালের গোদা" , আমাকে সবার আগে কুসুমবাগে জেগে উঠতে হবে এজন‍্য বকাঝকাও কম খাইনি । বারবার টর্চ জ্বেলে ঘড়ি দেখতাম আর ঝাড় খেতাম । চারটে বাজলে আর ঘরে রাখা যেতোনা । স্কুলের পোশাক চড়িয়ে বাইরে গিয়ে দলবল জুটিয়ে আগে শহীদ হাদীস পার্ক ঘুরে এসে তারপর আমাদের স্বরচিত মিনারে ফুল দিয়ে সাজানো হতো । মেনগেটের সামনেই মিনারটি থাকায় প্রভাতফেরির পদযাত্রীরা অনেকেই দাঁড়িয়ে মিনারটি দেখতেন ‌। আমাদের বলতেন, "তোমরা বানিয়েছো ? বাহ্, খুব ভালো " ! কেউ ফুল দিয়েও যেতেন । একবার এক বখাটে ছেলে টফি ছুঁড়ে দিয়েছিলো । সুমন নামে ছোটো এক ছেলে বখাটেটিকে ধাওয়া করে গিয়েছিলো । সন্ধ‍্যায় হতো আমাদের অনুষ্ঠান । পুরষ্কার বিতরণী । মিষ্টিমুখ । সেসব দিনগুলো স্বপ্নের মতো মনে হয় ।

এখানে আসার পর এক বন্ধু অর্ণবের সৌজন‍্যে একটি প্রভাতফেরিতে গিয়েছি , তবে এখানে কেউ খালিপায়ে হাঁটেনা । আমি হেঁটেছি । একুশের প্রভাতফেরিতে জুতো পরে হাঁটার কথা আমি ভাবতেও পারিনা । এরপর যখন ৯৯ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্বীকৃত হলো, তখন আইন কলেজে পড়ি । প্রিন্সিপাল ডেকে বললেন, "তোমরা সুন্দর করে দিনটি পালন করো" । অনুষ্ঠান করতে পারলে আমাদের আর পায় কে ? দলবল জুটিয়ে মহড়া চালু হয়ে গেলো । ছোটো থেকে যতো গান, কবিতা শুনে বড়ো হয়েছি, সেগুলো করার একটা মঞ্চ পেলাম, অনেকটা পাওয়া ছিলো সে । যতদিন কলেজে ছিলাম, সুন্দর অনুষ্ঠান করেছি শহীদ স্মরণে ।

এরপর রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী সমিতির সংস্পর্শে আসা ‌। এখন যে সকাল দুপুর সন্ধ‍্যায় অনুষ্ঠান, সারাদিন গানে কবিতায় একুশ স্মরণ, এই সময়টা ফিরে আসতে অনেকটা সময় গড়িয়েছে, অনেক কষ্ট হয়েছে । মহড়ার তুমুল আড্ডা আর গানের এই দিনগুলোর অপেক্ষা থাকে বছরভর । গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠা গানগুলো, কবিতাগুলো, উচ্চারণগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি বারবার । প্রভাতফেরি আর বর্ষবরণের শোভাযাত্রায় পা মেলাতে পারার রোমাঞ্চের পরম পাওয়ার পরিপূর্ণতা , তোমাকে স্বাগত ।

ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা । সবার একুশ স্মরণ সার্থক সুন্দর হোক । সকলকে শুভেচ্ছা ।

_________________________

লেখক শিলা চক্রবর্ত্তী

Crime Law Professional at Alipore Judges and Criminal Court
Worked at Barasat District Session Judges Court
Worked at Advocate
Worked at Alipurduar Judges Court

আপনার মতামত দিন:


মন জানে এর জনপ্রিয়