Ameen Qudir
Published:2017-12-22 18:44:17 BdST
ওসিডি ডায়েরি ১৪ম্যাডাম, আমি রান্না করলে সবাই অাতঙ্কে থাকে; বলে রান্নার ঢঙ্গিনী আসছে
ডা. সুলতানা আলগিন
সহযোগী অধ্যাপক , মনোরোগবিদ্যা বিভাগ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
____________________________
পয়ত্রিশ বছর বয়সী ভদ্রমহিলা । গ্রামেই থাকতেন । এখন শহরে থাকছেন। দালানকাঠার শহরে মানুষের শখের নমুনা গুলো বলা শুরু করলেন ।
তিনি অবলীলায় সব খুলে বলছিলেন।
বললেন,
যেমন ছোটবেলা থেকে তাদের বাড়ীতে হাস মুরগী কবুতর টিয়া ময়না, গরু ছাগল পালতে দেখেছেন। ঢাকায় পাখী কুকুর বেশী পালে লোকজন। এগুলোর ব্যবসাও করে অনেকে। ফেসবুকে কতরকমের দামী দামী কবুতরের ছবি দেখেছি আপা । আগে পাখপাখালী ধরা; ওদের নিয়মিত খেতে দেওয়া অনেক আনন্দের ছিল। অথচ এখন যদি শুনি কেউ বাসায় এসব পাখী,জন্তুজানোয়ার পালে সেই বাসায় আমি যাই না। বিশেষ করে কবুতর পালে যে বাসায় ।
কিন্তু‘ কেন?
সে জানাল, কবুতরের পায়খানা অনেক বিষাক্ত । মাথায় পড়লে সব চুল পড়ে যায়। মুখের ভেতর গেলে কলিজা নাড়ীভুঁড়ি সব ফুটা হয়ে যায়।
তাকে সহজ করে বুঝিয়ে বললাম, গাছের তলায় দাঁড়ালে কাকের পায়খানা কত আমার মাথায় ঘাড়ে অ্যাপ্রনে পড়ল? কই তেমন কিছুতো দেখলাম না । সেক্ষেত্রে কি হবে?
কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সে। কোনরকম উত্তর দিল না। বরং নিজেই অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। বলল তাকে কে যেন গল্প বলেছে ক্যান্সার মানেই পোকা। ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের সারা শরীরে পোকা হেটে বেড়ায় । তাদের ধারে কাছে গেলে পোকা উড়ে গায়ে চলে আসবে।
গতসপ্তাহে তার স্বামী ক্যান্সার আক্রান্ত আত্মীয়কে দেখতে গিয়েছিল কিন্তু তাকে বাসায় ঢুকতে হয়েছিল সম্পূর্ণ গোসল করে। আর তার কাপড়গুলো সারা রাত বাইরে ছিল। পরেরদিন বুয়া এসে ধুয়ে শুকিয়ে ঘরে তুলেছিল। তার কাছে মনে হয়েছিল কাপড়গুলোর দিকে তাকালে পর্যন্ত পোকাগুলো তার শরীরে ঢুকবে।
এখানেই শেষ নয়। রোগী আরও জানাল,
আপা আমার আরও সমস্যা আছে ।
বললাম,
বলেন । তাড়াহুড়োর কিছু নেই ।
ভদ্রমহিলা জানালেন আমি সাদা লো-কমোডে/প্যানে বসতে পারিনা।
আমি প্রশ্ন করলাম কেন? সাদা বাদে অন্য রং এর কমোডে বসতে অসুবিধা হয় না?
--ঠিকই বলেছেন আপা। অন্য রং এ আমার সমস্যা হয় না । সাদা রং এর কমোডে দুইপা ছড়িয়ে বসলে মনে হয় আমি কোরআনশরীফের উপর বসেছি।
( প্রিয় পাঠক, এসব একদম জলন্ত সত্য গল্প। রোগীদের মুখে শোনা কাহিনি। এটা রোগ । সকলের সচেতনতার জন্য যা সত্য ; তার ভিত্তিতেই লিখছি )
রোগী বলললেন, আমার তখন পায়খানাপ্রসাব আটকে যায়। কি যে কষ্ট হয় আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারবো না। আমার চোখের সামনে রেহেলের উপর রাখা কোরআনশরীফের ছবি ভেসে ওঠে। সাদা রং এর পাপোশে পা দিলে মনে হয় কোরআনের পাতায় পা পড়ে গেল। নীচে যে কত বার তাকাই কোথাও আরবী লেখা আছে কি না খুজতে থাকি ।
তিনি খুবই কষ্টমাখা ব্যাকুল কন্ঠে বললেন,
আপা এখন আমার কিছুই ভাল লাগে না। অল্পতেই বিরক্ত লাগে । আমি যৌথপরিবারে থাকি। সামান্য বিষয়ে আমি খুব রিঅ্যাক্ট করি। ঝগড়াও করি। যে কোন কাজ করেই হাত ধুই । না ধুলে শান্তি পাই না। ১০-১২ বার দরজা চেক করি। আমার পরিপাটি করে ভাজ করা কাপড় যে কোন লন্ড্রী থেকে আনা কাপড়ের থেকেও নিখুত। আমার জা ননদেরা হেসে বলে আমি কোন হোটেলে লন্ড্রীর কাজ নিলেই পারি । সংসারে বাড়তি আয় হতো।মনে মনে বিরক্ত হই। কোন রান্না করলে সেটা জনে জনে জিজ্ঞাসা করতে থাকি কেমন হয়েছে ?
প্রথমদিকে সবাই চেখে দেখতো । কেউ বলতো লবণ হয়েছে ।কেউ বলতো ঝাল কম হয়েছে । কেউ বলতো মজা হয়েছে। আর এখন আমাকে কেউ রান্নাঘরে রাধতে দেখলেই এড়িয়ে যায়। বিরক্ত হয় । কানে কমেন্টও আসে এতবার জনে জনে রান্নাকরা খাবার দেখানোর ঢং কেন করি।
মহিলা বলতে গিয়ে পারলে কেঁদে ফেলে।
ম্যাডাম, আমি রান্না করলে সবাই অাতঙ্কে থাকে; বলে রান্নার ঢঙ্গিনী আসছে ।
আপা, আসলে আমি ঢং করি না। জেনে স্বস্তি পাই। উত্তর না পেলে আমার ভীষণ অস্ব^স্তি হয় । মাথার চুল টেনে ছিড়তে ইচ্ছে করে। আমার রাগ দিনেদিনে বেড়ে চলেছে । আমাকে সাহায্য করেন। আপা,আমার রাগটা কমিয়ে দেন ।
ভদ্রমহিলাকে জানালাম উনি ওসিডি রোগে ভুগছেন। শুধুমাত্র বারবার ধোয়া,চেক করা লক্ষণগুলোই আমরা জানি । কিন্তু এর বাইরেও যে লক্ষণ আছে তা আমরা হেসে উড়িয়ে দেই। আপনার ভিতরে যে অস্থিরতা তৈরী হয় তা প্রকাশ না করতে পারলেই আপনার রাগ বিরক্তি বেড়ে যায়। আর এই রাগ অস্থিরতা কমাতে হলে নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে । সিরোটনিন সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। ফ্যামিলি কাউন্সেলিং এর প্রয়োজন আছে। তাদের সহযোগিতা ছাড়া এগিয়ে যাওয়া কষ্টকর।
কিছু দরকারি পরামর্শ
________________
বি:দ্র: সিরোটনিন সমৃদ্ধ খাদ্যের একটা ছোট তালিকা দেয়া হলো। এসব খাবার আমাদের দেশে সবখানেই পাওয়া যায়। তবে কারও যদি কোন খাবারে নিষেধ থাকে তবে সেগুলো বাদ দিয়ে অন্যান্য আইটেম আপনার প্রতি বেলার খাবারে রাখতে পারেন। ওষুধের পাশাপাশি এসব সিরোটনিন সমৃদ্ধ খাদ্য আপনার শরীরে সিরোটনিনের চাহিদা মিটাবে ।
আমিষ জাতীয় খাদ্য:মাংস,কলিজা,ডিম ,দুধ ও দুধ জাতীয় দ্রব্য, সামুদ্রিক মাছ
ফলমূল :পাকা কলা,আনারস, খেজুর, বাদাম, আম,আঙ্গুর,এ্যাভোকেডো
শাকসব্জি: পালং শাক,পুইশাক,বেগুন, শিম জাতীয় বীজ,ফুলকপি, ব্রকলি, টমেটো, মাশরুম
।
________________________
প্রিয় সুজন ,
আপনি কি অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার (ওসিডি) বা শুচিবাই রোগে
ভুগছেন ?
একটু সময় দিতেই হবে আপনাকে আপনার ও সকলের স্বার্থে। প্রশ্নগুলো পড়ুন অনুগ্রহ করে।
১।আপনি কি অতিরিক্ত ধোয়া-মোছা করেন অথবা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকেন?
২।আপনি কি কোন কিছু অতিরিক্ত চেক/ যাচাই-বাছাই করেন?
৩। আপনার মাথায় কি কোন অপ্রীতিকর/ অনাকাঙ্খিত চিন্তা আসে ? যা কিনা আপনি চাইলেও মাথা থেকে সহজে বের করতে পারেন না ?
৪।আপনার কি দৈনন্দিন কাজ শেষ করতে অতিরিক্ত সময় ব্যয় হয়?
৫। আপনার মধ্যে কি আসবাবপত্র, বই খাতা, কাপড়-চোপড় অথবা যে কোন জিনিস নির্দিষ্ট ছকে গুছিয়ে রাখার প্রবণতা আছে ?
উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর যে কোন একটির উত্তরও যদি হ্যাঁ বোধক হয় তবে মানসিকরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন ।ভুক্তভোগীদের ওসিডি ক্লিনিক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকায় প্রতি মঙ্গলবার , সকাল ১০টা থেকে ১টায় অাসার অনুরোধ রইল।
এ জন্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকার আউটডোরের মাত্র ৩০ টাকার টিকেট নিতে হবে।
লেখার সৌজন্য
ওসিডি ক্লিনিক । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। প্রতি মঙ্গলবার ।
____________________________
ওসিডি ক্লিনিক পরিচালনা করেন,
ডা. সুলতানা আলগিন ।
আপনার মতামত দিন: