Razik hasan
Published:2021-10-04 04:56:46 BdST
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সময়ের চেয়ে অগ্রসর, সত্যিকারের আধুনিক মানুষ
রাজিক হাসান
লন্ডন থেকে
_____________
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন সময়ের চেয়ে অগ্রসর, সত্যিকারের একজন আধুনিক মানুষ। ঊনবিংশ শতাব্দীর মতো এ যুগের মানুষও তাঁকে দয়ারসাগর, করুণাসাগর হিসেবে চেনে, দামোদর নদী-সন্তরণের কাল্পনিক কাহিনীর নায়কের মাতৃভক্তিতে আপ্লুত হয়। কিন্তু যে ‘অজেয় পৌরুষ ও অক্ষয় মানবতার’ জন্য তিনি পর্বতের মতো মাথা তুলে সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন; তার স্বরূপ তাঁর দয়া-দাক্ষিণ্যের কাহিনীর নিচে চাপা পড়ে যায়।
বিদ্যাসাগর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন; "যে গঙ্গা মরে গেছে তার মধ্যে স্রোত নেই, কিন্তু ডোবা আছে। বহমান গঙ্গা তার থেকে সরে এসেছে। সমুদ্রের দিকে তার যোগ। এই গঙ্গাকেই বলি আধুনিক। বহমান কালগঙ্গার সঙ্গেই বিদ্যাসাগরের জীবনধারার মিলন ছিল, এই জন্য বিদ্যাসাগর ছিলেন আধুনিক।"
এই আধুনিকতাই বিদ্যাসাগরকে সব ধরনের ভাববাদী চিন্তা থেকে মুক্ত করে মানবমুখিতা , পার্থিব করে তুলেছিল। তিনি সমাজ থেকে সব ধরনের কুসংস্কার ও পশ্চাৎপদতা দূর করতে ব্রতী হয়েছিলেন।
বিদ্যাসাগরের পূর্ববর্তী ও সমসাময়িক অনেকেই বালিকা-বিধবাদের কষ্টে কাতর হয়েছেন, বিধবাবিবাহের পক্ষে কথা বলেছেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর ‘বিধবাবিবাহ আইন’ পাস করানোয় নিয়ামক ভূমিকাই পালন করেননি শুধু বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের জন্য ধন-প্রাণ-মন সঁপে দিয়েছিলেন। নিজ উদ্যোগে, নিজ দায়িত্বে ও নিজ ব্যয়ে অনেকগুলো বিধবা বিয়ে দিয়ে, হিন্দুসমাজে তিনি বিধবাবিবাহ প্রবর্তন করেন। এ জন্য তাঁর জীবনের ওপর ঝুঁকি এসেছে, তিনি পরোয়া করেননি। বাংলায় নারী-শিক্ষার উদ্যোগও বিদ্যাসাগরের পূর্বেই শুরু হয়েছিল। এমনকি কিছু রক্ষণশীল শিক্ষিত হিন্দু নারীও শিক্ষার সমর্থনে লেখালেখি করেছিলেন। কিন্তু নারী শিক্ষা প্রচলন বিদ্যাসাগরের ব্রত ছিল। স্কুল ইন্সপেক্টর থাকার সময় ছোটলাট হ্যালিডের মৌখিক প্রস্তাবেই যখন তিনি আগ্রহী হয়ে বাংলায় শতাধিক মেয়েকে নিয়ে স্কুল খুলে ফেলেন, তখন বুঝতে পারা যায় নারীশিক্ষা প্রচলনে তাঁর ব্যগ্রতা কতটুকু ছিল। পরে এই স্কুলের ব্যয় বহন করতে ব্রিটিশ সরকার অস্বীকার করলে তিনি নিজের অর্থে স্কুলের সব শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন ও অন্যান্য পাওনা পরিশোধ করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উদ্যোগী হয়ে কলকাতায় যে হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেটিই ভারতের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। বিদ্যাসাগর ছিলেন এই বিদ্যালয়ের সম্পাদক। এটি বর্তমানে বেথুন স্কুল নামে পরিচিত।
বিদ্যাসাগর প্রচলিত অর্থে সাহিত্যচর্চা করেননি। তিনি সময়ের ও শিক্ষার প্রয়োজন মেটাতে পাঠ্যপুস্তক লিখেছেন। পাঠ্যপুস্তক লিখতে গিয়েই তিনি সাহিত্যিক বাংলা ভাষা নির্মাণ করেছেন এবং আধুনিক যুগে আধুনিক বাংলা ভাষার ‘প্রথম যথার্থ শিল্পী’ হয়েছেন। সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র তাঁকে ‘পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা’ বলে অবজ্ঞা করেছিলেন। কিন্তু ইংরেজ সিভিলিয়ানদের জন্য লেখা তাঁর ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ বাংলা ভাষায় প্রথম গল্পের বই হিসেবে ঘরে ঘরে পঠিত হয়েছে। বাঙালি শকুন্তলার কাহিনী কালিদাসের নাটক থেকে জানেনি, জেনেছে বিদ্যাসাগরের ‘শকুন্তলা’ পড়ে। শিশুদের জন্য লেখা পাঠ্যবইকে তিনি সব অপার্থিবতামুক্ত রাখার চেষ্টা করেছেন।
সমাজের প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর মধ্যেই ছিল তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয়। শুধু তাই নয় বাংলা সাহিত্যের বিকাশে তাঁর অবদান ছিল অসামান্য। বাংলা গদ্যের যে সৃষ্টি হল, সেই গদ্য সৃষ্টিতে তাঁর অবদান ছিল অপরিসীম। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন। "গদ্যকে দখল করে তাকে যথার্থ সৌন্দর্য দিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।"
রাঢ়ীয় কুলীন ব্রাহ্মণ বিদ্যাসাগর স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য বিচার করতেন না। জাতিধর্ম-নির্বিশেষে তিনি নিজ হাতে চেনা-অচেনা কলেরা, ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য রোগীর সেবা করেছেন। তাঁর ওপর বর্ণাশ্রম প্রথারও প্রভাব ছিল না। সংস্কৃত কলেজে ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাড়া অন্য কোনো বর্ণের হিন্দুর পড়ার অধিকার ছিল না। তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হওয়ার পর তাঁর সমর্থন ও উদ্যোগে কলেজের দ্বার অন্যান্য বর্ণের হিন্দু ছাত্রদের জন্যও উন্মুক্ত হয়। সংস্কৃত কলেজের শিক্ষার্থীদের তিনি পর্যাপ্ত ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে সমৃদ্ধ বাংলা সাহিত্য সৃষ্টিতে সক্ষম করে তুলতে চেয়েছেন। ভাববাদিতার হাত থেকে মুক্ত করে তাঁদের মধ্যে যুক্তিবাদিতার উন্মেষ ঘটাতে চেয়েছেন।
বিদ্যাসাগর বলতেন, ছাত্রদের পাঠ্য গ্রন্থে ধর্মের কথা বলতে গেলে ছাত্রদের মন প্রথম থেকেই নিজের স্বাভাবিকতা থেকে ধর্মের দিকে চলে যায়। তিনি তাই বলেছিলেন শিক্ষার ক্ষেত্র থেকে, পাঠ্যপুস্তক থেকে ধর্মের কথা, ধর্মনীতির কথা বাদ দিয়ে দাও। এটাই ছিল বিদ্যাসাগরের সেক্যুলারিজমের মূল তত্ত্ব। তিনি প্রমাণ করতে পেরেছিলেন তাঁর ধর্ম হল মানবতাবাদ - রিলিজিয়ন অফ হিউম্যানিটি।
অন্যের কাছ থেকে ঋণ করে তিনি কেবল মাইকেল মধুসূদন দত্তকেই টাকা ধার দেননি, আরও অনেককেই দিয়েছেন। ফেরত পাওয়ার আশা নেই জেনেও দিয়েছেন। তিনি কারও দান গ্রহণ করতেন না কিন্তু নিজে অকাতরে দান করেছেন। তাঁর কাছে প্রতি মাসে মাসোহারা পেতেন প্রচুর দুস্থ মানুষ। তবে তাঁর এসব দান-ধ্যানের প্রেরণা কোনো পারলৌকিক লাভের আশা থেকে আসেনি, এসেছে তাঁর মানবপ্রেম ও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে।
এবার বিদ্যাসাগরের একটি গল্প বলি -
বিদ্যাসাগর একবার স্কুল ইনস্পেকটর এর দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে এক গ্রামের পথে কোন স্কুল পরিদর্শন করতে যাচ্ছিলেন। পথে দশ বারো বছরের একটা ছেলে তার সামনে এসে দাঁড়ালো। বলল,
-বাবু একটা পয়সা দিন।
-এক পয়সা দিয়ে কি করবি?
-খাবার কিনে খাব।
-যদি দুই পয়সা দিই?
তা হলে আজ এক পয়সার খাব, কাল এক পয়সার।
-যদি চার পয়সা দিই?
-তা হলে খাব না। সবজি কিনে বাজারে বেচব।
বিদ্যাসাগর তাকে ১০ টাকা দিলেন।
এর পর আরো দশ বারো বছর কেটে গেছে। বিদ্যাসাগর সেই গ্রামের পথেই কোন দরকারে যাচ্ছিলেন। তাঁকে দেখে পথের পাশে একটি দোকান থেকে একটি যুবক বেরিয়ে এল। প্রণাম করে বলল,
-মহাশয়, আমাকে চিনতে পারছেন?
-কেন পারব না। তুই আজ দোকান করেছিস, এত বড় হয়েছিস। তা বলে আমি তোকে চিনতে পারব না? তা কি হয়।
-আপনার জন্যই আমি আজ ...............
-তা নয় বাপু। তোমার মধ্যে উদ্যম ছিল বলেই তুমি উন্নতি করেছ।
চিন্তা-চেতনায় ক্রমাগত পশ্চাদপসরণ করে আমরা আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি, তাতে মনে হয় বিদ্যাসাগর শুধু তাঁর সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন তাই নয়, বরং বিদ্যাসাগর ছিলেন আমাদের এই আজকের বর্তমান সময় থেকেও অগ্রগামী। অসাধারণ বুদ্ধি ও মেধা, চরিত্রের কঠোরতা এবং বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মজয়ন্তীতে অতল শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আপনার মতামত দিন: