Ameen Qudir
Published:2017-08-13 22:06:51 BdST
ফ্যানটাসি ডেথ
ফ্যানটাসি ডেথ
রূপঙ্কর সরকার
আমাদের প্রতিবেশি একটি রাজ্যের মতো ন্যূনতম পাঁচ সন্তান প্রসব করেননা বাঙালিনীরা। আজকাল মেয়ে হোক বা ছেলে, একটিই হয় অধিকাংশ দম্পতির। কিছু ব্যতিক্রমীদের দুটি। তার বেশি বাঙলাভাষী শিক্ষিত মানুষজনের মধ্যে দেখা যায়না বড় একটা। তাও সেটি যদি অকালে ঝরে পড়ে, তো বাকিটা জীবন তাঁরা কী নিয়ে কাটাবেন।
অনেকের সন্তানকে খোয়াতে হয় মারণ ব্যধির প্রকোপে। অনেকের কোনও দুর্ঘটনায়। সবকটিই আজীবন শোক বহন করার কারণ। কিন্তু আর এক রকমের দুর্ঘটনা আজকাল সংক্রামক ব্যধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে ১৪-১৯ এই বয়সবন্ধনীতে এবং এর কবলে পড়ে প্রধাণত ছেলেরা।
মা বাবারা তাদের প্রতিটি আচরণ একটু খুঁটিয়ে দেখবেন দয়া করে। এমন একটি কাণ্ড ঘটে যাওয়ার পর বেশ কিছু মানুষ হারানো ছেলের বন্ধুবান্ধবের ওপর এফ আই আর দায়ের করে তাদের মাতাপিতার ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। যাঁদের তা করার থাকেনা, তাঁরা অদৃষ্টকে দোষ দেন। কিন্তু টাইমলি ইন্টারভেনশন এ জিনিষ আটকাতে পারে সঠিক কাউন্সেলিং করানো গেলে।
আমি এ রোগের নাম দিয়েছি ‘ফ্যান্টাসি ডেথ’। আমাদের মানসিক চিকিৎসক বন্ধুদের হয়ত অস্ত্রাগারে অন্য কোনও নাম আছে এ রোগের।
আজই টিভি খুলেছিলাম খাবার সময়ে নিত্যকার মতো। হচ্ছিল পুরভোটের খবর। বন্ধই করে দিতে যাচ্ছিলাম সেই প্রহসনের সংবাদ। হঠাৎ পাঠিকা পড়লেন অন্য এক খবর – অঙ্কনের মৃত্যু। ব্যস্ত শহরে নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক প্রাণবন্ত কিশোর গতপরশু আত্মহত্যা করেছে, তাও বড় অদ্ভুত ভাবে। কাল অবধি সাইবার গেম ‘ব্লু হোয়েল’ কে দোষ দেয়া হচ্ছিল। যদিও এই জঘন্য খেলা কেউ খেলছে দেখতে পেলেই তাকে তৎক্ষণাৎ মানসিক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত এবং সরকারের তরফ থেকে গরুতে ‘বিপ’ না বসিয়ে এটাকে অবিলম্বে ব্যান করা উচিত, এক্ষেত্রে তার নাকি সে খেলায় অংশ নেবার কোনও প্রমান পাওয়া যায়নি, তা আজ শুনলাম খবরে। নানা কারণ অনুসন্ধান করতে করতে পুলিশ তার ডায়ারিতে বাংলা হরফে লেখা হিন্দী ভাষায় কিছু অদ্ভুত চিঠির হদিশ পেয়েছে। আমি জানি এটি কী রোগ। আমি চোখের সামনে এমন মৃত্যু দেখেছি।
এ কিশোর গলায় দড়ি দিয়ে ঝোলেনি কোথাও থেকে। প্লাস্টিকে মুখ ঢুকিয়ে দড়ির ফাঁস দিয়েছে মাটিতে দাঁড়িয়ে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তার ধারণা ছিল মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে কেউ এসে বাঁচাবে। হয়ত সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকবে কিছুক্ষণ। মারা যাবে জানলে সে ঝুলেই পড়ত। আমি যাকে চিনতাম, ঠিক এই বয়সের ছেলে। মা বাবার একমাত্র সন্তান। তার মা বাবা দুজনেই চাকরি করতেন স্বল্প আয়ের। নিজেদের শখ আহ্লাদ সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে সন্তানের সব শখ পূর্ণ করতে এক ইঞ্চি জমি ছাড়েননি তাঁরা। তাঁদের বাড়িতে গিয়ে মা বাবার ঘরে বিবর্ণ আলনা আর ছেলের ঘরে আধুনিকতম গ্যাজেট সমাহার দেখলে মায়োপিক মানুষও বুঝতেন সেটা।কলকাতার খুব দামি স্কুলে পড়াতেনও তাঁরা একমাত্র সন্তানকে।
সে ছেলে বলে বেড়াত, কোন এক মাফিয়া গ্রুপ নাকি তাকে খুঁজছে। কোনও এক কালো অ্যাম্বাসাডর(গাড়ি) নাকি তাকে ফলো করে রোজ। আমি তার সঙ্গে কথা বলেছিলাম।
তাকে জেরা করতেই খান খান হয়ে যাচ্ছিল তার গল্প। তার মা বাবাকে সাবধান হতে বলে পাঠিয়েছিলাম। তাঁরা সুযোগ পাননি সম্ভবত। সে নিজের পাজামার একটি পা গলায় জড়িয়েছিল। তার কি দৃঢ় বিশ্বাস ছিল এতে সে একেবারেই মারা যাবে? একঘন্টা আগেও সে পাশের বাড়ির বাচ্চা মেয়েকে ডেকে তার সঙ্গে ইয়ার্কি মেরে পেছনে লাগছিল হাসিমশকরা করে। তবে যখন সে গলায় পাজামা জড়ায়, তখন তার ঘরের দেওয়াল জুড়ে জটায়ুর উপন্যাসের মত এক ভিলেন মার্কা নাম লেখা পেন্সিলে বা ফেল্ট পেন এ।
সে হয়ত ভেবেছিল তার ফ্যান্টাসির ভিলেন তাকে মারতে এসেছিল, এই দেখিয়ে সবাইকে চমকে দেবে। এই অঙ্কনের ডায়ারিতেও তেমনই কিছু লেখা।
যান্ত্রিক সভ্যতাকে ঠেকিয়ে রাখা যায়না, যাবেনা। তথাকথিত ‘উন্নয়ন’ চলছে চলবে। সকলেই উন্নয়নের কুফল বুঝতে পারলেও তার থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা কারও দেখা যায়না। কঠিণ মূল্য চোকাতে হয় কাউকে কাউকে। অন্যরা ভাবে, যাক, আমার তো কিছু হয়নি।
অত নিশ্চিন্ত হবেন না।
____________________________
রূপঙ্কর সরকার । জনপ্রিয় কথাশিল্পী।
আপনার মতামত দিন: