Ameen Qudir
Published:2017-04-04 16:00:52 BdST
জিনিয়াস মানেই কি যন্ত্রনা !
অধ্যাপক ডা.মো. তাজুল ইসলাম
______________________________
আবেগগত বুদ্ধি (Emotional Intelligence) কেন বেশী গুরুত্বপূর্ণ ______________
আপনি পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে অনেকদিন পর পুর্নমিলনী অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন।স্মৃতিকাতর হয়ে নিজের একটি আবেগঘন ঘটনা সংক্ষেপে তাদের কাছে শেয়ার করলেন।কিন্তু বেশীরভাগই আবেগহীন নিরুত্তাপ রইলেন।আপনি তাদের কাছে কোন সহানুভূতি কিংবা সহায়তা কামনা করেননি।তবে মমতা,দয়া,ভালোবাসা মিশ্রিত প্রতিক্রিয়া নিশ্চয় আশা করেছিলেন।একজনকে তো দেখলেন হৃদয়- মস্তিস্কের যোগাযোগ হীন(heart- brain connectionless)। অথচ অন্য বৈষয়িক ব্যাপারে তারা সোৎসাহে গল্পগুজব করছে" আমি ওমুক করেছি,ও সেটা করেছে"- ইত্যাদি। এখানে কিসের ঘাটতি ছিল? আবেগগত বুদ্ধি মত্তা(ই আই)।
আবেগগত বুদ্ধিমত্বা হচ্ছে- নিজের ও অন্যের আবেগ বোঝার ক্ষমতা,বিভিন্ন অনুভূতির মধ্যে পার্থক্য করতে পারা,সঠিকভাবে সেগুলো লেবেল করতে পারা এবং এ সব আবেগগত তথ্য ব্যবহার করে নিজের চিন্তা ও আচরনকে গাইড করতে পারা।
ধরুন আপনারা মিটিং করছেন।একজন সহকর্মী পথে ৩ ঘন্টা ট্রাফিক জ্যামে আটক থাকার কারনে বিলম্বে সভায় হাজির হলেন।তাকে ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত,উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। যার আবেগগত বুদ্ধি বেশী তিনি সহাস্যে এগিয়ে এসে উষ্ম অভ্যর্থনা জানাবেন,কেমন আছে তা জানতে চাইবেন,হয়তো ঠান্ডা পানির গ্লাস এগিয়ে দেবেন এমনকি হয়তো ৫ মিনিটের জন্য সভা স্হগিত করবেন তাকে ধাতস্ত হওয়ার সময় দেওয়ার জন্য। আর যাদের আবেগগত বুদ্ধি কম( তবে এদের বৈষয়িক,সামাজিক বুদ্ধি অতিরিক্ত থাকে) তারা তাকে নিয়ে উপহাস করবে,নিজেদের মধ্যে মিটিমিটি হাসবে,তাকে অকাজের,দায়িত্বহীন বলে প্রচার করবে।এক কথায় ঐ লোকের মনে বিষ ঢুকিয়ে দেবে,তাকে ছোট,হেয়,হীনমন্য করে বিকৃত আনন্দ অনুভব করবে।
পর্ব-২:আবেগগত বুদ্ধিমত্তার বৈশিষ্ট্য (Emotional intelligence) :
আবেগগত বুদ্ধি গড়ে উঠার পিছনে পরিবেশ ও " শৈশবে বেড়ে উঠার" ধরন(upbringing)ভূমিকা রেখে থাকে।
অনেক ভালো পরিবেশে মানুষ হওয়া ছেলে- মেয়েদের মধ্যে ও আত্মকেন্দ্রিকতা ও আত্মপ্রমের আধিক্য দেখা যায়।আবার পরিবারে অবহেলা,নির্যাতন বা দারিদ্রতা সত্বে ও দেখা গেছে তাদের অনেকের মধ্যে উচ্চতর আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা রয়েছে।
এর কারন হতে পারে তাদেরকে তাদের সেন্স গুলোকে তীক্ষ্ণ করে তুলতে হয়, যাতে তারা কঠিন পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারে।সময়ের সাথে সাথে তারা এই গুনাবলীকে আরো পরিশীলিত করে নেয়।
অন্যদিকে বিচ্যুত আচরন- স্বভাবের ছেলে মেয়েদের মধ্যে আবেগগত বুদ্ধি থাকে না বললে চলে।
ফলে তারা সঙ্গীদের সঙ্গে বা বাসায় খাপ খাইয়ে চলতে পারে না; জীবনে ভারসাম্য পূর্ন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী করতে পারে না; স্কুলে প্রত্যাশিত ফলাফল করতে পারে না; নিজকে শান্ত রাখতে বা করতে পারে না; সমস্যা সমাধানের কৌশল আয়ত্ব করতে পারে না।
আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার বৈশিষ্ট্য :
১। আত্ম সচেতন থাকা: নিজের আবেগকে জানা; কি আবেগে আক্রান্ত তা স্বীকার করে নেওয়া; ও বিভিন্ন আবেগের পার্থক্য বুঝতে পারা
২। ম্যূড ম্যানেজমেন্ট : বর্তমান সিচুয়েশন অনুযায়ী প্রাসঙ্গিক করে তোলার জন্য অনুভূতিগুলোকে হ্যান্ডেল করতে জানা এবং যথাযথ ভাবে প্রতিক্রিয়া করতে পারা
৩। সমমর্মী হওয়া(Empathy): সহানুভূতি (sympathy) ও সমমর্মী( এমপ্যাথী) এক বিষয় নয়।এটি হচ্ছে অন্যের অবস্হান থেকে তার আবেগ অনুভূতিকে বোঝা এবং তাদের সে প্রকাশ্যে বলা(verbal) ও না বলা ( নন ভারবাল) আবেগগুলোর সঙ্গে নিজের আচরনকে সামন্জস্যশীল করে নেওয়া।
৪। সম্পর্কগুলো ম্যানেজ করতে পারা: আন্তব্যক্তিক ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়াকে সঠিকভাবে হ্যান্ডেল করা; দ্বন্দ্ব নিরসন করা; ও নিগোশিয়েসন করতে পারা
৫। সেলফ- মটিভেশন:
আত্মসংশয়,নিষ্ক্রিয়তা,আবেগের বশবর্তী থাকা সত্ব্যেও নিজের ভাবাবেগগুলোকে একত্র করে , একটি উদ্দেশ্যমূলক লক্ষ্যে পৌছার জন্য নিজকে সঠিকভাবে চালিত করতে পারা।
(৩য় ও শেষ পর্ব- আগামী কাল)
পর্ব-৩:
আপনি কি অত্যধিক দুশ্চিন্তা করেন? প্রায়ই নিজকে অসুখী মনে হয়?
তাহলে গবেষনা বলে আপনি একজন জিনিয়াস ও মানব দরদী ।
আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার( emotional intelligence) সঙ্গে দুশ্চিন্তা,কষ্ট,উদ্বেগ,ভয় এমনকি আতঙ্ক জড়িত।আমাদের সাইকিয়াট্রিতে দুই ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়: একদল যারা টেন্ডার মাইন্ডেড-
এরা নরম মনের,কোমল স্বভাবের অল্পতে আঘাত পান, নিজের ও অন্যের কষ্ট সমস্যা নিয়ে বেশী ভাবেন,লজ্জা,ভয় বেশী,দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে সচেতন।
এরা উদ্বেগ,দুশ্চিন্তা, ভয়,আতঙ্ক,মনোবেদনা সহ নানা রকম মানসিক কষ্টের মধ্যে জীবন- যাপন করেন।এরা নিজের ও অন্যের জীবনকে আরো উন্নত, মানবিক করতে চান।
অন্য ধরনের হচ্ছে অতি টাফ মাইন্ডেড:
এমপ্যাথী বিহীন অর্থাৎ আবেগীয় বুদ্ধিহীন।
এরা পাষন্ড,নির্মম,নিষ্ঠুর,অনুতাপহীন,বিবেকহীন।এরা ভয় ভীতিহীন,বেপরোয়া, উদ্বেগ হীন,সমাজ ও নৈতিকতা বিরোধী।এরা অভিজ্ঞতা থেকে শেখে না,শিখতেও চায় না।
তবে আমাদের সমাজ আজ এদেরই নিয়ন্ত্রণে।( জীবনানন্দের কবিতা মনে আছে?" যারা অন্ধ তারাই আজ সবচেয়ে বেশী দেখে.... পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া)।
বুঝতেই পারছেন আবেগীয় বুদ্ধি বেশী হলে ওদের মতন দায়িত্বহীন,বিবেকহীন জীবন আপনি যাপন করতে পারবেন না।তাই দুশ্চিন্তা আপনার পিছু ছাড়বে না, এটাই স্বাভাবিক।
( ওরা কিন্তু আপনার এই ভালো মানুষীকে দূর্বলতা ভাববে,দূর্বল ব্যক্তিত্ব মনে করবে,হয়তো উপহাস এমনকি " পাগল" বলে ঠাট্টা করবে।কিন্তু মূলত তারাই হচ্ছে জটিল মানসিক রোগী যাদের শোধরানো কঠিন কাজ)।
বৈজ্ঞানিক গবেষনায় কি বলে:
লন্ডনের কিংস কলেজের নিওরোলজি অব পার্সোনালিটির বিশেষজ্ঞ ড. এডাম পারকিনস বলেন" আপনি যদি অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করেন বা অনেক চিন্তা মাথায় উদ্ভব হয় এবং এ কারনে উদ্বেগ বা আতঙ্ক অনুভব করেন তার কারন আপনার ব্রেইনে ইন- বিল্ট থ্রেট জেনারেটর রয়েছে।এটি হয় ব্রেইনের মেডিয়াল প্রি- ফ্রন্টাল কর্টেক্স এর অত্যধিক ক্রিয়াকলাপের জন্য। আবার তেমন কারন ছাড়া ভয়- আতঙ্কে ভুগছেন এমাগডেলার ব্যাসাল লেটারেল নিউক্লি এর অতিরিক্ত রিএকটিভিটির জন্য। "
এগুলো হচ্ছে আমাদের " স্যানিটি চেক" -
অর্থাৎ নিজে ও অন্যরা "মানসিক ও বিচারবোধের দিক থেকে সুস্হ", কিনা তা চেক করে নেওয়া।এগুলো দেখা যায় অনেক জিনিয়াসদের মধ্যে।
যেমন: আইজ্যাক নিউটন,চার্লস ডারউইন,ভিনসেন্ট ভ্যান গগ,কুর্ট কেভিন।
সৃজনশীলতা আর মনোযন্ত্রনা যে একসূত্রে গাথা এটি সবচেয়ে সুন্দর ভাবে বর্ননা করেছেন জন লেনন
"জিনিয়াস মানেই যন্ত্রণা "(Genius is pain)।
ব্রেইনের ঐ অংশগুলো আমাদের সফল মানব বিবর্তনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ ক্যাসল ডাউন স্টেট মেডিকেল সেন্টারের প্রফেসর ড. জেরেমি কপলান বলেন" সব সময় হেসে খেলে জীবন কাটায় যারা তাদের চেয়ে যারা অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করে, তারা সম্ভাব্য বিপদ থেকে নিজেদের ও অন্যদের রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।এভাবে তারা মানব প্রজাতির টিকে থাকার ক্ষেত্রে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে থাকে"।
_______________________________
অধ্যাপক ডা.মো. তাজুল ইসলাম: দেশের জনপ্রিয় লেখক কলামিস্ট। সুবক্তা। সোশ্যাল সাইকিয়াট্রিস্ট। অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কমিউনিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি বিভাগ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা
আপনার মতামত দিন: