Dr. Aminul Islam

Published:
2024-03-08 18:04:41 BdST

দ্বিতীয়বার যখন নোবেল পেলেন নোবেল কমিটি তাঁকে বলেছিল আপনি পুরস্কার না নিতে এলেই মঙ্গল



ডেস্ক
_______________

দ্বিতীয়বার যখন নোবেল পেলেন নোবেল কমিটি তাঁকে বলেছিল আপনি পুরস্কার না নিতে এলেই মঙ্গল ! যিনি না এলে খুশি হবে নোবেল কমিটি, তিনি এক মহিলা। বিজ্ঞানী। বিখ্যাত। মাত্র আট বছর আগে, ১৯০৩ সালে, তিনি পেয়েছিলেন সে প্রাইজ। সে বার ফিজিক্সে। তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গবেষণার জন্য। এ বার মনোনীত হয়েছেন কেমিস্ট্রি প্রাইজের জন্য। পোলোনিয়াম ও রেডিয়াম আবিষ্কারের জন্য। অর্থাৎ, মাত্র আট বছরের ব্যবধানে দু’-দু’বার দুই আলাদা বিষয়ে নোবেল। এ হেন বিজয়িনীর তো মহাসমারোহে অভ্যর্থনা পাওয়ার কথা। তাঁকে কিনা চিঠি লিখে জানানো হল, আপনি পুরস্কার নিতে না এলে ভাল হয় ! কিন্তু কেন এমন বলা হল ? কারণ মানুষের কুৎসা আর তাঁর অবৈধ প্রেমকাহিনি নিয়ে বিভিন্ন মিথ্যা প্রচার | কেউ তাঁকে বলত ‘ডাইনি’, কেউ বলত ‘ঘর-ভাঙানি’।তথাকথিত প্রগতিশীল দেশ ফ্রান্সের মানুষের বিষনজর ছিল তাঁর উপর। তবুও শেষমেশ তিনি নোবেল পুরস্কার নিতে গিয়েছিলেন।

কলেজে পড়ার সময় থাকতেন একটি ঘুপচি ঘরে। ঠান্ডায় সেই ঘর হয়ে যেত হিমঘর। পেট চালাতে ল্যাবরেটরিতে কাচের পাত্র ধোয়ামোছার কাজও করেছেন। শুকনো ফল,পাউরুটি খেয়ে রাতের পর রাত কাটিয়ে দিয়েছেন। কষ্টের সেই দিনগুলো সম্পর্কে পরে স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘এ জীবন, কোনও কোনও দৃষ্টিকোণে বেদনাদায়ক হলেও, আমার কাছে প্রকৃত আনন্দের। আমি পেলাম মুক্তি আর স্বাধীনতার স্বাদ, যা দারুণ মূল্যবান। প্যারিসে আমি অজানা-অচেনা, হারিয়ে গেলাম বিশাল শহরে। কিন্তু সেখানে একা থাকার, অন্যের সাহায্য ছাড়া বেঁচে থাকার, অনুভূতি মোটেই হতোদ্যম করল না আমাকে, বরং এক প্রশান্তি আর তৃপ্তি ছেয়ে রাখল মন।’ ফিজিক্সের ডিগ্রিতে প্রথম হয়েছিলেন। সেইসময় আলাপ হয়েছিল বিশেষ এক জনের সঙ্গে। পিয়ের কুরি। অধ্যাপক। গবেষণা করেন চাপের প্রভাবে ক্রিস্টালের তড়িৎ উৎপাদন এবং চুম্বকত্বের ওপর উষ্ণতার প্রভাব নিয়ে। দুজনে প্রেমে পড়লেন। বিয়েও করলেন। দু’বছর পর জন্মাল প্রথম মেয়ে। আইরিন। সাত বছর পর দ্বিতীয় মেয়ে ইভ।

পদার্থবিজ্ঞানে চলেছে ধুন্ধুমার কাণ্ড। জার্মান বিজ্ঞানী উইলহেল্‌ম রন্টজেন আবিষ্কার করেছেন এক বিচিত্র আলো, যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু ভেদ করে যায় অনেক কিছু। রন্টজেন নাম দিয়েছেন ‘এক্স-রে’। সে আবিষ্কারের কয়েক মাসের মধ্যে ফরাসি বিজ্ঞানী অঁরি বেকারেল পেয়েছেন আর এক খোঁজ। ইউরেনিয়াম মৌল আভা বা আলো ছড়ায়। আপনাআপনি। কেন ? জানা নেই। কী সেই আলো ? জানা নেই। ১৬ ডিসেম্বর, ১৮৯৭। রহস্যভেদে নামলেন দম্পতি।

ইউরেনিয়ামের আলো বিকিরণের নাম দিলেন ওঁরা। রেডিয়োঅ্যাক্টিভিটি। আলো কেন? তারা বুঝলেন, ওটা পরমাণুর ভেতরের খেলা। শুধু ইউরেনিয়ামই কি আলো ছড়ায়? না কি তেমন মৌল আছে আরও? এটা-সেটা নিয়ে পরীক্ষা। শেষে এক পদার্থ। পিচব্লেন্ডি। যা থেকে ইউরেনিয়াম নিষ্কাশন করা হয়। দম্পতি দেখলেন, পিচব্লেন্ডি-র রেডিয়োঅ্যাক্টিভিটি ইউরেনিয়ামের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ, ওই জিনিসে লুকিয়ে আছে ইউরেনিয়াম ছাড়া অন্য কোনও মৌল, যা ছড়ায় রেডিয়োঅ্যাক্টিভিটি। কী সেই মৌল? খোঁজ পেতে চলল মরিয়া চেষ্টা। আগুন জ্বালিয়ে পেল্লায় কড়াইতে মানুষ-সমান খুন্তি নেড়ে টন-টন পিচব্লেন্ডি গলিয়ে মৌল খোঁজা। দিন-রাত লাগাতার। পরিত্যক্ত এক ছাউনি ঘর ধোঁয়াধুলোয় অন্ধকার। অবশেষে মিলল সেই মৌল। মাতৃভূমির স্মরণে দম্পতি তার নাম দিলেন পোলোনিয়াম। কয়েক মাস পরে ও-রকম আরও এক মৌল। রেডিয়াম। ১৯০৩। রেডিয়োঅ্যাক্টিভিটি আবিষ্কার, তার ব্যাখ্যা এবং প্রবল গবেষণার জন্য ফিজিক্সে নোবেল প্রাইজ পেলেন । ১৯০৬-এর ১৯ এপ্রিল। রাস্তা পেরোতে গাড়ি চাপা পড়লেন পিয়ের। তক্ষুনি মৃত্যু। শোকে পাগল হলেন তিনি। তবে কাজ থামল না। ১৯১১ সালে সেই মহিলা বিজ্ঞানী নোবেল প্রাইজ পেলেন রসায়নে - পোলোনিয়াম ও রেডিয়াম আবিষ্কারের জন্য।

এরই মাঝে তেজস্ক্রিয়তার বিষে আক্রান্ত হলেন। যার পরিণাম একটাই - মৃত্যু। কিন্তু তাতেও থামেনি সেই মহিলা বিজ্ঞানীর গবেষণা। গবেষণার জন্যে রাতে বাড়িতেও নিয়ে আসতেন রেডিয়াম। রাতে না ঘুমিয়ে বাড়িতে বসে রেডিয়াম নিয়ে গবেষণা করতেন। কি অদ্ভুত তাই না ! ১৮৮৯ থেকে ১৯০২ পর্যন্ত তিনি যে নোটবুক ব্যবহার করেছেন সেটা আজও রাখা আছে প্যারিসের "বিবলিয়োথেক ন্যাশনাল’-এ। সেই নোটবুক থেকে যে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ছে সেটা আগামী ১৫০০ বছর অবধি চলবে। এতটাই যে, আজ যদি কোনও গবেষক ওগুলো ঘাঁটতে চান, তা হলে তাঁকে মুচলেকা দিয়ে ঘোষণা করতে হয় তিনি বিপদ বুঝে কাজে নামছেন।

যে ফ্রান্সের মানুষরা তাঁর নামে কুৎসা ছড়িয়েছিল,প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তাদের পাশেই দাঁড়ালেন তিনি। ফরাসি সেনাদের চিকিৎসায় ১৮টা ভ্যানে এক্স-রে মেশিন নিয়ে ছুটে বেড়ালেন লড়াইয়ের ময়দানে। তিনি এমনই !

তিনি বিশ্বের প্রথম মহিলা যিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।
তিনি বিশ্বের প্রথম ব্যক্তি যাকে দুইবার নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে।
তিনি আজ অবধি বিশ্বের একমাত্র ব্যক্তি যিনি বিজ্ঞানের দুটি পৃথক বিভাগে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

সাফল্য সবাই দেখে। মাঝের লড়াইয়ের বছরগুলোর কথা কতজনই বা জানে !

মারি স্ক্লোদাওস্কা কুরি। মেরি কুরি। এক লড়াইয়ের নাম। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে মহান বিজ্ঞানীকে শ্রদ্ধার্ঘ্য !

তথ্য : তেজস্বিনী - পথিক গুহ ( আনন্দবাজার পত্রিকা )

আপনার মতামত দিন:


প্রিয় মুখ এর জনপ্রিয়