Ameen Qudir

Published:
2016-12-04 22:33:33 BdST

কিশোরটি চেম্বারে ঢুকেই বলল, আমি সুই সাইড করতে চাই


_______________________________

ডা. জামান অ্যালেক্স
__________________________


শরীরটা কয়েকদিন ধরেই সুবিধার না।চেম্বারে তাই অনিয়মিত।এর মধ্যে একদিন চেম্বারে টুকটাক কিছু পেশেন্ট দেখে বের হবো হবো ভাব, সেসময় এক ১৭-১৮ বছরের কিশোর ঢুকলো।সাধারণত এই বয়সের পেশেন্টের সাথে অভিভাবক পর্যায়ের কেউ না কেউ থাকে, ছেলেটির সাথে অবশ্য কেউ নেই....


'কি সমস্যা', জিজ্ঞেস করলে দেখি তার মধ্যে এক ধরণের ইতঃস্তত ভাব, উত্তর না দিয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে।আমার দ্রুত বাসায় যেতে হবে, তাই একটু বিরক্ত হয়ে জোর দিয়ে আবার প্রশ্নটা করলাম।ছেলেটি এবার আমার দিকে তাকালো, বললো, "স্যার, আমার প্রায়ই Suicide করতে ইচ্ছা হয়...."


কথাটি শুনে একটা ধাক্কা খেলাম।Suicidal thought is a criteria for Major Depressive Disorder.....


ড্রাইভারকে গাড়ি রেডি করতে বলেছিলাম, কিন্তু কোন পেশেন্ট যখন বলে- যে তার Suicide করতে ইচ্ছা করে, তখন সেখানে তাড়াহুড়ো করাটা সামগ্রিকভাবে অনুচিত।আমি ফোন ব্যাক করে একটু দেরী হবে সেটা ড্রাইভারকে জানিয়ে দিলাম.....


কিশোরটি Broken family'র সন্তান, বাবার সাথে থাকে, মায়ের অন্যত্র বিয়ে হয়েছে আরও বছর দশেক আগে।ছেলেটির বেশীর ভাগ সময় কাটে ভিডিও গেমস খেলে।এখন আর কোন কাজেই উৎসাহ পায় না, ভিডিও গেমসেও না।তার কাছে মনে হয় এই পৃথিবীটা অর্থহীন......


ছেলেটির গল্প শুনে কেন যেন আমার মনটা হাহাকার করে উঠলো। আমি জানি, কিশোরটির আত্মহননের এই যে ইচ্ছা, তার বীজ রচিত হয়েছে ফ্যামিলি ব্রেক আপের মধ্য দিয়ে।


আমাদের দেশে Divorce এর পরিমাণ আগের থেকে অনেক বেশী, ফ্যামিলিয়াল স্ট্যাবিলিটি আর আগের মত নেই।আমি জানি, ফিউচার জেনারেশনের একটি বড় অংশকে এই ছেলেটির মত এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে অতিক্রম করতে হবে। আমি জানি, তাদের একটি অংশ এই ভীতিকর যাত্রায় পরাজিত হবে......


যে সময়টি ছেলেটি পার করছে এক অসীম শূন্যতার বেদনায়, সে সময়টি আমি পার করেছি মায়ের সাথে খুনসুঁটিতে।যে সময়টিতে ছেলেটি আত্মহননের কথা চিন্তা করে, সে সময়টি আমি পার করেছি পিতার গাম্ভীর্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা পিতৃস্নেহে।জেনারেশন গ্যাপ বুঝি একেই বলে....


ছেলেটি যখন কথা বলছিলো, তখন এক দৃষ্টিতে আমি তার চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম।কি এক অদ্ভুত গাঢ় বিষন্নতা তার সেই চোখগুলোতে!....

২......


হাসপাতালে ইমার্জেন্সী ডিউটি করছিলাম।ডেইলী ৫-৬ কাপ চা আমার কাছে ডালভাত।দুপুর ১২ টার মত সময়ে হাসপাতাল-লাগোয়া জুয়েলের দোকানের বিস্বাদ চা খাচ্ছি।এমন সময় স্কুল ড্রেস পড়া এক ছেলে ও মেয়ে আমার কাছে আসলো।কিছু কথাবার্তা তুলে ধরলামঃ


--আপনি কি এখন ডিউটিতে আছেন?(ভাষা বেশ রুক্ষ) --(আমি চায়ে চুমুক দিতে দিতে) হুম, কি বিষয়?
--আপনার সাথে কথা ছিলো..
--ইমার্জেন্সী রুমে বসো, আমি আসছি..
--না, এখানেই বলি..
--বলো....
--(মেয়েটির দিকে ইঙ্গিত করে) আমার গার্ল ফ্রেন্ড প্রেগন্যান্ট, আমরা এখন কি করতে পারি?


আমি বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম! বলে কি বাচ্চাগুলো! মেয়েটা ভাবলেশহীন...


ছেলেটি তারপর যা বললো তাতে এবার আমি অনেটা Freeze হয়ে গেলাম, সে বললো, "আমাদের কাছে টাকা আছে, কিন্তু ব্যাপারটা কাউকে জানাতে চাচ্ছি না..."

চিকিৎসক হবার সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো মনে যা চায়, তা সহজে বলতেও পারিনা, করতেও পারিনা। ইনস্ট্যান্ট দুইটা রামচড় দেবার ইচ্ছা চিকিৎসক হবার কারণে মাঠে মারা গেল.....

ছেলেমেয়ে দুটো ক্লাস টেন'এ পড়ে।এ সময়টা ছেলেমেয়ের রসায়ন বলতে আমরা কি বুঝতাম সেটা বলি।আইডিয়াল স্কুলে পড়তাম, মর্নিং শিফট্ এ মেয়েরা ছুটি শেষে বের হলে আমরা ঢুকতাম।এ সময়টায় দূর থেকে মেয়েদের দেখে ফ্রেন্ডদের সাথে কিছু হাসি-ঠাট্টাই ছিলো আমাদের সীমানা। অথবা তারও পরবর্তী সময়ে বেইলী রোডে ঘোরাফেরা করে Swiss এ খেতে ঢুকতাম, পাশেই যে ভিকারুন্নেছা স্কুল-তা মনে ঠিকই গেঁথে থাকতো।তখন আমাদের মনে স্বপ্ন থাকতো হয়ত কোনো একদিন কোনো এক ললনাকে বলে ফেলবো, "ইয়ে বড়ে বড়ে দেশো ম্যা অ্যায়সি ছোটি ছোটি বাত হোতি রেয়তি হ্যায়, সেনোরিটা..."


চিন্তিত মনে এই 'ব্যাকডেটেড' আমি চা খাওয়া শেষ করে বাস্তবে প্রবেশ করলাম।ছেলেমেয়ে দুটোর দিকে আবার তাকালাম, জেনারেশন তবে ভালোই এগিয়েছে!!!.....


৩.....


আম্মু ডায়ালাইসিসে গিয়েছে, সাথে আমার বোন আছে, সেও চিকিৎসক, কাজেই অনেকটা নিশ্চিন্তে বাসায় একা একা ঘুমাচ্ছিলাম।এমন সময় বাসার কলিং বেল বাজলে মেজাজ খারাপই হবার কথা, সেটাই হচ্ছে।প্রথমে অ্যাভয়েড করলাম, কন্টিনিউয়াস বেজে চলেছে, উঠতে হলো.....


দরজা খুলে দেখি ফ্ল্যাটের এক আঙ্কেল মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছেন, বললেন--তার ছেলেটা অসুস্থ, একটু গেলে ভালো হয়।যন্ত্রণা আর কাকে বলে!......
ছেলে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে।গিয়ে দেখি, চোখ-মুখ লাল, হার্ট রেট-ব্লাড প্রেসার বেশী।আমি একটু চিন্তিত হলাম, এ বয়সে ব্লাড-প্রেসার বেশী হওয়া কোনো কাজের কথা না......


আগেও ব্লাড প্রেসার এমন হাই ছিলো কিনা--তা জিজ্ঞেস করাতে ছেলেটি বলে উঠলো, "আরেহ! টেনশন নিয়েন না। বন্ধুদের সাথে বইসা জাস্ট ২-৩ টা ইয়াবা নিছি....."


কি অদ্ভুত!! যে ছেলের নাক টিপলে দুধ বের হবার কথা, সে ছেলে দল বেঁধে ইয়াবা সেবন করে আমাকে বলে 'টেনশন নিয়েন না'! How dare!.....


এই বয়সে আমাদের সময়ে কোন সাহসী বন্ধু সিগারেট ফুঁকলে আমরা উত্তেজিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম।আর এরা এখন গ্যাং পার্টিতে মেতে থাকে ইয়াবা নিয়ে। ভালোই.....


#কিছু_প্রশ্ন_ও_নিজস্ব_একটি_কনসেপ্টঃ


আচ্ছা, এখনকার জেনারেশন কি আদর্শলিপি পড়ে? "সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি...." -কি এখনো পড়ানো হয়? কিংবা কাজী নজরুলের -" ভোর হল দোর খোল খুকুমণি ওঠ রে..." -কবিতাগুলো কি বই-পুস্তকে এখনও আছে? এখনকার জেনারেশন কি বন্দে আলী মিয়ার 'আমাদের গ্রাম ' কবিতার সাথে পরিচিত?--যেখানে লেখা ছিলোঃ


"মাঠ ভরা ধান তার, জল ভরা দিঘী
চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি।
আমগাছ জামগাছ বাশঝাড় যেন,
মিলেমিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন।
সকালে সোনার রবি পুবদিকে ওঠে
পাখি ডাকে বায়ু বয় নানা ফুল ফোটে।".....


এই জেনারেশনকে কি রবিঠাকুরের- " নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে। ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে..." --কবিতাটি আন্দোলিত করে? কিংবা জসীমউদ্দীনের 'রুপাই' বা 'কবর' কবিতাটি? তারা কি সত্যজিতের 'ফেলুদা' পড়ে রোমাঞ্চিত হয়, কিংবা 'প্রোফেসর শঙ্কু' কি তাদের পরিচিত? তারা কি হুমায়ূন আহমেদের 'হিমু' বা 'রূপা'কে চেনে? কিংবা যৌক্তিক 'মিসির আলী'কে? তারা কি এখন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস- "জোছনা ও জননীর গল্প"--পড়ে টপটপ্ করে চোখের পানি ফেলে? কিংবা 'একাত্তরের চিঠি'--যেটি পড়ে আমার চোখের কোণে পানি জমে উঠেছিলো?


আচ্ছা, এই জেনারেশন কি জহির রায়হানকে চেনে? এই জেনারেশন 'Transformer' দেখে, Fast & Furious এর এপিসোডও তাদের মুখস্থ, অশ্লীল ইন্ডিয়ান মুভি-'আশিক বানায়া আপনে' কিংবা 'জিসম্' ও তারা দেখে।ইটস্ ওকে।কিন্তু তারা কি কখনো 'জীবন থেকে নেয়া' মুভিটি দেখেছে? কিংবা-'তিতাস একটি নদীর নাম'? 'ওরা এগারোজন', 'আগুনের পরশমনি', 'মেঘের অনেক রঙ' বা 'টাকা আনা পাই'-- এই মুভিগুলো সম্পর্কে কি এই জেনারেশন ওয়াকিবহাল?


শীতের সময় সরিষাক্ষেতের যে অপার্থিব সৌন্দর্য-তা কি এই জেনারেশনকে কেউ জানিয়েছে? কিংবা আমন ধানের ক্ষেতে বাতাসের যে ঢেউ বয়ে যায়-সে দৃশ্য কি এরা দেখেছে? বউ কথা কও পাখি বা কোকিলের কুহুতান কি এই জেনারেশনকে আবেগে আপ্লুত করে?
এই জেনারেশন থার্টি ফার্স্ট নাইট ভালোভাবেই উদযাপন করে, এই নাইট নিয়ে নানা প্ল্যনিংও করে -তা আমি জানি।Happy new year লিখে এরা আত্মতৃপ্তি পায়। আচ্ছা, এদের কাছে নববর্ষ কি একই আনন্দের বারতা নিয়ে আসে? নাকি নববর্ষ পালনকারীরা ব্যাকডেটেড?.......


আমার নিজস্ব হাইপোথিসিস আপনাদের বলি।যে জেনারেশন আমাদের সাহিত্যের হৃদয়-স্পন্দিত কবিতাগুলোকে অনুধাবন করবে, যে জেনারেশন আমাদের সাহিত্যর মর্মস্পর্শী গল্প-উপন্যাসে বিচরণ করবে, যে জেনারেশন মাটি ও মানুষ সংশ্লিষ্ট আমাদের জীবনঘনিষ্ট মুভিগুলো দেখবে, যে জেনারেশন বাংলার প্রকৃতিতে ব্যাকুল হবে--সে জেনারেশনের প্রাণশক্তি হবে অটুট্, সে জেনারেশন হবে পজিটিভলি উচ্ছ্বল, সে জেনারেশন হবে শুভ্রতার ধারক ও বাহক। অশুভ শক্তি সে জেনারেশনকে ডাইভার্টেড করার ক্ষমতা রাখে না, এটি সম্ভব নয়।এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস...


#পরিশিষ্টঃ


নিউ জেনারেশনের এই যে ডাইভার্সন তার পেছনে কিন্তু আমরা কিংবা আমাদের অগ্রজরাই দায়ী, আমরা সঠিকভাবে আমাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে ডাউনওয়ার্ড ট্রান্সমিট করতে পারিনি।একারণেই এরা Frustrated হয়, Suicidal attempt নেয়, রুক্ষভাবে অগ্রজদের কাছে গার্লফ্রেন্ডকে প্রেগন্যান্ট করার কথা বলতে পারে কিংবা সর্বনাশা ইয়াবাতে জীবনের অর্থ খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করে। নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধারণ ও সেটাকে লালল করাটা এই কারণেই জরুরী।


লেখাটা শেষ করি।জেনারেশন টু জেনারেশন- পরিবর্তন আসবে, সেটা স্বাভাবিক।কিন্তু আমাদের যে বেসিক মূল্যবোধ বা নীতি সেখানে তো পরিবর্তন আসার কথা না! আমাদের পরবর্তী জেনারেশন কি সঠিক পথে এগোচ্ছে? নিজের এক্সপেরিয়েন্স শেয়ার করলাম।কি মনে হয় আপনাদের? সমাজের এই আমূল পরিবর্তন কি গ্রহণযোগ্য? দৃশ্যমান পরিবর্তন নিয়ে আমরা ঘাটাঘাটি করি, অদৃশ্য এই ভয়ঙ্কর সামাজিক পরিবর্তন যে আমাদের চূড়ান্ত ধ্বংসের সূচনা করছে--তা কি আমরা বুঝতে পারছি?

.________________

 

ডা. জামান অ্যালেক্স । অনন্য কথা শিল্পী।

আপনার মতামত দিন:


মন জানে এর জনপ্রিয়