Ameen Qudir

Published:
2016-12-18 15:57:47 BdST

ডিয়ার লেডি ডাক্তার , এ গল্প আমাদের সকলের


 

ডা. নাসিমুন নাহার
______________________
.
.

মেয়েটি অন্ধকার ভয় পেত।তাই রাতের বেলা বাসার সবার ঘুমিয়ে পড়ার আগেই সে বিছানায় চলে যেত।

পরবর্তীতে মেয়েটি একজন চিকিৎসক হয়েছিল।পুরো মেডিকেল জীবনে শুধুমাত্র এনাটমী প্রফের আগের রাতটি সে সারা রাত জেগে লেখাপড়া করেছিল ! কারন ভোর পাঁচটায় এলার্ম বাজার সাথে সাথে উঠে পড়তে বসা ছিল তার দৈনন্দিন রুটিন।কারন মেয়েটি রাতের অন্ধকারে ভয় পেত।

কিন্তু Internship এর সময় নাইট ডিউটি করতে করতে মেয়েটি রাত জাগতে শিখে ফেলল। রাতের অন্ধকারে মায়ার নেশা খুঁজে পেল।রাত যত বাড়তো হাসপাতালের করিডোরগুলো ততই মোহনীয় রহস্যময় হয়ে উঠত তার কাছে।এই ওয়ার্ড সেই ওয়ার্ড ঘুরে সদ্য চিকিৎসক হওয়া বাচ্চা মেয়েটি জীবনের গল্প দেখত। মাঝরাতে ওয়ার্ডের অল্প আলোতে দেখা যেত ছোট্ট বেডে অসুস্থ স্বামীকে একহাতে আগলে পাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে রুগ্ন স্ত্রী।প্রতিবার গলার কাছে দলা পাকিয়ে কান্না উঠে আসত মেয়েটির।লোভীর মতো এই অপার্থিব দৃশ্য দেখতেই থাকতো মেয়েটি।অর্থনৈতিক হিসেবে এই দরিদ্র পরিবারের রোগীগুলো ভালোবাসার হিসেবে কি ভীষণ ধনী..........

সারাদিনের হৈচৈ হট্টগোল কোলাহলে ভরপুর হাসপাতাল প্রাঙ্গণও রাতের একটা প্রহরের পর নিশ্চুপ হয়ে যায়।

সার্জারি ওয়ার্ডের রোগীরা কড়া ব্যাথানাশক আর ঘুমের ঔষধের প্রভাবে একটা সময়ের পর ঘুমিয়ে পড়ে।
মেডিসিন ওয়ার্ডের কোন কোন কর্নার থেকে খকখক কাশির শব্দ ভেসে আসে।
শুধু গাইনী ওয়ার্ডের কোন ঠিক ঠিকানা নেই।সব সময় ইমার্জেন্সী ! দৌঁড়া দৌঁড়ি !

ডক্টর'স ক্যান্টিন রাত আটটার পর বন্ধ হয়ে যেত।কিন্তু খোকন মামার টং এর দোকানটা মোটামুটি সারা রাতই খোলা থাকত। হাসপাতাল বিল্ডিংয়ের ঠিক পাশেই দুটো বেঞ্চ পেতে ছোট্ট দোকান।রাত দুটো'র পর একবার চা খেতেই হতো মেয়েটিকে।ফলোআপ শেষ করে আস্তে ধীরে চায়ের দোকানে যেয়ে চুপ করে একপাশে বসত মেয়েটি। খোকন মামা জানত এই ডাক্তারমামা(ছেলে মেয়ে সবাইকে খোকন মামা বলত) একসাথে দুইকাপ কড়া লিকারের চা খাবে। চা খেয়ে ঘুম, ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা আরকি।

সবাই ঘুমালেও ইন্টার্ন ডাক্তার কে কখনোই ঘুমাতে নেই নাইট ডিউটিতে। কারো বাবা/ কারো মা/ কারো ভাইবোন/কারো ছোট্ট রাজকন্যা রাজকুমার কে দেখেশুনে রাখার দায়িত্ব যে আজ রাতে ডিউটি ডাক্তারের।

Morning, Evening ডিউটিতে পুরো হাসপাতাল ভর্তি অনেক ডাক্তার থাকেন। খানিকটা রিলাক্স একটা মুড রাখাই যায়।কিন্তু নাইট ডিউটিতে খানিকটা নীরবতা-খানিকটা শূন্যতা। একজন ডাক্তারের individual দায়িত্ববোধের শুরুটা খুব সম্ভবত এই নাইট ডিউটিগুলো থেকেই।

রোগীর দায়িত্ব নিতে নিতে, আস্তে আস্তে, খুব ভীতু ভীতু, তেলাপোকা দেখে দৌঁড়ে পালানো মেয়েটি গভীর রাতে Death Certificate লিখতেও শিখে ফেলে। কাঁপা কাঁপা হাতে, চশমার ফ্রেমে চোখের জল লুকাতে লুকাতে, কঠোর মুখভঙ্গি নিয়ে, একটুও গলা না কাঁপিয়ে সার্টিফিকেটটা সন্তান হারানো বাবাকে বুঝিয়ে দিতে জেনে ফেলে।
কঠিন পৃথিবীর অভিনয় ক্ষেত্রে অনেকটা এভাবেই পা রাখা সেই ভীতু মেয়েটির ।

জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখতে হলে, জানতে হলে, বুঝতে হলে হাসপাতালের কোন বিকল্প আসলে নেই।
.
Dear lady Doctors - এই গল্প আমাদের সবার।

________________________________

 

লেখক ডা. নাসিমুন নাহার । লোকসেবী ডাক্তার। জনপ্রিয় লেখক কলামিস্ট। নিয়মিত ডাক্তার প্রতিদিনে লেখেন।

আপনার মতামত দিন:


মন জানে এর জনপ্রিয়