Ameen Qudir

Published:
2017-12-11 01:38:46 BdST

রোগ কাহিনী "স্যার,গাজাখোরদের রুখতে গিয়ে নিজেই গাজা সেবী হয়ে গেলাম"


 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

প্রফেসর ডা. তাজুল ইসলাম
সোশাল সাইকিয়াট্রিস্ট
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
কমিউনিটি এন্ড সোশাল সাইকিয়াট্রি বিভাগ
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল,ঢাকা
___________________________________


আমি রোগ কাহিনী লিখি নিছক কোন বিশেষ রোগ কি,কেন,প তা বলার জন্য নয়।এগুলো বই পড়লেই জানা যায়।আমি লিখি সে সেসব কাহিনী যেগুলো থেকে সমাজ,পরিবার,জনগনকে কিছু ম্যাসেজ দিতে পারি। সচরাচর এর মতন কাহিনী শেষে এবার ও কিছু ম্যাসেজ দিচ্ছি।

 

কাহিনী সংক্ষেপ : আহমেদ ( ছদ্মনাম) , বয়স ২৪। বিবিএ এর শেষ বর্ষের ছাত্র। ইন্টার পড়ার সময় ম্যাচে থেকে পড়তো।ওখানে ১ ছেলে তার দলবল নিয়ে গাজা খেতো।দুর্গন্ধে রুমে থাকা কঠিন হতো।আহমেদ বুঝতে পারতো না এগুলো কিসের গন্ধ।তখন পর্যন্ত গাজা কি তা সে চোখে দেখেনি।সে এ নিয়ে তার এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে।বড় ভাই বল ওরা গাজা খায়,তাই এ দূর্গন্ধ,তুমি এদের এভয়েড করে চলেো।
আহমেদ বলে, কিন্তু তারা এতো বেশী পরিমানে খাওয়া শুরু করে যে আমার লিমিট ক্রস করে।তদুপরি ঐ দিন আমার এক রিলেটিভ আসে,যাকে সে গালি দেয়।রিলেটিভ রুমের ভিতর ছিল।সে গাজা খেয়ে টাল হয়ে আসে।রিলেটিভ দরজা খুলতে দেরী হওয়াতে সে দরজায় লাথি মারে।এ নিয়ে বাদানুবাদ হয় ও সে রিলেটিভকে গালিগালাজ করে।রিলেটিভ তার নেশার কথা তার বাবাকে বলে দেবে বলাতে সে বলে,বলে লাভ নেই বাবা সবই জানে।

 

পরদিন সকালে সে তার নেশাখোর বন্ধুদের নিয়ে গাজা টানছে,আমি বলি এতো পোলাপান কেন? বের হও।তারা পাত্তা দেয় না।তখন অন্য বড় ভাইদের ঢেকে এনে প্যাঁদানি দেই( চড়- থাপ্পড়, ধাক্কা ধাক্কী)। সবাইকে বললাম এর সঙ্গে কেউ মিশবে না,কারো রুমে সে যেতে পারবে না।
পরদিন রাতে এসে সে আমার পা ধরে কান্নাকাটি করে।আমার মন নরম হয়ে যায়।এরপর তার বাবা আসে এবং তিনি ও বলেন বাবা আমার ছেলেকে দেখে রাখি ও, আমি ওকে কন্ট্রোল করতে পারিনি।
তার বাবা জানায় সে ছোটকাল থেকেই নেশা করে।তার বাবা হচ্ছে শ্রমিক লীগের নেতা।ছেলেকে ভালো করার জন্য তাকে ৬ মাস জেলে ও রাখেন।সে লাখ লাখ টাকা বিনষ্ট করেছে।বাইক চালিয়ে কয়েকবার এক্সিডেন্ট করেছে।পরে সে বাইক ও বিক্রি করে দেয়।

 

এ সব শুনে আমার মন আরো নরম হয়।ঐ ছেলে আমার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক করে।৬ মাস তার সঙ্গে চলি।একদিন সে আমাকে ঢেকে বলে আজকে তোকে এমন একটি জিনিস দেবো, খেয়ে যদি ভালো না লাগে আর কখনো খেতে বলবো না।শুধু একটি টান দিবি মাত্র। এতোদিন তোদের সব কথা শুনছি আজ আমার একটি কথা রাখ,মাত্র একটি টান.. ।
আমি এক টান দিলাম- বমি হয়ে গেলো,চোখ লাল হলো,শরীরে একটি ঝাকি অনুভব হলো।তাকে বলি কি খাওয়ালি,মারবি নাকি আমায়? এরপর শুয়ে পড়ি ও অনেকদিন পর একটি ভালো ঘুম হয়। ৪-৫ দিন পর অন্য এক বন্ধুর বার্থ ডে পার্টিতে কিছু নেশাখোর ও অপরাধী বন্ধু হাজির হয়।তারা দেদারসে মদ খাচ্ছে, বলে খাও।আমি বাসায় চলে যাই।তারা মনে করছে আমি রাগ করেছি,তাই তারা আমাকে নিতে আসে।সেখানে গেলে দেখি তারা গাজা খেয়ে রুম ধুয়ায় ভরে ফেলেছে
আমি মনে মনে ভাবি,এরা এতে কি মজা পায়? এসব তো করে লো ক্লাশের লোকেরা।এক বন্ধুকে বলি এরা এ সব থেকে কি পায়? সে বলে খেয়ে দেখ।আমরা ৪ বন্ধু ছিলাম,ভার্সিটির ও মেডিকেলের বন্ধু ছিল।ওদের একজন বলে এতে যদি কিছু না থাকতো লালন এগুলো নিতো কেন? রাজনীতি করলে,সাহিত্য করলে এগুলো লাগে।নাহলে কবিতা,সাহিত্য হয় না।

 

১ সপ্তাহ পর আমার গার্ল ফ্রেন্ড বলে ফ্যামিলি বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে, পড়াশোনা করে কি হবে বিদেশ চলে যাও।অন্য এক বন্ধু বলে এই মেয়ের সঙ্গে আরো অনেকের সম্পর্ক আসে।এ সব কারনে মন খুব খারাপ হয়। ঐ বন্ধুকে ঢেকে ৫০ টাকা দেই গাজা আনতে( তখন আমার খুব কান্না পাচ্ছিল) । সে গাজা আনে।আমি খাই আর বমি করি।এভাবে রাত ২টা পর্যন্ত নেশা করি।সবাই তখন জেগে যায়।তখন তাদেরকে বান্ধবীর কথা বলি
।বান্ধবীকে না জানিয়ে তার কলেজে যাই।গিয়ে শুনি সে নাই।খোজ নিয়ে জানি তার বান্ধবী ও তার বন্ধুকে নিয়ে ঘুরতে গেছে।আরো গোয়েন্দা লাগিয়ে জানি সে রাতে কার সঙ্গে নিয়মিত ফোনে কথা বলে।

 

মন খুবই খারাপ হয়ে যায়।রুমে ওরা মনির খান,আসিফের গান বাজাতো। এতে আমি ক্ষিপ্ত হতাম।ঐ বন্ধু বলে ঐ মেয়েকে ভুলতে চাইলে এটি খাও।খেয়ে দেখি কিছুটা ভুলে থাকা যায়।এভাবে নেশা পুরোদমে শুরু হলো।
একটানা ৪ বছর নেশা করি।পরে ফ্যামিলি জেনে যায়।আমি নিজেই জানতে চেষ্টা করি এটির গুনাবলি ও ক্ষতির কথা।নিজকে প্রশ্ন করি এটি খেয়ে কি লাভ হলো?
কারা খাচ্ছে? জানলাম লালন খেতো না,নজরুল, রবীন্দ্রনাথ ও খেতো না।আমার ভবিষ্যৎ কি হবে? এসব আত্ম জিজ্ঞাসা করে উপলব্ধি করি ভুল করেছি।ভবিষ্যৎ অন্ধকার।তাই নিজ চেষ্টায় ১ বছর আগে নেশা ছেড়ে দেই।
তবে যারা আমার সঙ্গে গাজাখোরদের রুখতে চেয়েছিল তাদের অনেকেই আমার মতন নেশায় জড়িত হয়ে পড়ে এবং এখন ও নেশায় ডুবে আসে,বের হতে পারছে না।ইনশাল্লাহ আমি পেরেছি।
তবে এরপর থেকে বিবিধ শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দেয়।একজন নিউরোলজিস্ট দেখাই।তিনি এমআরআই থেকে শুরু করে অনেক পরীক্ষা করান ও অবশেষে মানসিক রোগের ঔষধ দেয়,কিন্তু কারো কাছে রেফার করে না।

 

।পরে প্রফেসর কাজী দীন মোহাম্মদ স্যারের কাছে গেলে তিনি আপনার কাছে রেফার করেন।
এ কেইস থেকে যে ম্যাসেজ আমরা নিতে পারি:
১। মাদক নেশা যে কাউকে আক্রান্ত করতে পারে।এমনকি যারা এগুলো খারাপ জেনে প্রথমে প্রতিরোধ করতে যায়,তাদের অনেককেই পরে নেশাগ্রস্ত হতে দেখেছি।তাই সবাইকে সতর্ক ও সাবধান থাকতে হবে।

 

২। নেশা করে সাধারনত ছোট কাল থেকে বখে যাওয়া,আচরন সমস্যা গ্রস্ত ছেলে মেয়েরা।যেমন আহমেদ এর ঐ বন্ধু।এরা অল্প বয়স থেকে নেশা শুরু করে,অপরাধে জড়িত থাকে,ভালো করা কঠিন।তবে ভদ্র, সুবোধ, মেধাবী,ভালো ছেলে মেয়েরা ও নেশার জগতে ঢুকে পড়তে পারে।যেমন আহমেদ। এরা সাধারনত পরিস্হিতির শিকার হয়,অপরাধ প্রবনতা তেমন থাকে না এবং তুলনামূলক ভাবে ভালো করা সহজ।
৩। নেশার ব্ল্যাক হোল গহ্বর থেকে বেরুতে হলে দুটি বড় গুন অর্জন করতে হয়: এক হচ্ছে নেশা করার খারাপ দিক ও ভালো দিক সম্বন্ধে ব্রেইনের অবচেতন মনের নেট ক্যালকুলেশন( পারসিভড লাভ- ক্ষতির হিসাব)। আমরা সবাই যেমন জানি মাদক নেশা খুব খারাপ জিনিস,মাদকাসক্তরা এরচেয়ে ভালোভাবে জানে এটি কত ক্ষতিকর। তথাপি তারা নেশা ছাড়তে ভিতর থেকে তেমন মোটিভেশন পায় না কেন?
তার কারন আসক্ত ব্রেইনের এই লাভ- লোকসানের ক্যালকুশেন সম্পূর্ণ ভিন্ন।ব্রেইন সার্বক্ষণিক ভাবে প্রনোদনা দেয়,মোটিভেট করে, উদ্বুদ্ধ করে মাদক নেওয়ার জন্য, কেননা তার অন্তর্গত হিসেব হচ্ছে মাদক খুবই আনন্দদায়ক, এটি ছাড়া সে অচল,জীবন আনন্দহীন ও কষ্টের।
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে পারসিভড কমপিটেন্সী- যত দুরুহ হোক,কঠিন হোক আমি এর উপর বিজয় অর্জন করতে সক্ষম। আমি পারবো এই প্রবল বিশ্বাস ও আস্হা।অথচ বিভিন্ন কারনে মাদকাসক্তদের মধ্যে এই পারসিভড কম্পিটেন্সীর ঘাটতি থাকে।তাদের অবচেতন মন বিশ্বাস করে নেশা ত্যাগ
করা অসম্ভব, কোন চিকিৎসায় এটি ভালো হয় না।আমি আগে পারিনি ও কখনো পারবো না।

 


মাদকাসক্তির যত চিকিৎসার কথা বলা হোক, সব চিকিৎসার মূল বিষয় হচ্ছে রোগীদের ভিতর পারসিভড বেনিফিট এর ক্যালকুশেন বদলিয়ে এটি যে সাময়িক আনন্দের চেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতির কারন তা রোগীর অবচেতন মনে বার বার সচেতনভাবে জাগরূক রাখা।
এর সঙ্গে তাদের পারসিভড কম্পিটেন্সীর ধারনা বদলে দিয়ে অবচেতন মনকে বিশ্বাস করানো ও আস্হায় আনা যে তারা মাদক মুক্ত থাকতে সক্ষম।এ দুইটি কাজ যে কাউন্সিলর যত ভালোভাবে করতে পারবে তিনি তার রোগীকে তত উত্তরনের পথে নিয়ে যেতে পারবেন।
আহমেদ আচরন সমস্যা গ্রস্ত ছিল না,মেধাবী ছিল,পরিস্হতির শিকার ছিল,সর্বোপরি সে নিজেই উদ্যোগী হয়ে গাজার ক্ষতির ও ভালো দিক,নেশা কারা করে,এর আদৌ কোন উপযোগীতা আছে কিনা- ইত্যাদি জেনে নিজ ইচ্ছাশক্তির বলে এ ফাদ থেকে বেরুতে পেরেছে।

 


৪। তবে দীর্ঘ দিন মাদক নিলে ব্রেইনে কিছু পরিবর্তন ঘটে যায়।তাই মাদক ছাড়লেও অনেক শারিরীক ও মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে
যা আহমেদ এর বেলায় ও ঘটছে।যদি এগুলোর ভালো চিকিৎসা না হয়,যেকোনো সময় তারা আবার মাদক নেওয়া শুরু করতে পারে।রোগী ও অভিভাবকদের তাই মনোচিকিৎসকদের পরামর্শ গ্রহন অব্যাহত রাখতে হবে।
৫। মানসিক ও মাদকাসক্তি চিকিৎসা মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কাজ।অন্য কারো কাছে এরা গেলেও যথাযথ জায়গায় রেফার করা বান্চনীয় ।

আপনার মতামত দিন:


মন জানে এর জনপ্রিয়