Ameen Qudir

Published:
2016-12-04 23:07:46 BdST

পোঈয়ের দেশে ৪খোদ চীনে জামাই আদর



_________________________
ডা. নুরুল হাসান বাবু
_____________________________

গাড়ীতে দশমিনিট পথ পাড়ি দিয়ে কুনমিং চ্যাংস্যুই বিমানবন্দর থেকে মিঠু সাহেবের কুনমিং বিক্রমপুর বোর্ডিং হাউস পৌঁছালাম ।
বাহিরের চেহারা দেখে মেয়ে আমার বা...বা বা..বা করে আপত্তি জানাচ্ছিল। মেয়ের মা তো আমার দিকে তাকাচ্ছে আর 'মার্ক জাকারবার্গকে' অভিসম্পাত করে যাচ্ছে নিশ্চিত। আমিও একটু দ্বিধায় পড়ছিলাম ।

গাড়ী এক্ষুনি ছাড়তে হবে , আবার এয়ারপোর্টে যাবে অন্য ফ্লাইটে আসা গেষ্ট আসবে বোর্ডিং এ । মা-মেয়ে গাড়ী হতে লাগেজ মনে অনেক কষ্ট আর শংশয় নিয়ে নামাতে অনুমতি দিল ।

এক হাল্কা পাতলা তরুন আমাদের ৫৮ কেজি লাগেজ অত্যন্ত হাসিমুখে গাড়ী থেকে নামিয়ে তাদের সিড়িঁ পর্যন্ত নিয়ে যেতে লাগল । আমি সাহায্য করতে চাইলে বলে বসল , "থাক স্যার আপনি অনেক দুর থাইক্কা কষ্ট কইরা আসছেন , এই কাজে আমার কোন কষ্ট নাই আপনাদের সেবা দিতেই আনন্দ লাগে । " তার এই কটা শব্দই আমাকে গলিয়ে দিল ..। এতদূরে এই চীন দেশে আমার সোনার বাংলার তার মত উদ্যোমী হাসিমুখ কাজে আনন্দ খোঁজা দেশী ভাই আছে এটা ভেবে বুকের ছাতিতা আমার বেশ সম্প্রসারিত -
: কী নাম ভাই তোমার, প্রশ্ন করলাম
: দীদার- দিদারুল ইসলাম
: বাড়ী কোথায় ?
: মুন্সিগন্জ
: ওর নাম দিলদার বাংলা ফিল্মের জোকার ...পাশের এক ঘর থেকে ছিপছিপে আর এক তরুন বেরিয়ে বলল..
: হ জসীম্মা ...রুজিনা তো আর পাইবি না
দীদারের উত্তরে জসিমকে চিনলাম -যার জন্য আপাতত আজকে এখানে আসা।
: ভাই জসীম, আমি ডা: হাসান ,তোমার জন্য সব ফেলে এখানে এলাম, শুনলাম তুমি নেটে এক্সপার্ট..বলে আমার সমস্যা ও সমাধানের অনুরোধ জানালাম।
: সব হবে । আগে ফ্রেশ হন , খানাপিনা করেন ... কয় তলায় রুম নিবেন ?
: না আমরা এখানে থাকব না- আমার মেয়ের প্রতিবাদী কন্ঠ
: যাইবেন নি ! দিদারের বিষ্ময় ।
: আমি পরিস্তিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে বললাম ..তোমাদের ওয়াশরুম কোথায় , খাবার ব্যবস্থা কী এখানেই আছে ?
দিদার সিড়িঁ লাগোয়া ছোট্র একটা ড্রইংরুম দেখিয়ে বলল ওখানে যাইতে পারেন তবে ভাবীর জন্য তিনতালায় একটা রুম খুলে দি।
ওরা কিছু বলার আগেই কন্যা ও তার মাকে নির্দেশ দিলাম যাও রুমে গিয়ে ফ্রেশ হও আগে ...
আমার মাথার ভিতর ইন্টারনেট ...আর বান্ধবী Facebook ( শম্পার সংগায়)..
তাদের ড্রইংরুমে ঢুকে দেখলাম সাদামাটা ডিভান আর সোফার উপর বসা কজন গেষ্ট সবাই বাংলাদেশী ..
আমি আমার স্বভাবগত ভাবেই বললাম -আসসালামু আলাইকুম..
সালামের বড় গুন - দ্রুত র্র্যাপো বা সম্পর্ক স্থাপনে বা মিশতে সহায়তা করে ...একে একে বুঝলাম কেউ উচ্চ পদস্থ সেনা, কেউ বিসিএস কর্তা, একজন জাপান প্রবাসী অন্যজন কোরিয়ায় ব্যবসা করেন। এদের দেখে second confidence যুক্ত হল মস্তিস্কে
জসীম এসে বলল - টেবিল খালি আছে আপনারা এসে খেয়ে নেন ।
আমারও ক্ষুধা পেয়েছে ..আমার টীম কে ডেকে নিয়ে ওদের কিচেন কাম ডাইনিং রুমে ঢুকলাম ..
দেখি দিদার , জসীম আরও একজন ধুমছে রান্নার কাজে ব্যস্ত ..একজন রাঁধছে , একজন ডিস ক্লিন করছে অন্যজন মাছ বা মাংসের একটা পোটলার বরফ গলাচ্ছে... দারুন টীম ওয়ার্ক । সবাই নিষ্ঠানিয়েই হাসিমুখে কাজ করছে ...
কী খাইবেন রুটি না ভাত - জসিমের জিজ্ঞাসা
আমি বললাম কী আছে?
যা চাইবেন তাই খাওয়াবো ।
আমি হেসে কথার কথা ভেবে ডাইনিং রুমটায় ঢুকলাম । সাদামাটা ৬ সিটের টেবিল ..২ চেয়ারে আভিজাত্যের ঝিলিক দেয়া চেহারার দুজন বয়সী যুগল খাচ্ছেন ..দিদার এসে পরিচয় করিয়ে বলল এই আংকেল এর ইসকাটনে ....টা ফ্লাট ( সংখ্যায় ৪৫ কি ৫৫ টা ফ্লাট বলেছিল আমার সঠিক মনে নেই ) নুর মন্ত্রী, আলি যাকের ওনাদের ভাড়াটিয়া..।
মিঠু সাহেবের প্রতি এক বিশেষ শ্রদ্ধা জাগল মনে .. সে সত্য কথা বলেছে তার অতিথিদের সম্পর্কে ...যদিও ডলার একচেঞ্জের সময় সে বেশ একটা ব্যবসা সেরেছে আমার সাথে এই নিয়ে একটা সুক্ষ্ম খচখচে রাগও ছিল আমার ...সেটা অনেকটা হাল্কা এখন...মনে মনে বললাম কষ্ট করে সেবা দেয় বলেইতো এত উঁচু গেষ্ট তার এখানে ...লাভ তো করবেই ।
ভদ্রলোকের সাথে আলাপে জানলাম ঢাকা শহরে দুটো বাড়িতে পুকুর আছে একটা রাষ্ট্রপতির অন্যটা তার । নিশ্চই গর্ব করার মত....তাকে অহংকারীও মনে হল না আমার। আমার আর কোন পরীক্ষা দেবার খুব একটা ইচ্ছা নেই তবুও তথ্যটা মনে থাকবে চিরকাল ...।
টেবিলে নাম বলে বলে ১১/১২ পদের বাটি এনে দিল দিদার...ডাল, মুরগী, ডিম ভাজা , বেগুন ভর্তা , আমার প্রিয় আলু ভর্তা গড়াই (টাকী) মাছের ভর্তা ইত্যাদি ইত্যাদি ..রুই মাছের ভাজা রাখতে রাখতে বলল ইয়া বড় রুই মাছ ..আমাদের দেশের মত মরা মাছ না ... একুরিয়ামের জ্যান্ত মাছ ... মাছ পছন্দ হলে দোকানী হ্যান্ড নেটে তুলে মাছের মাথায় বড় মুগুর দিয়ে এক কোপে মেরে ফেলে সেই তথ্যও জানাল।
এই দূর দেশে এত দেশী খাবার ..! রান্নাও চমৎকার ..আমি কারো দিকে না তাকিয়ে মন ভরে খেতে থাকলাম ..শম্পা পেট একটু খালি রাখার ইঙ্গিত দিচ্ছে ..আমি বুঝেও না বোঝার মত চালিয়ে গেলাম ।
দিদার এটা খান ওটা নেন বলে অনুরোধ চালিয়ে যাচ্ছে ...কিছুক্ষন পর জসীম এক প্লেট ডিম ভাজা নিয়ে হাজির ...আর কী খাইবেন কন ? হাঁস খাইবেন ? কাল খাওয়ামু।
একি অবস্থা ! গ্রাহক খুশী করার এক অদ্ভুত প্রচেষ্টা তাদের । শ্বশুরবাড়ীর জামাই আদরের কথা শুনেছি -আজ এদের আয়োজন ও আতিথিয়তায় জামাই জামাই মনে হচ্ছে নিজেকে । (আমার শ্বশুর অবশ্য আমাকে জামাই না ছেলে ভাবেন তাই হয়ত জামাই আদর বুঝে উঠতে পারিনি।)

এক চীনা রুমে আসতে জসীম অনর্গল চীনা ভাষায় অনেকটা ধমকের সুরে কথা বলে কী যেন বলল। জানলাম সে ড্রাইভার তাদেরই কর্মচারী । সেই বৃটিশ থেকে আজ অবধি বাংলাদেশী বিদেশীদের গোলামী করে সেখানে উল্টা স্রোত ...হোক না ক্ষীণ ..তবুওতো আশা জাগানিয়া ।
জানলাম জসীম চীনা ছাড়া কাজ চালিয়ে নেবার মত জাপানি , কোরিয়ান ও অন্য ভাষাও জানে এবং শিখছে কারণ তাদেরকেও আনতে চায় গ্রাহক করে । এই বোর্ডিং এ এখনই জাপানি , ইন্ডিয়ান , নেপালী ও আসে বেশ জানলাম।এই দুর দেশে অতি অল্প শিক্ষিত কটা ছেলে কত সুন্দর কেবল শ্রমের পুঁজিতে কিভাবে বিজয়ী হচ্ছে ..,জয়তু।

দিদারের "দিলদার" নামকরনের কারণটা কিছু বুঝতে পেলাম ..আসলে সে কিছুটা কমেডিয়ান ব্যক্তিত্বের । সে নিজে নিজে বলে যাচ্ছে-
মিঠু ভাই ,আমি আর একজন যারে রান্না ঘরে দেখলেন আমরা সবাই বিক্রমপুর মুন্সিগন্জ ..জসীম্মা নোয়াখালী...আমাদের মূল মালিক শরীফ সাব ও মুন্সিগন্জ ..মিঠুর চাচা....একজন চাইনিজ চাচী আছে...দেশী চাচীর কদিন আগে বাচ্চা হইছে...সিনহা সাবরে চিনেন তো ...? একমি কোম্পানী.....উনি এক নম্বর আমি দুই নম্বর....
: তুমি দুই নম্বর কী ?- জিজ্ঞেস করলাম
: আসামী....পলিটিকাল কেইস...

খাবার শেষ হতে হতেই জসীমের জিজ্ঞাসা - চা খাইবেন তো আপনারা ? দুধ চা ..মসল্লা দিয়া বানাইয়া দেই...মামুনি তুমি দুধ তো খাও তোমারে এক গ্লাস দুধ দেই? অদ্ভুত যত্নআত্তি ! ক্লান্তিহীন সদাহাস্য আন্তরিক সেবা তাদের...অবিশ্বাস্য বাস্তব।কোনো আচরণই মেকি বা লোক দেখানো নয় ।
মেয়ে দুধ খাবে না জসীমের কথা শেষ হবার আগেই জানিয়ে দিল । ড্রইংরুমে বসে তৃপ্তির দুধ চা খাচ্ছি...এই চায়ের দেশে এমন মধুর চা আরও জুটবে কীনা কে জানে। মা-মেয়ে এখন বেশ হরিনী ও তার শাবকের ন্যায় শান্ত। মেয়ে কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলল বাবা জানি তুমি গলে গ্যাছ...কিন্তু আমার সুইমিং পুল...আজ Crown Plaza চল .কাল আংকেলদের এখানে আসি...প্লিজ বাবা। শম্পা বলতে থাকল-রুম গুলো কনজেসটেট সিম্পিল তবে পরিস্কার , বাথরুম অর্ডিনারী ..বাথের space নাই তবে আমরাতো সারাদিন বাহিরে থাকব শুধু রাতে এসে ঘুমাব|

আদর - স্নেহ- ভালবাসার কাছে মানুষ কত সহজেই পরাজিত হয় -হার মানে। অনেকগুলো ডলার পানিতে ফেলে নষ্ট করছি বলে যে আমাকে কিছুক্ষণ আগেই ভৎসনা করছিল সেই কীনা....!

চল আজ নুহার জন্য Crown Plaza য় যাই । চেষ্টা করে দেখি কালকের বুকিংটা cancel করে টাকাটা ফেরত পাওয়া যায় কিনা । মিঠু সাহেবকে central Kunming এলাকার আমাদের আগে বুকিং এর hotel এ যাবার সিদ্ধান্ত জানিয়ে বললাম একটা গাড়ীর ব্যবস্থা করতে ।
: কাল আমাদের একটা ভাল গাড়ী দিয়েন আর stop, water, toilet , ticket ,ও lets go অন্তত এই পাঁচ ইংরেজি শব্দ বুঝে এমন ড্রাইভার দিয়েন।
: কোন চিন্তা কইরেন না ,একটা নতুন ফোর্ড পাইবেন ,সাথে চাইনিজ মাল দেশী বোতলে .. । এক্কেবারে চাইনিজ বিলাই কিন্তু আমাগো দেশী তোতাপাখী....।
মোবাইলে ইন্টারনেট সংযোগ চালু আর ফেসবুক সচল রাখতে জসীমের সন্ধানে এই কুনমিং বোর্ডিং এ আজকে আসা। জসীম এসে আমার মোবাইলটা চেয়ে নিল
: ওমা এতো 6S Plus এটাতেতো কখনো কাজ করিনি!
: সব IPhone একই.. চেষ্টা কর পারবে -আমি সাহস দিলাম
: লন দেখি
বেশ কিছুক্ষণ সে নানা ভাবে চেষ্টা করে মোটামুটি ব্যর্থ হয়ে জানাল-
: চাইনিজ নেটওয়ার্কে ঢুকতে পারবেন ,তবে আপনার ফোন কোনো ভাবে VPN বা অন্য কোন প্রক্সি শেয়ার নেয় না Facebook , Google, Gmail , You tube পাইবেন না ।
: বলে কী ছেলেটা আর একটু চেষ্টা কর ভাই
: উঁহু আমি অনেক ট্রাই দিলাম ...কোন কাম হইতাছে না ।
আমার মনে শ্রাবণের মেঘ ...Gmail, you tube না হলেও হবে ..কিন্তু Google টা দরকার বেশ আর Facebook ছাড়া এই ১২ টা দিন আমি শ্বাস নিব কী করে .।


একটি ভিডিও ______________


___________________________

 

 

 

লেখক ডা. নুরুল হাসান বাবু । শক্তিমান কথাশিল্পী। তার হাতে যাদু আছে। পেয়েছেন ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা। ডাক্তার প্রতিদিনেও নিয়মিত লিখছেন তিনি।
Clinical Ultrasound Consultant at Popular Diagnostic Centre Ltd.
Works at Bangladesh Govt.
Former Assistant Registrar at National Institute of Mental Health
Studied Bachelor of Medicine & Surgery (MBBS) at Rangpur Medical College

আপনার মতামত দিন:


ভ্রমণ এর জনপ্রিয়