Dr.Liakat Ali

Published:
2023-06-14 02:53:11 BdST

৪  ডাক্তার বোন এবং তাদের মায়ের অনন্য লড়াইয়ের  কাহিনি


 

ডা. নাঈম জিনাত
__________________

আমাদের ৪ বোনের গল্প প্রথমে শুনলেই যে কেউই বলেন,”বাহ্ তোমরা ৪ বোনই ডাক্তার!!না জানি তোমাদের বাবা-মা কত proud!”
গল্পের পেছনে যদি যাই…

শুরুটা করা উচিত আমার আম্মুকে দিয়ে। আমার মা খুবই মেধাবী ছিলেন। প্রত্যন্ত এক গ্রামে উনি সেবার সেই স্কুলে SSC পাশ করা দুটি student এর একজন ছিলেন। অনেক পড়াশোনার শখ ছিল মার। কিন্তু ঐ যে গ্রামের রীতিতে ঐ বয়সেই আম্মুর বিয়ে হয়ে যায় বিশাল এক যৌথ পরিবারে।শুনেছি একেক বেলায় ৪০/৫০ জনের রান্না হতো। তো সেই সংসারে ঢুকে আমার মায়ের লেখাপড়ার পাট চুকে গেল। বাবা চলে গেলেন প্রবাসে। আমার মা আর আমরা রয়ে গেলাম সেই অঁজ পাড়া গ্রামে।

 

আমার মায়ের ততদিনে দুটি সন্তান। বড় আপু আর মেঝ আপু।আমার মা খুবই দূরদর্শী আর বিচক্ষণ মহিলা ছিলেন। তিনি ভাল করেই দেখতে পেলেন, গ্রামে কোনো মেয়ে পড়াশোনার গন্ডি বেশিদূর পার হতে পারে না। আর পুরুষরা সবাই প্রবাসী। তিনি তার মেয়েদের ভবিষ্যত চিন্তা করে পাড়ি জমালেন প্রবাসে আমার বাবার কাছে। সেইটা আবার middle east country. সেখানে তখন আরো কঠিন অবস্থা নারী শিক্ষা নিয়ে। আমার মায়ের তখন আমরা ৪ মেয়ে। আম্মু তখন অকূল পাথারে পড়লেন। ৪ ৪টি মেয়ে হবার কারণে শ্বশুরবাড়ির খোঁটাও শুনতেছেন (ছেলে সন্তান নেই বলে) আবার সেই আরব দেশে মেয়েদের পড়াশোনার বেশি সুযোগ নেই সেটিও দিব্যি দেখতে পাচ্ছেন। উনি তখন সিদ্ধান্ত নিলেন একাই মেয়েদের নিয়ে দেশের যেকোনো জেলা শহরে চলে আসবেন যে যাই বলুক।

তো,আম্মু আর আমরা ৪ বোন সম্পূর্ন একা বিদেশ বিভূঁই চট্টগ্রামে চলে আসি। আম্মুই আমাদের সারা সন্ধ্যা পড়াতেন। Home schooling যাকে বলে। একে একে আমরা সব স্কুলে ভর্তি হলাম। আব্বুর একার উপার্জনে দাদুবাড়ির খরচ সাথে আমাদের সবার পড়াশোনা আম্মু হিমশিম খাচ্ছিলেন। আমরা প্রতি বছর ই প্রায় স্কুল বদলাতাম। বাসা বদলাতাম। উদ্দ্যেশ্য একটাই “আরো ভালো স্কুল চাই”! আম্মু কখনো থেমে থাকেননি। যখনই স্কুলের টিচার রা বলতেন,ওরা পড়াশোনায় ভালো, আম্মু তখনই আরেকটু টাকা জমানো শুরু করতেন, ইচ্ছে আরেকটু ভাল কোচিং চাই।

কিন্তু কখনো আম্মু আমাদের pressure দেননি।কখনো এমন হয়নি যে আমরা রাতের ২/৩টা পর্যন্ত পড়তেছি।
এর মধ্যে কক্ষনো কারো সাহায্য আম্মু পান নাই।আত্নীয় স্বজন সর্বদা খোঁচা দিতে প্রস্তুত থাকতো।”মেয়ে মানুষ এতো পড়াশোনা করে কি হবে? বিয়েই তো দিয়ে দিতে হবে”…”আব্বুর টাকা আম্মু সব নষ্ট করে ফেলতেছে।আব্বুকে সহজ সরল পেয়ে বাবাকে বিদেশে ফেলে আমরা মা মেয়েরা শহরে হাই-ফাই করে থাকতেছি” ইত্যাদি ইত্যাদি।এমনও সময় গেছে যখন আব্বু ঠিক কার পক্ষ নেবেন,নিজের আত্নীয় স্বজনের নাকি স্ত্রী-কন্যাদের… আব্বুও dilemma তে পড়ে যেতেন। Relatives এরকমও হয়।

সবাই নভেম্বর-ডিসেম্বরে দাদু-নানুবাড়ি যেতো। আমরা যেতাম না। আমরা সেইসব শীতের ভোরে scholarship exam দিতে যেতাম। আম্মু দেখতে চাইতেন তাঁর মেয়েরা নিজের গন্ডির বাইরে পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত কি না।নাচের গানের ছবি আঁকা কিচ্ছু বাদ যায়নি। আম্মু বলেন যে…আমরা কোনো scholarship exam দিয়েছি আর তা পাইনি এমন কখনো হয়নি। যাই দিতাম তাই নাকি পেয়ে যেতাম। আলহামদুলিল্লাহ্।

তো….এই সেই করে বড় আপুর মেডিকেল admission test results দিল। ও চান্স পেলো দিনাজপুর মেডিকেলে। কিন্তু সংসারে তখন ভয়াবহ কঠিন দিন। আব্বুর চাকরি নেই প্রায় ১ বছর। কোনো উপার্জন নেই। কেই দু পয়সা সাহায্য করলো না।বরং বললো মেয়ে বিয়ে দিয়ে দাও,ল্যাঠা চুকে যাক। আম্মু নাছোড়বান্দা। ২০০৫/২০০৬ সালে বড় আপু ভর্তি হলেন,আমাদের জমি জমা বাড়ি বিক্রি করে বইপত্র-কঙ্কাল কেনা হলো।বড় আপু যখন পড়তে চলে যান আমরা বুঝতে পারি আম্মুর অপমান আর এই এত বছরের কষ্টের প্রতিদান কোনোভাবেই আসলে দেয়া সম্ভব না।

এরপর মেঝ আপু চান্স পেলেন কুমিল্লা মেডিকেলে২০০৭/২০০৮ এ। তারপর আমি ২০১০-১১ সেশনে কক্সবাজার মেডিকেল আর সবার ছোট জন ঢাকা মেডিকেল কলেজে ২০১২-১৩ তে। কখনো আম্মু গহনা বিক্রি করে তো কখনো জমানো টাকার FDR/DPS ভেঙে বা ঋন করে হলেও আমাদের মেডিকেলের পড়াশোনা চালিয়েছেন।

এরপর আর আমাদের পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি আল্লাহ-র রহমতে। একে একে সবাই এক চান্সে পাশ করলাম। বোর্ডে আপুরা প্লেস করতেন।

বড় আপু BSMMU তে Gyne and Obs এ MS শেষ করলেন। একই সাবজেক্টে FCPS Part-1 করলেন, MRCOG part-1 পাশ করলেন। বর্তমানে BSMMU তেই Fetomaternal Medicine এ পার্ট টু training এ আছেন।প্রথম ছবিটা আপুর,যময বেবি ডেলিভারির পরে তোলা ছবি।

মেঝ আপু MD phase-B (Endocrinology and metabolism) তে আছেন BIRDEM. ৩৯ তম বিসিএসে সংযুক্তিতে ছিলেন DNCC Hospital এ। কিছুদিন আগে চমৎকার ভাবে PLAB-1 আর MRCP part 1 পাশ করেছেন।নিচে তার কোভীড ডিউটি কালীন সময়ের ছবি।

তারপর আমি,বর্তমানে MD (Internal Medicine) phase-A তে আছি, ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ৩৯ তম বিসিএসে পোস্টিং ছিল সন্দ্বীপ উপজেলা।
আর ছোট বোন,সে গতবছর FCPS part 1 করে Medicine এ। এখন MD Phase-A (Internal Medicine) এ আছে আমার সাথেই,ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ৩৯ তম বিসিএসে আমরা দুজন একই উপজেলায় পোস্টিং পাই।

পোস্টটা বেশ বড় হয়ে গেল। আসলে আমার মায়ের struggle এর ১০ ভাগ ও বলতে পারিনি। কত চড়াই উতড়াই পার হয়ে আজ আমরা এ পর্যায়ে এসেছি তা শুধু আমার মা আর আমরা ৪ বোন ই জানি।
সবাই দুআ করবেন আমার বাবা-মার জন্য। আমাদের জন্য। ধন্যবাদ সবাইকে।

 

ডাঃ নাঈম জিনাত
CoxMCH- 3rd Batch
MD phase-A (Internal Medicine)

আপনার মতামত দিন:


প্রিয় মুখ এর জনপ্রিয়