Ameen Qudir

Published:
2016-11-08 18:18:50 BdST

ফিসফিস করে মাকে বললেন, ও দিদি, রক্ত নেবার কথা বললেই হাত বাড়িয়ে দেবেন না।হাসপাতালের জার্নাল


 

ডা. অরুণাচল দত্ত চৌধুরী


যতদূর মনে পড়ে সালটা ঊনিশশ’ পঁচাত্তর। তখন মেডিকেল কলেজে পড়ি।
আমার মায়ের শরীর খুব খারাপ। ইউটেরাইন ফাইব্রয়েড। প্রভাতদা’ কে ধরলাম। প্রভাত ঘোষ। গাইনির হাউসস্টাফ। তাঁর স্যারের আন্ডারেই অপারেশনের ব্যবস্থা হল।
এখন আন্দাজ করা যাবে না। তখনকার দিনে কিন্তু মেডিকেল কলেজের ছাত্র চিকিৎসকদের একটা বড় অংশই নিজেদের পরিজনদের চিকিৎসার ব্যাপারে নির্ভর করতেন মেডিকেল কলেজগুলোর ওপরই। এখন ক্ষেত্র বদলেছে। বেসরকারি ব্যবস্থার কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে পুরনো আস্থাটা।
যে কাহিনীতে ছিলাম সে’খানে ফিরি।


অপারেশনের আগে পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য দিন পাঁচেক আগে ভর্তি হয়েছেন মা। নানান কিসিমের পরীক্ষার জন্য পরপর দু’তিনদিন রক্ত নেওয়া হল। মায়ের পাশের বেডের রোগিণী খুব সতর্ক, সদাসন্দেহপ্রবন। পারলে ডায়েটে দেওয়া প্রতিটা ভাতের দানা ময়লা লেগে আছে কিনা দেখে খান। মাঝরাতে উঠে মাথার কাছে রাখা ছোট শেলফে রাখা বাড়ির থেকে আনা বিস্কুট গুণে দেখেন চুরি গেল কিনা।
সেই তিনি ফিসফিস করে মাকে বললেন, ও দিদি, রক্ত নেবার কথা বললেই হাত বাড়িয়ে দেবেন না। ভালো করে শুধিয়ে নেবেন কী বেত্তান্ত।
কেন?


মায়ের অবাক জিজ্ঞাসার উতরে সেই পার্শ্ববর্তিনী জানালেন,
ও মা তা’ও জানেন না বুঝি! এরা এই একটু একটু করে সবার থেকে রক্ত টেনে জমিয়ে এক বোতল করে বাইরে বিক্রি করে যে।
তো ইতিমধ্যে এক দিন মায়ের অপারেশনের ডেট চলে এল। ইডেন হাসপাতালের ওটির সামনে, প্রশস্ত বারান্দায়, অপারেশনের রোগীর বাড়ির লোকেরা অপেক্ষা করতেন। আমরা মানে আমি বাবা আর গুটি কতক আত্মীয় স্বজন সমবেত হয়েছি। মাকে ওয়ার্ড থেকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মূল দরজায় ঢোকবার আগে উৎকণ্ঠিত প্রত্যেকের কাছ থেকে মা বিদায় নিচ্ছেন। মেজর অপারেশনের আগে মধ্যবিত্ত আবহে তখন ওইটিই ছিল দস্তুর। অপারেশন থিয়েটার থেকে ফেরা যেন বা ভারি অনিশ্চিত। না ও হতে পারে।
একে একে সবার হাত ধরে একমাত্র পুত্র আমাকে দেখিয়ে বলছেন,
ছেলেটা রইল, ওকে দেখো।
বাবা এই জটলার মধ্যে নেই। পত্নীবিয়োগের আসন্ন আশঙ্কায় মুখ কালো করে দূরে একপাশে।
এ’বার মাকে ভেতরে ঢোকানো হবে।
বাবা দৌড়ে উঠে এসে অনুযোগের সুরে মাকে বললেন,
আমার সোয়েটারটা কিন্তু বোনা শেষ হয়নি এখনও। ও’টার কী হবে?
বাবা এখন নব্বই। মা প্রবল ভালোবাসায় এখনও শাসন করে চলেছেন, ঘিরে রয়েছেন আমার অসহায় বাবাকে।

 

লেখক - কলকাতার বিশিষ্ট চিকিৎসক । বিদগ্ধ লেখক। বাংলা রাজ্য সরকারের হেল্থ এন্ড ফেমিলি ওয়েলফেয়ারের কর্মরত।

 

 

আপনার মতামত দিন:


মন জানে এর জনপ্রিয়