রাতুল সেন
Published:2020-08-20 16:17:33 BdST
স্কুলে ডিভাইস বনাম ডিভাইসে স্কুল: কে কার কাছে পরাজিত !
ডা সুলতানা আলগিন
সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগ বিদ্যা
কনসালটেন্ট ওসিডি ও জেরিয়াট্রিক ক্লিনিক
,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
______________________
স্কুলে ডিভাইস নাকি ডিভাইসে স্কুল: কোনভাবে বলব। একসময় সবাই মিলে বলতাম , হে শিশুরা, স্কুলে মোবাইল নিও না। শিক্ষার্থীদের মোবাইল নিতে দিও না। মোবাইল শিশুদের জন্য নয়। ওদের জন্য ভাল নয়। ওদেও জন্য চাই চারপাশের আনন্দ উপকরণ ; যন্ত্র নয়।
করোনা কাল বদলে দিল সবকিছু। এখন সেকথা কেমন করে বলব। এখন যে স্কুল্ , পড়াশোনা , শিক্ষকের অসামান্য লেকচার সবকিছু যে এখন ডিভাইসে বা মোবাইলে ঢুকে পড়েছে। কে এমনটা ভেবেছিল! তবে এটাও ঠিক; যুগের হাওয়ায় তাল মিলাতে হয়েছে এবং হবেও। নতুবা অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়তে হয়। করোনাকালে বাচ্চাদের পড়াশোনা নিয়ে অভিভাবকদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই । সবার মনেই প্রশ্ন, সংশয় ভয়: ভবিষ্যত প্রজন্মর শিক্ষার হাল কি হবে, দেশ ও দশের কি হবে ।
স্কুল বন্ধ করতে কেন হলো ?
বিভিন্ন রিসার্চে দেখা গেছে বাচ্চারা বড়দের তুলনায় কোভিড-২০ দ্বারা আক্রান্ত হয় কম । কিন্তু তারা রোগ সংক্রমণের ক্ষেত্রে অনেক বড় ভ’মিকা পালন করে। বাচ্চাদের মধ্যে লক্ষণ কম দেখা যায় তবে ভাইরাস লোড বেশী থাকতে পারে বিধায় স্কুলে গেলে এই কোভিড-২০ সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করবে । আশঙ্কাটা খুবই উদ্বেগের । স্কুল বন্ধ থাকলে এর বিস্তারের হার ৪০%-৬০% কমে যাবে।
তাহলে এদের পড়াশোনা ?
অনির্দ্দিষ্ট কালের জন্য স্কুল বন্ধ হলে বাচ্চারা কিভাবে পড়বে? শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড । পড়াশোনা করতেই হবে। তাই নতুন প্রচারণা শুরু হলো। মিডিয়া ডিভাইসগুলো কাজে লাগাতে হবে। যেই ভাবনা সেই কাজ। মোবাইল, টিভি, রেডিও সব মাধ্যম এখন সচল। সব মাধ্যমে শিক্ষাকে কেন্দ্র করে প্রোগ্রাম চালু হয়েছে । আগেও ছিল । তবে এখন তা ব্যাপকহারে।
ফেসবুক,ইউটিউব সবখানে অনলাইন ক্লাশ চলছে পুরোদমে। অনলাইন ট্রেনিং, ওয়ার্কশপ, ওয়েবিনার চলছে। ছোট বড় সবাই জ্ঞান আহরণে আর পিছিয়ে নাই ।
আগে বাচ্চাদের হাতে মোবাইল দিলে যে বাঁকা চাহনীতে সবাই দেখতো এখন তা আর কেউ দেখে না। কারণ এখন অনলাইন ক্লাশে সবাই উৎসাহী।সেখানে কি দেখা যায় না! বা শেখা যায় না! নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি ছবি আকা ,নাচগান ,ব্যয়াম, রান্নাবান্না, স্পোকেন ইংলিশ, গার্ডেনিং, গৃহস্থালি কাজকর্ম ,টিকটক সবই বাচ্চারা শিখছে ,জানছে । বাচ্চারা সব যে সবজান্তা মমসের হয়ে উঠছে।
মিডিয়া ডিভাইস ব্যবহার: কিভাবে শিশুকিশোর প্রভাবিত হচ্ছে বা হতে পারে ?
শিশুদেও তো বটেই, বড়দেরও কানের মধ্যে হেডফোন, চেখের সামনে স্ক্রীন কতক্ষণ থাকবে তা চিন্তার ব্যাপার বৈকি । শিক্ষণীয় মাধ্যমের পাশাপাশি অশিক্ষার প্রভাবও তো কম নয়। তাছাড়া শারীরিক সুস্থতা ও অসুস্থতার দিকেও খেয়াল রাখা দরকার।
*চার ঘন্টার বেশি স্ক্রীনের সামনে বসে থাকলে বাচ্চারদের ওজন বেড়ে যাবে। পরবর্তিতে ডায়া বেটিস, হাইপার টেনশন ইত্যদি শারীরিক রোগের বীজ নিয়ে চলতে হবে।
* ক্যান্সার আক্রা›ত হবার আশঙ্কা বেড়ে যায় বিশেষত বাচ্চাদের । কারণ ডিভাইস থেকে যে রেডিয়েশন বিচ্ছুরিত হয় তা বাচ্চাদের শরীরে হাড়ে টিস্যুতে অনেক বেশী এবসর্ব হয় , যা কারসিনোজেন হিসেবে শরীরে থেকে যায় ।
*রেডিয়েশন ব্রেনের কাজকর্মে বাধা দেয় । ফলে বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটার তৈরী হতে পারে না । আর স্বাভাবিক ডেভেল্পমেন্ট বাধাপ্রাপÍ হয়।
*পড়াশোনায় মনোযোগ না দিয়ে অনেকে অন্যান্য দিকে নজর দেয় । চ্যাটিং এ ব্যস্ত থাকে বেশী। অনেকে পর্ণ আসক্ত হয়ে যায় । আগেও দেখত । কি›তু সুযোগ এখন অনেক বেশী।মোবাইল হাতের কাছে থাকায় এর প্রতি যে আকর্ষণ তা সহজেই মিটে যায়।
* পড়াশোনা থেকে দূরে সরে যাওয়ার পাশাপাশি অনৈতিকতাও শিখে । পরীক্ষায় নকল করা ,ছবি,রেফারেন্স সরবরাহ করা এই বয়সে শিশুকিশোরদের মননে নেগেটিভ প্রভাব ফেলে। পরবর্তীতে এদের ব্যক্তিত্ব ঠিকমত তৈরী হয় না । গ্যাপ থেকে যায়।
*যেভাবে আঠার মত বাচ্চারা মোবাইলের সাথে লেগে থাকে তাতে মনে হয় ওর একপাশে মোবাইল আর একপাশে সারা দুনিয়া। এতে সামাজিক -মানসিক বিকাশ ব্যহত হয়। আপনার সন্তানের (বিশেষ করে বয়স যদি তিনের নীচে হয়)মনোযোগ সরাতে বা শান্ত করতে যদি ডিভাইস যদি অন্যতম মাধ্যম হয় তবে অবশ্যই আপনার সন্তানের অঙ্ক,বিজ্ঞান বা সাহিত্যভিত্তিক স্কিল ডেভেল্পমেন্ট নিয়ে খেয়াল রাখবেন।
*সহমর্মিতাবোধ বা সমস্যা-সমাধানের দক্ষতা দৈনন্দিন জীবনে যা অপরিহার্য তা না হওয়ার আশংকা থেকে যায়।
*ডিভাইসে ভায়োলেন্স মুভি, গেম ,কার্যকলাপ যে সকল শিশুরা দেখে তাদের মধ্যে স্মৃতিগুলো গেথে যায় । পরবর্তীতে পৃথিবীকে তাদের কাছে ভয়ংকর মনে হয় । আপন লাগে না। এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে তাদের মন অস্থির হয়ে ওঠে। শিশুকিশোররা এগ্রেসিভ হয়ে ওঠে।
*টিভি সিরিয়ালে,সিনেমা,বা যে কোন মিডিয়ায় প্রচারিত চরিত্রগুলোর সাথে অনেক শিশুকিশোর অজান্তে নিজেদের মিলিয়ে ফেলে। পরবর্তীতে সেই চরিত্রে নিজেরাই নিজেদের জীবনে রোল প্লে করে। বাচ্চাদের মানসপটে কি কখন গেথে যাবে কে জানে।
মোবাইলে স্কুল : কি করণীয় :
স্ক্রীন টাইম বেধে দিতে হবে। বাকীসময় স্বাভাবিক নিয়মে পড়াশোনা করবে,প্রাকটিস করবে।
আমেরিকান একাডেমী অফ পেডিয়াট্রিক্স গাইডলাইনে যা বলেছে:
*১৮মাস বয়সীশিশুদের জন্য কোন ডিভাইস ব্যবহার করা যাবে না। পরিবার বন্ধুবান্ধবের সাথে তারা সময় কাটাবে।
* ১৮ মাস থেকে ২৪মাস বয়সী শিশুদের জন্য কিছু স্ক্রীনটাইম দেয়া যাবে তবে সাথে অভিভাবক বা কেয়ার গিভার থাকবে।
*প্রিস্কুল শিশুরা ১ঘন্টা পাবে পড়াশোনা কারণে। তবে পাশে অভিভাবক বা শিক্ষক থাকবে তাদের দেখাতে বা বুঝাতে।
*স্কুলে পড়–য়া শিশুকিশোর এবং ৫-১৮ বছর বয়সীদের জন্য প্রয়োজনমত স্ক্রীনটাইম দিতে হবে। তাদের শিডিউল যেন অভিভাবক এর জানা থাকে।
*ঘুমানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় থাকতে হবে। যথেষ্ট ঘুম না হলে বাচ্চাদের পড়াশোনা মনে রাখাটা কষ্টকর হয়ে উঠবে ।
*নিয়মিত শারীরিক নড়াচড়া করা জরুরী। এতে স্মরণক্ষমতা বাড়ে। মনোযোগ বাড়ে।
ধন্য বাদ । মনে থাকবে তো কথাগুলো! আমরা মানতে পারব তো বিষয়গুলো! এসব ইস্যু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাচ্চাদের মানুষ করতে চাই সকলে। সুস্থ , সবল , মানসিক শক্তিমত্তার মানুষ। সেজন্য এই সবকিছু ভেবে চিন্তে ,মেনে সইয়ে এগুতে হবে।
******************************
আপনার মতামত দিন: