Ameen Qudir

Published:
2018-09-18 16:41:49 BdST

ওসিডি নিয়ে অবহেলা এবং এই পথ চলা


ওসিডি সচেতনতা আন্দোলনের পথ চলার পথে সম্প্রতি সিলেটে উদীয়মান মনোরোগবিদদের সঙ্গে অনন্য মুহূর্ত । ছবি সৌজন্য: সিলেট এম এ জি ওসমানী কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. আর কে এস রয়েল


ডা.সুলতানা আলগিন
_______________________________

মানসিক রোগ নিয়ে অবহেলা চলছেই। অনেকেই বুঝতে চাই না কিংবা নানা কারণে বুঝে উঠতে পারি না ,অন্য পাঁচটা রোগের মত মনোরোগও নিরাময়যোগ্য ব্যধি। অন্য রোগের মত এই রোগের রোগীদেরও নিয়মিত শুশ্রূষা দরকার। তারাও ভাল হবেন। সমাজে সুস্থভাবেই বাঁচবেন চিকিৎসা পেলে।

আর ওসিডি নিয়ে কি বলব। চরম অবহেলিত এই রোগ ও এই রোগীরা। 
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ওসিডি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার পর গত কয়েক বছরে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়েছে। হচ্ছে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে কয়েক বছর ধরেই নানা সেমিনার সিম্পোজিয়ামে যাচ্ছি। সবাই ভালবাসায় আমাকে ডাকছেন। আমিও ছুটে চলছি। 
অত্যন্ত কৃতজ্ঞতা বোধ করছি আয়োজকদের কাছে। 
গভীর কৃতজ্ঞতা বোধ করছি মানুষের কাছে।

শিক্ষার্থীদের কাছে।

দেশের নানা জেলায় এখন ওসিডি সচেতনতা বেড়ে চলছে। সবাই জেনে সচেতন হচ্ছেন। যে রোগীরা ছিলেন অবহেলিত ; তারা সেবা পাচ্ছেন। পরিবারের যত্ন পাচ্ছেন। চিকিৎসা পাচ্ছেন। প্রতিদিনই এই হার বাড়ছে। ওসিডি রোগ সচেতক ভলান্টিয়ারদের চমকপ্রদ তৎপরতায় মানুষ উপকৃত হচ্ছে।

তারপরও চলার অনেক পথ আছে বাকি। কয়েক বছর আগে শেখার জন্য গিয়েছিলাম ভারতবর্ষের তথা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনোরোগবিদ্যা বিদ্যাপীঠ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ এন্ড নিউরো সাইন্স ( নিমহানস) এ । ব্যাঙ্গালুরুতে সুবিশাল সে প্রতিষ্ঠান। মনোরোগ বিদ্যার বিশ্ববিদ্যালয়। অনেকবার সেখানে গেছি শিখতে জানতে। এ যেন মায়ের কাছে বার বার যাওয়া। সেখানে ভারতবর্ষের প্রথম ওসিডি ক্লিনিক চালু হয়। তারপর আমরাও বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখমুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ওসিডি ক্লিনিক চালু করি।

মানুষ সেবাকে নিয়েছি ব্রত। এ কাজ অশেষ । নিত্য নতুন চ্যালেঞ্জ পথে। প্রতিদিনই শিখছি।

 

সিলেটে দেশবরেণ্য মনোরোগবিদ অধ্যাপক ডা. রেজাউল করীম স্যার এবং বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ মনোরোগ চিকিৎসকদের সঙ্গে । Romendra Kumar Singha Royle , Dipendra Das.

--------------

সম্প্রতি সিলেটে ওসমানী মেডিকেলে গিয়ে অভিভুত হয়েছি সকলের সাড়ায় । সেখানে 
সিলেট এম এ জি ওসমানী কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. আর কে এস রয়েলের সফল ব্যবস্থাপনা , অভিভাবকত্ব ও নেতৃত্বে ওসিডি সচেতনতায় বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। সেমিনার গুলোয় ছিল সচেতক ও শিক্ষার্থীদৈর উপচে পড়া অংশগ্রহণ। সহকারী অধ্যাপক ডাঃ আহমদ রিয়াদ চৌধুরী ওসহকারী অধ্যাপক ডাঃ কাওসার আহমদ প্রমুখ অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন ডা. রয়েলের সঙ্গে একাত্ম হয়ে।

ঢাকার বাইরে এই প্রথম ওসিডি ক্লিনিকও চালু হয়েছে সেখানে। এটা গভীর প্রশান্তির যে,মানুষ সেবা পাবে। ওসিডির অবহেলিত রোগীরা আর অবহেলিত থাকবে না। 
আমাদের আরও কাজ করে যেতে হবে। কোন মনোরোগীকে অবহেলার শিকার হতে দেয়া যাবে না। কোন ওসিডি রোগীকে অবহেলা করা যাবে না। এই বার্তা সবার কাছে বিনীত চিত্তে বলতে চাই।

এখানে সবার সচেতনতার জন্য ওসিডি নিয়ে বিস্তারিত কিছু তথ্য দিলাম। 
আসুন সবাইকে জানাই ও সচেতন করি।

 

 

রোগটির নাম অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার। এটি চিন্তাবাতিকগ্রস্ত ও বাধ্যতাধর্মী আচরণের (শুচিবাই) একটি উদ্বেগজনিত রোগ। সারা বিশ্বে প্রতি ৫০ জনে ১ জন জীবনের কোনো না কোনো সময় এই রোগে ভোগে। সাধারণত শৈশব ও কৈশোরে এই রোগটি শুরু হয়। নারী ও পুরুষ উভয়ই এই বাতিকগ্রস্ততার রোগে ভুগতে পারে।

অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার বা শুচিবাই কী?

এটা এমন ধরনের রোগ, যাতে অবসেশন, কমপালশন বা দুটিই থাকতে পারে।

অবসেশন কী?

এটা একধরনের মর্মপীড়াদায়ক চিন্তা, ছবি অথবা তাড়না, যা মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মাথায় আসে। এই চিন্তাভাবনাগুলো বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয় এবং কোনো যুক্তির ধার ধারে না।

কমপালশন কী?

অবসেশন দ্বারা তাড়িত বা বাধ্য হয়ে এবং অস্বস্তি ও উদ্বেগ কমানোর জন্য যে কাজ করা হয়, তাকে কমপালশন বলে। যেমন: বারবার ধোয়া, গণনা করা, বারবার যাচাই করা, গুছিয়ে রাখা এবং একই কথা বারবার বলা ইত্যাদি।

যে অবসেশনগুলো সাধারণত দেখা যায়

১. আগ্রাসী অবসেশন

নিজের বা অন্যের ক্ষতি হতে পারে এমন অহেতুক ভীতিকর চিন্তা।

২. সংক্রমণজনিত অবসেশন

শরীর, কাপড়চোপড় বা আসবাবে জীবাণু বা ময়লা লেগে আছে এমন চিন্তা বারবার আসা।

৩. যৌনবিষয়ক অবসেশন

নিষিদ্ধ বা বিকৃত যৌনচিন্তা, দৃশ্য–কল্পনা বা আবেগ।

এ ছাড়া সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য সূচক সংখ্যা, বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ অথবা কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভীতিকর চিন্তা বারবার মনে আসা।

যে কাজগুলো করতে দেখা যায়

১. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বা ধোয়াবিষয়ক কমপালশন

* অতিরিক্ত হাত ধোয়া, টয়লেট বা বাথরুমে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা।

* ঘরের আসবাব ও তৈজসপত্র অতিরিক্ত ধোয়া বা মোছা।

২. পরীক্ষা বা চেক করাবিষয়ক কমপালশন

তালা, চুলা, গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি বারবার পরীক্ষা করা।

৩. অন্যান্য

* আসবাব, বইখাতা, কাপড়চোপড় অথবা যেকোনো জিনিস নির্দিষ্ট ছকে গুছিয়ে রাখার প্রবণতা।

* অকারণে অপ্রয়োজনীয় জিনিস জমা করে রাখা।

* বারবার গণনা করা বা কোনো জিনিস বারবার স্পর্শ করা।

* নিজের ক্ষতি বা অন্যের ভয়াবহ ক্ষতি প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া।

কেন হয়?

বংশগত কারণ

যাঁদের পরিবারিকভাবে এই রোগের ইতিহাস আছে, তাঁদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা পাঁচ গুণ।

জীবনের কোনো ঘটনা

জীবনের যেকোনো ঘটনা দিয়ে রোগটি শুরু হতে পারে। যেমন: ব্যক্তিজীবনের মানসিক চাপ বা কোনো না কোনো পর্যায়ে যেকোনো চাপ বা ধাক্কা।

রোগজীবাণু

খুব কম ক্ষেত্রে শারীরিক রোগের কারণে এটি হতে পারে। যেমন: স্ট্রেপটোকক্কাল ইনফেকশন, মস্তিষ্কে আঘাত, রক্তক্ষরণ (স্ট্রোক) ইত্যাদি।

জৈব রাসায়নিক

শরীরে জৈব রাসায়নিক যেমন সিরোটনিন, ডোপামিনের হ্রাস-বৃদ্ধি।

আপনি জানেন কি?

এই রোগের কারণে রোগীর ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক জীবন বেশ ব্যাহত হয়। দৈনন্দিন জীবনে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়। সামাজিক মেলামেশা থেকে রোগী নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। এমনকি রোগী কর্মবিমুখও হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে উদ্বেগ, হতাশা ও অন্যান্য মানসিক রোগ দেখা দিতে পারে। অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়ে।

যা করণীয়

১. পর্যাপ্ত ঘুম ২. নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ৩. সঠিক খাদ্যাভ্যাস ৪. নিয়মিত ব্যায়াম ৫. প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি।

নিম্নলিখিত সিরোটনিনসমৃদ্ধ খাবারগুলো নিয়মিত খাওয়া উচিত

* আমিষজাতীয় খাবার: মাংস, কলিজা, ডিম, দুধ, সামুদ্রিক মাছ।

* ফলমূলজাতীয় খাবার: কলা, আনারস, আম, আঙুর, খেজুর।

* শাকসবজি: পালংশাক, পুঁইশাক, বেগুন, ফুলকপি, শিমজাতীয় বীজ, মাশরুম, টমেটো, ব্রকলি।

যে খাবার কম খাবেন বা খাবেননা

মিষ্টিজাতীয় খাবার, ক্যাফেইনযুক্ত খাবার যেমন: চকলেট, চা, কফি, কোমল পানীয়, ক্যাফেইনযুক্ত কিছু ওষুধ, অ্যালকোহল ও কৌটায় সংরক্ষিত খাবার।

কোথায় এর চিকিৎসা হতে পারে?

১. অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার ক্লিনিক মনোরোগ বহির্বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)।

২. মনোরোগ বহির্বিভাগ, বিএসএমএমইউ।

৩. জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।

৪. সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মনোরোগবিদ্যা বিভাগ।

এ ছাড়া মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ আছে।

ওসিডির জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা

১. ওষুধ যেমন: এসএসআরআই গ্রুপের ওষুধ এবং অন্যান্য

২. সাইকো এডুকেশন রোগী ও পরিবারকে রোগ সম্পর্কে জানানো। রোগীদের চিকিৎসা নিতে উৎসাহিত ও সহযোগিতা করতে পরিবার ও বন্ধুদের পরামর্শ দেওয়া।

৩. সাইকোথেরাপি

কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি, গ্রুপ থেরাপি

এক্সপোজার রেসপন্স প্রিভেনশন থেরাপি

রিলাক্সেশন, মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন

আপনি কি অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডারে ভুগছেন?

১. আপনি কি অতিরিক্ত ধোয়ামোছা করেন অথবা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকেন?

২. আপনি কি কোনো কিছু অতিরিক্ত চেক/যাচাই-বাছাই করেন?

৩. আপনার মাথায় অযাচিতভাবে কি কোনো চিন্তা আসে? যা কিনা আপনি চাইলেও মাথা থেকে সহজে বের করতে পারেন না?

৪. আপনার দৈনন্দিন কাজ শেষ করতে কি অতিরিক্ত সময় ব্যয় হয়?

৫. আপনার মধ্যে আসবাব, বইখাতা, কাপড়-চোপড় অথবা যেকোনো জিনিস নির্দিষ্ট ছকে গুছিয়ে রাখার প্রবণতা আছে কি?

উপরিউক্ত প্রশ্নগুলোর যেকোনো একটির উত্তরও যদি ‘হ্যাঁ’ বোধক হয়, তবে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

যা মনে রাখবেন

অন্যান্য শারীরিক রোগ যেমন: ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ চিকিৎসার মাধ্যমে যেভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, ঠিক তেমনি এই ওসিডি রোগটিও চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এসব আচরণকে স্বাভাবিক না ভেবে কমিয়ে আনতে চেষ্টা করুন। সচেতন হন। প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

__________________________

ডা.সুলতানা আলগিন। 
সহযোগী অধ্যাপক ও কনসালট্যান্ট ওসিডি ক্লিনিক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

আপনার মতামত দিন:


মন জানে এর জনপ্রিয়