ডা শাহাদাত হোসেন

Published:
2022-06-15 19:26:51 BdST

"বাবাকে হারায়ে খোঁজা বার বার"ডাক্তার হওয়ার ক্ষেত্রে অধ্যাপক ডা. ইমরান বিন ইউনুসকে যে ৮টি অবশ্য পালনীয় শর্ত দিয়েছিলেন তাঁর বাবা


অধ্যাপক ডা. ইমরান বিন ইউনুসের প্রয়াত পিতা এডভোকেট ইউনূস



 

অধ্যাপক ডা. ইমরান বিন ইউনুস,

ইন্টারনিষ্ট ও নেফ্রোলজীষ্ট, প্রাক্তন অধ্যক্ষ ও বিভাগীয় প্রধান নেফ্রোলজী, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, ও, জিসিপি এলুমনাই ও বৈজ্ঞানিক কন্সালটেন্ট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, খন্ডকালীন অধ্যাপক পাবলিক হেলথ চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি
____________________

আজ আমাদের বাবার ২৩ তম মৃত্যু বার্ষিকী। ১৯৯৯ সনের ১৫ জুন দুপুর ২ টায় তার নিজের বিছানায় সকল স্নেহ ধন্যদের মাঝে নিঃশব্দে নীরবে চলে যান বিধাতার কাছে। যার কাছ থেকে আমরা সবাই আসি আর আবার ফিরে যাই। অমোঘ বিধান।
আমাদের বাবা আমাদের তিন ভাই এক বোনের বন্ধু আর হিরো ছিলেন। বাবা জীবনের শুরুতে ছিলেন আইনজীবি ও কলেজ শিক্ষক, তারপর বিচারক।অবশেষে আবার আইনজীবি। আইনজীবি পরিবারের সন্তান বাবা আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিলেন। এমএএললবি ১৯৪৮। আলীগড়ের সব প্রাক্তনীর মত আমার বাবারও ছিল দারুণ সুপেরিওরিটি কমপ্লেক্স। মনে করতেন আলীগড় ছাড়া আর সমমানের কোন ইউনিভার্সিটি নেই। অন্যদিকে আইনজীবি হওয়ার জন্য বাবার ছিল সীমাহীন হাই এসটিম। বলতেন আইন পেশা হলো লার্নেড পেশা। এ নিয়ে বাবার সাথে খুব তর্ক হতো, ডাক্তার বনাম আইনজীবি। বাবা ডাক্তারদের, তার ভাষায়, হাফ এডুকেটেড বলতেন। কারন সাধারন বেচেলর ডীগ্রি কোর্স সম্পন্ন করে না বলে। বাবার সাথে তর্কে জেতার জন্য অনেক পড়াশুনা করে লার্নেড পেশার ডেফিনেশন বের করে ছিলাম। যা হলো, ‘যে পেশা চালিয়ে যাবার জন্য চলমান জ্ঞানে আপডেটেট থাকতে হয়’। বাবাকে দেখানোর পর মেনে নিয়ে ছিলেন। বাবার এটাই ছিল একটা গুন। এগ্রিড টু ডিসেগ্রি হলেও কোন কিছুর গ্রহন যোগ্যতা। তখন থেকেই জানি আমার পেশা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন লার্নেড প্রফেশন। আমার বাবা বলতেন আইনজীবির কাজ হলো ধাক্কা দিয়ে দিয়ে সত্যকে প্রতিষ্টা করা। মিথ্যার বেসাতী না। বাবা আরও বলতেন, ‘আইনজীবির ব্রেন আর মক্কেলের পকেট যদি সমানুপাতিক হয় তবে আইনে সাধারনত অসম্ভব কিছু থাকে না’। পারিবারিক ঐতিহ্যের সাথে আলীগড়ের আলোকিত সমাবেশে বেড়ে উঠার জন্য জীবনধারন ও কর্মসাধন সম্পর্কে তার ছিল অবমুক্ত ধারনা ও চেতনা। বাবা বলতেন, ‘জীবনকে আরো আরো আলোকিত করার জন্য স্বর্ণ ঈগলের মতো আকাশের দিকে তাকাবে, শকুনের মতো নীচের দিকে না’। সবসময মনে করবে কোটি কোটি মানুষের চেয়ে ভালো আছো।আর মনের ভিতর হাত ঢুকিয়ে বড় করবে আর উদার হবে।
সিলেটের চা সবুজের লাল মাটির মায়া কাটিয়ে পশ্চিমের স্থান গুলো চক্কর মেরে দক্ষিনের পেনোয়া ফুলের আর লাল কাকড়ার লালে লাল সৈকত ঘুরে পাহাড় আর সাগরের মাঝের এই শহরে বাবা থিতু হয়েছিলেন ১৯৬৫ সনে। তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ।এখানেই তার শেষ শয্যা। বাবা ছিলেন ঝঢ়। দুরন্ত দুর্নিবার। সব কিছু ছাপিয়ে যেতে পারতেন। তা যে সমস্যাই হোক। আমার বাবার দুটো ব্রেক ছিল। আমার মা আর যে কোন অন‍্যায়।
বাবা চাননি আমি ডাক্তার হই। চেয়েছিলেন পারিবারিক ধারায় আইনজীবি হই। বাবা আমাদের কোন কাজে বাধা দিতেন না। এখানেও দেননি।

 

তবে কতগুলো শর্ত দিয়েছিলেন। ১. পরিপূর্ণ যোগ্যতা অর্জনের আগে স্বাধীন ভাবে রোগীর চিকিৎসা দেবে না। ২. রোগীদের মনে করবে তোমার বাবা মা ভাইবোন, তাদের জন্য যা করতে তাই করবে। ৩. কিছু কিছু টাকা গন্ধ ছড়ায় তা পকেটে ঢুকাবে না। ৪. পরিপূর্ণ ভাবে কাউকে না দেখে পথে ঘাটে চিকিৎসা দেবে না। মনে রাখবে ড্রয়িং রুম যেমন বসার জন্য, ডাইনিং রুম খাবার জন্য, মসজিদ নামাজের, তেমনি রোগী দেখার স্থান হলো চেম্বার বা হাসপাতাল। ৫. হ্যাব দা কারেজ টু সে আই ডোন্ট নো। তুমি কি সব জানো নাকি? তোমার এই না জানার সরল স্বীকোরক্তি রোগীর কাছে তোমাকে অনন্য করবে। ৬. রোগীদের সত্য বলবে তার অবস্থা। সব ভালো হয়ে যাবার সোনার হরিণ দেখাবে না। ৭. বি অ্যান এক্সপেনসিভ ডক্টর। পুরো ফিস নেবে ; না হয় পুরো ফ্রি। অন্য কিছু না। ৮. একজন ডাক্তারের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো সেনসিটিভ মাইন্ড। সেন্সিটিভ মাইন্ড গড়ার জন্য পড়ার বইয়ের বাইরে অনেক কিছু পড়তে জানতে হবে। হিস্টরি, জিওগ্রাফী, মিউজিক, ফটোগ্রাফী, আর্কিওলজী, নভেল, ক্লাসিক্স। সবকিছুতে যতই তুচ্ছ হোক আনন্দ পেতে হবে। আরেকটা কথা বাবা বলতেন বড় হওয়ার রেসে প্রলুদ্ধ হবে না, কারণ তাতে তোমাকে অনেক কিছু কম্প্রমাইজ করতে হবে।


জীবনে বাবার কাছের থাকার কত কথা। আজ চারিদিকের অবস্থা দেকে মনে হয় আইনজীবি হলে অনেক ভালো হত। বাবা বলতেন একজন ভাক্তার একজন রোগীর জীবনের জন্য। কিন্তু একজন আইনজীবি একটা পরিবার, গোষ্টি, ব্যষ্টি, সমষ্টি বা দেশের দারুন ক্ষতি করতে পারে তার অজ্ঞতার আর লোভের জন্য। বাবার অনুভবের অনুরনন এখন চারিদিকে আমার বাবার পেশার সব অগ্রজ আর অনুজ সহকর্মীদের শ্রদ্ধা নিবেদন।
আমার বাবা বলতেন, টেল মি হু ইজ দা মোস্টসাকসেসফুল ম্যান? আমরা সফলতার প্রচলিত সব মানদন্ড গুলো বলতাম। বাবা তা একসেপ্ট না করে তার ক্রাইটেরিয়া বলতেন। বলতেন, ‘হি ইজ দা মোষ্ট সাকসেস ফুল মেন হুজ সান এন্ড ডটার্স আর প্রাউড অব বিয়িং সান এন্ড ডটার অব দেট মেন’।
বাবা তুমি কি শুনতে পাও আমাদের হৃদয় নিংড়ানো ধ্বনির প্রতিধ্বনি। বাবা উই আর টু ফরচুনেট এন্ড সো প্রাউড টু বি ইওর কিডস। বাবা তোমার তুলনা তুমিই শুধু। আর পাইনি। বিধাতার কাছে নিবেদন আমাদের বাবাকে সবচেয়ে ভালো রাখার জন্য।
##

আপনার মতামত দিন:


প্রিয় মুখ এর জনপ্রিয়