SAHA ANTAR
Published:2020-11-09 02:18:57 BdST
চলমান অপয়া সময়ে মানসিক চাপ সামলাতে ১৩টি পয়েন্ট
ডা. সুলতানা আলগিন
সহযোগী অধ্যাপক
মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
কনসালটেন্ট ওসিডি ক্লিনিক ও জেরিয়াট্রিক
ক্লিনিক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা
__________________________
করোনা বিশ্বব্যপী মানবজাতিকে যে ভাবে নাড়া দিয়েছে
তা কেউ স্বপ্নতেও কল্পনা করতে পারে নাই। এত ভয়ঙ্কর
ছোঁয়াচে প্যান্ডেমিকে মানুষ যেমন মানবিকতার পরিচয়
দিয়েছে তেমনি অমানবিকতার দিকটাও প্রকটভাবে বের
হয়ে এসেছে।
প্যান্ডেমিক মানে অভিধান বলছে অতিমারী। আমরা
বাংলাদেশে বলছি মহামারীও। কোভিড১৯ বা করোনার
নানামুখী অভিঘাত , প্রভাব , হামলা , মানুষকে কাবু করার
বিচিত্রমুখ ক্ষমতা ; তাতে এটাকে সহজ ব্যখ্যা করা বেশ
মুশকিলের।
নিঃশ্বাসের নাই বিশ্বাস -- এই আতঙ্কে
আবালবৃদ্ধবনিতা আতঙ্কিত। করোনার ভয় যেন এক অন্ধকুপ;
তার ভেতর মানসিক চাপ,উদ্বিগ্নতা,হতাশা,বিষন্নতা
বাসা বেধেছে । এই ভয়-গহবর থেকে বেরিয়ে আসতে
হবে আমাদের । কিন্তু কি ভাবে বেরিয়ে আসবো আমরা ?
করোনার সঙ্গে আর যাই হোক ছেলেমানুষি করার কোন
মওকা নেই। সচেতন, সংবরণ, সংযত আচরণ ,
আত্মনিয়ন্ত্রণ , রোগজীবানু থেকে দুরে থাকা ; তবেই
কিছুটা আত্মরক্ষার আশ্বাস।
কেন এমনটা হচ্ছে ?
করোনা মানুষের শরীরের বিভিন্ন সিস্টেমকে আক্রান্ত করে
ফেলছে। ফুসফুস,কিডনী,হার্ট,ব্রেন, রক্তপ্রবাহকে
আক্রান্ত করছে । পাশাপাশি নারীশিশু পুরষমহিলা সবাইকে
নির্বিশষে গৃহবন্দী করে ফেলেছে। করোনা গাইডলাইনে
যেভাবে বারবার হাতধোয়া, শারিরীক দূরত্ব বজায়
রাখা,এ·পোজার কমানোর প্রতি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে ,
তাতে মানুষ আরও ভীত হয়ে পড়ছে। গাইডলাইন অনুসরণে
অক্ষমতা , আজকের অন্তর্জাল মুক্তবিশ্বের নানা প্রচার,
অপপ্রচার , মতলবি প্রচার , ধর্মান্ধতা, ধান্ধা বিষয়টিকে
কওে তুলছে আরও জটিল। অবৈজ্ঞানিক নানা অপপ্রচার
হাজার হাজার শেয়ার হয়ে মানুষের সচেতনতাকে করছে অন্ধ
; তারপরও এটাই ঠিক যে, গাইডলাইন, বৈজ্ঞানিক
সতর্কতা , ডাক্তারদের পরামর্শ : এইগুলি মানুষের রক্ষাকবজ।
শত অক্ষমতা , সীমাবদ্ধতা , অপারগতা , অশিক্ষা ,
অসচেতনতার মাঝেও বেশির ভাগ মানুষ করোনা নিয়ন্ত্রণের
নিয়মগুলো কমবেশী মেনেছেও।
নতুবা মানুষের মৃত্যুহার ,সংক্রমণের হার বেড়ে যেত
অনেকগুণ। এইরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিয়ে হাসপাতাল
থেকে হাসপাতাল দৌড়িয়েছে অনেকে বেডের আশায় ।
কেউ পেয়েছেন, কেউ পান নাই। শোকাবহ পরিস্থিতি
হয়েছে। অনেক করুণ মানবিক কাহিনি তৈরী হয়েছে।
সেসব মানুষকে আরও অসহায় করেছে। আবার সচেতন
হতেও লাল সঙ্কেত দিয়েছে। কেউ বাসাতেই অক্সিজেন
সিলিন্ডার, পালস অক্সিমিটার কিনে বাসাতেই
হাসপাতাল বানিয়ে ফেলেছেন। আবার এর কোন নির্দ্দিষ্ট
চিকিৎসা প্রটোকলও বের হয় নাই এই লেখা পর্যন্ত ।
করোনার টিকা নিয়ে চলছে বিশ্বজোড়া নানা
সার্কাস; সেখানে আছে জীবনের আশ্বাস। সুস্থতার
আশাবাদ। আবার বিশ্বমোড়লদেও নানা প্রচারে মানুষের
মাঝে চাপা ক্ষোভের পাশাপাশি বেড়েছে অবিশ্বাস,
হতাশাও। করোনার টিকা আমরা পাবো তো! ’ওয়েটিং ফর
গডো’র মত সাধারণ মানুষ অধীর অপেক্ষায় ; মানুষকে
বাঁচানোর টিকা রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,বৃটেন ,
ভারতবর্ষ, চীন ; যে-ই আবিস্কার করুক , আমরাও যেন পাই
; এই প্রত্যাশা দেখেছি সকলের মধ্যে। একজন চিকিৎসক
হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের এই প্রত্যাশা প্রতিদিনই
অনুভব করি। করোনা ইনফেকশন নির্ণয়ের পরীক্ষা নিয়ে
জটিলতা মানুষের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করেছে। ভ্যাকসিন
বাজারে কবে পাওয়া যাবে দাম কত হবে কারা পাবে -- এসব
প্রশ্ন সবাইকে আন্দোলিত করে।
আয়রোজগার,ব্যবসাপাতি , চাকরী ছাটাই ,সন্তানের
পড়াশোনা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সবকিছুই টালমাটাল। কাজের
চাপ বিশেষ করে মহিলাদের অনেক বেড়ে গেছে।
কারা বেশী রিস্কে আছেন ?
ডাক্তার ,নার্স,পুলিশ,ব্যাংকার : এইসব পেশার লোকজনকে
প্রতিদিন হাজার হাজার লোকের পাশে কাজের অনিবার্য
কারণেই থাকতে হচ্ছে। তাদের শারীরিক ও মানসিক ভাবে
আক্রান্ত হওয়ার আশংকা বেশী। তারা জেনে বা না জেনে
করোনারোগীর সংস্পর্শে যাচ্ছেন। বয়স্ক মানুষ,যারা
শ্বাসতন্ত্রের রোগে,হৃদরোগে,ডায়াবেটিসে আগে
থেকেই ভুগছেন তাদের করোনা সংক্রমণের আশংকা বেশী।
কারণ তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম। আর তাছাড়া
করোনার শরীরের সব জায়গায় নাক গলানোর প্রবণতা
আছে। তাই এই রোগ যে কোন রকম উপসর্গ নিয়ে দেখা
দিতে পারে। তাই একটু স্বাভাবিক মৌসুম পরিবর্তনের
সময় যে ফ্লু হচ্ছে তাতেও সবাই আতংকিত। দ্রুত
কোয়ারেনটাইনে পাঠিয়ে দিচ্ছে পরিবার পরিজন।
নিজের রক্ষার পাশাপাশি আপনজনের সুরক্ষার জন্য এই দূরত্ব
সবাই মেনেও নিচ্ছে।
কি কি মানসিকরোগের প্রকোপ হতে পারে ?
একটা রিসার্চে দেখা গেছে যারা করোনা আক্রান্ত
হয়েছেন তারা তাদের সবার মধ্যে ডিলিরিয়ামের সাথে
অনিদ্রা ৪২%,উদ্বেগরোগ ৩৬%,স্মরণশক্তির সমস্যা
৩৪%,বিষন্নতা ৩৩%,কনফিউশন ২৮%,চেতনতার পরিরর্তন
২১% দেখা গেছে। অপর সমীক্ষায় ¯^াভাবিক মানুষের মধ্যে
২৯% উদ্বিগ্নতা রোগ,৯%-১৭% বিষন্নতা রোগ,৮%-
৩৬% হতাশা ,অস্থিরতা,মানসিক চাপ পরিলক্ষিত হয়েছে।
নেশা,ধুমপানের মত আসক্তি বেড়ে চলেছে। ইন্টারনেট
আসক্তি সবার মধ্যে প্রবলভাবে দেখা দিচ্ছে। এখন বয়স্ক
ব্যক্তিরাও এতে আসক্ত হয়ে পড়ছেন ; কারণ সময় কাটে না।
এতদিন যারা এর বিপক্ষে ছিলেন তারাও মোবাইল ছাড়া
ঘুমাতে পারছেন না। মোবাইলের বাজার কিন্তু বেশ রমরমা।
আর অনিদ্রারোগের হার সমাজে ক্রমশই বাড়ছে। মানুষের
ঘুম খাওয়াদাওয়া গোসল আলাপচারিতা সবকিছুই
পরিবর্তিত হচ্ছে। রাত জেগে দেশেবিদেশে
আত্মীয়¯স্বজন,বন্ধুবান্ধবদের সাথে গল্প, সিনেমা
দেখা,দেরীতে ঘুমাতে যাওয়া আর দেরীতে ঘুম থেকে ওঠা
,চোখের সামনে মোবাইলে ফেসবুকিং করা : চোখের
ক্ষতি শখের বশে অর্জন করছে সবাই। খাদ্যরসিক হয়ে
উঠছেন অনেকেই। স্থুলতা,হৃদরোগ,ডায়াবেটিস রোগীর
সংখ্যা ঘওে ঘরে বাড়ছে। আর বাড়ছে মানসিক রোগ।
কাজের সাহায্যকারী বুয়াদের আসা সীমিত করাতে
অনেক মহিলাই বিষনন্নতারোগে ভুগছেন। বাচ্চাদের
আবদার মিটাতে হাপিয়ে উঠছেন। কারও কারও
ওসিডি/শুচিবায়ু রোগের লক্ষণ বেড়ে যাচ্ছে। করোনা
রোগের গাইড লাইন মানতে গিয়ে অনেকের মধ্যে এই
রোগের সূচনা হচ্ছে। কাপড়চোপড় ধোয়ার পরিমাণও
বেড়ে গেছে। ওয়াশিং মেশিন কেনার হার
বেড়েছে।অনেকের মধ্যে সাইকোসিসও দেখা দিচ্ছে।
তারা মনে করছেন তাদের খাবারে করোনা জীবাণু মিশিয়ে
দেয়া হয়েছে । তাই সন্দেহ করছেন আপনজনকে। খাওয়া বন্ধ
করে দিয়েছেন। কান্নাকাটি করছেন । তাকে দেখার কেউ
নাই বলে। সামাজিক যোগাযোগ কমে যাওয়ায়
একাকীত্ব পেয়ে বসছে । বিচিত্র ও নিত্য নতুন সব
বাস্তবতা এখন আমাদের চারপাশে।
শিশু কিশোরদের মধ্যেও মানসিক রোগের উপসর্গ বাড়ছে।
যেহেতু বাইরে যেতে পারছে না তাদের মধ্যে
এটেনশনডেফিসিট ডিসঅর্ডার,কনডাক্ট
ডিসঅর্ডার,মোবাইল,গেম আসক্তি বেড়ে চলেছে।
আত্মহত্যার প্রবৃত্তি বেড়েছে । যেহ ারে করোনায় রোগী
মারা যাচ্ছে তাতে ¯স্বাস্থ্যসেবাকর্মী, নিকট
আত্মীয়স্বজন যারা চাক্ষুষ সাক্ষী তাদের মধ্যে এই আশংকা
দেখা যাচ্ছে। তাদের মন ব্যর্থতার বেদনা,নিজেকে দোষী
ভেবে কষ্টে নীল হয়ে যাচ্ছেন। চোখের সামনে সেই
দৃশ্যগুলো ভেসে বেড়ায়। দুঃস্বপ্নে ঘুমাতে পারেন না।
কি করণীয়:
১.মানসিকভাবে যে কেউ যেকোন সময় যেকোন পর্যায়ে
বিপর্যস্ত বোধ করতে পারেন। করোনা কালে
মানসিকরোগের মাত্রা আশংকাজনক হারে বেড়ে গেছে,
সে তো জানা-ই ।তাই সংকোচ দ্বিধা লজ্জা সব আমাদের
কাটিয়ে উঠতে হবে। মানসিক যত্ন নিন।
২.
পরষ্পরকে
সময় দিন। চোখ ছিল অন্ধ। এই করোনা এসে আমাদের
অনেককিছু আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, মানুষ
কত দ্রুত নিঃসঙ্গ হয়ে যেতে পারে। আবার সেই
নি:সঙ্গতার সত্য আমাদের মাঝে জাগিয়েছে শুভবোধ।
৩.
ভয়কে জয় করে , প্রয়োজনীয় সতর্ক প্রস্তুতি নিয়ে
অসহায় মানুষের পাশে মানুষই দাঁড়িয়েছে। দাঁড়িয়েছে
তারুণ্য। কেউ খাবার পৌছে দিয়েছে অসহায় ক্ষুধার্ত ,
কর্মহীনকে। শোকার্ত ভীত পরিবারের পাশে দাড়িয়েছে
সাহসী তরুণ। করোনা-প্রয়াত কে তার ধর্মমত শেষ
ঠিকানায় পৌছে দিয়েছে স্বেচ্ছাসেবকরাই। মানুষ
মানুষের জন্য । সেটাও প্রমাণ করেছে তারা ।
৪.
তাই সু¯স্বাস্থ্য এর বিকল্প নেই। নিয়মিত
খাদ্যাভ্যাস,ব্যায়াম ,প্রার্থনা,দৈনন্দিন কাজকর্মে
কোন অবহেলা করা চলবে না। হাইজিন মেনে চলবেন।
৫.
ইলেকট্রনিক মিডিয়ার যুগএখন। বিশ্বব্যপী
মানসিক রোগের চিকিৎসা টেলিমেডিসিন,ভিডিও
কনসাল্টেশনের মাধ্যমে করার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে।
৬.
মেডিসিন, মনোরোগসহ কিছু ডিসিপ্লিনে
ভিডিও কনসাল্টেশনের মাধ্যমে সফল স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত
করা সম্ভব হয়েছে। কারণ এসব পদ্ধতিতে রোগী,তার
পরিবার সহজেই বাড়িতে বসে চিকিৎসা নিতে পারেন।
বাইরে যেতে হচ্ছে না । যাতায়াত খরচও কমে যাচ্ছে।
এধরণের রোগীকে অনেকসময় বাইরে হাসপাতাল বা
চেম্বারে আনা-নেয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে। তখন
অনিচ্ছাকৃতভাবে অনেক রোগী চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত
হন। অথচ নিয়মিত ওষুধ খেলে তারা সুস্থ থাকতে পারতেন।
সোশ্যালওয়ার্কার নেটওয়ার্ক শক্তিশালী হতে পারে এ
সুযোগে।
৭. পেশার পরিবর্তন করে সমাজে সচেতনতা
বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
যা এড়িয়ে চলবেন:
৮. মিডিয়ার অপব্যবহার থেকে বিরত থাকবেন। সীমিত
সময়ের জন্য মোবাইল নেট ব্যবহার করবেন।
৯.
গুজব এড়িয়ে চলবেন। গুজবে কান দেবেন না। গুজব একদম
শেয়ার করবেন না। গুজব শেয়ার মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে
আনতে পারে।
১০.
ধর্মান্ধতা নয়, বিজ্ঞানের সাফল্যেই মুক্তি; ভয়কে জয়।
বিজ্ঞানে আস্থা রাখুন। অবৈজ্ঞানিক কোন বিশ্বাসকে
প্রশ্রয় দেবেন না। সেটা ছড়াবেন না। সেটা হতে পারে
মানবজাতির জন্য প্রচন্ড ক্ষতির কারণ।
১১.
ঘুমের যাতে ব্যঘাত না ঘটে । ঘুম কেড়ে নেয়, সেসব
মিডিয়াম থেকে দূরে থাকুন। বিরত থাকুন। অহেতুক
দুশ্চিন্তাকে কাছে ঘেষতে দিবেন না।
১২.
সবরকমের নেশা আসক্তি থেকে নিজেকে দূরে রাখুন। অলস
মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। তাই এসব ব্যাপারে
প্রত্যেককে সচেতন থাকাটা জরুরী।
১৩.
করোনা মিতব্যয়ী হতে শিখিয়েছে। অপব্যয় থেকে দূরে
থাকুন। বলা যায় না কার কখন দুর্ঘটনা ঘটে।
শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখুন। জনবহুল জায়গা এড়িয়ে চলুন।
প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যাবেন না। তবে আমাদের মত
প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যাবেন না। তবে আমাদের মত
জনবহুল দেশে সচেতনতা সৃষ্টির কোন বিকল্প নাই।
দৈনিক প্রথম আলোর বর্ণিল-এ প্রকাশিত। প্রথম আলোর সৌজন্যে প্রকাশিত
আপনার মতামত দিন: