প্রনব বড়ুয়া

Published:
2021-04-09 22:09:35 BdST

অধ্যাপক ডা. এম এ হাসান চৌধুরী: একজন আলোর দিশারী


 

ডা.প্রনব কুমার বড়ুয়া 

--------------------------------

ট্রপিক্যাল মেডিসিন বিষয়টা অন্য অনেক কিছুর মতোই ইউরোপিয়ানদের হাত দিয়েই যাত্রা শুরু করে । উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে সারা বিশ্বে যখন তাদের দখল কায়েম করে, তখন তারা বুঝতে পারে, ক্রান্তীয় গ্রীষ্ম মন্ডলীয় অঞ্চলের (Tropical & sub-tropical regions) জলবায়ু, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, প্রতিবেশ-পরিস্হিতি, মানুষের রোগ-শোক ইত্যাদি শীত-প্রধান অঞ্চলের থেকে অনেকটাই আলাদা ।ফলে এসব অঞ্চলের রোগ-ব্যাধি এবং এসবের চিকিৎসা সম্পর্কে বিশদ ভাবে জানার জন্য মেডিসিনেরই একটা আলাদা শাখা হিসেবে ট্রপিক্যাল মেডিসিনের যাত্রা শুরু হয় ।তৎকালীন ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় উপ-মহাদেশেও ট্রপিক্যাল মেডিসিন বিষয়টা চিকিৎসা বিজ্ঞানের অংশ হিসেবে স্থান লাভ করে ।অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এই বিষয়টার ব্যাপক চর্চার ফলে বেশ কিছু সংক্রামক রোগের কারণ উদঘাটিত হয়, যেমন, ম্যালেরিয়া,
ফাইলেরিয়া, পীত জ্বর( Yellow fever ), কালা-জ্বর, প্লেগ, আফ্রিকান স্লিপিং সিকনেস ( African sleeping sickness ) ইত্যাদি । উল্লেখ্য যে, ম্যালেরিয়ার জীবাণু ( প্লাজমোডিয়াম ) এবং এই জীবাণু যে স্ত্রী জাতীয় এনোফিলিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায় , এটা ইংরেজ বিজ্ঞানী স্যার রোনাল্ড রস্ ভারতে অবস্থান করে গবেষণা করেই আবিষ্কার করেন এবং এই কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন । উপনৈবেশিক আমল থেকে শুরু করে পাকিস্থান আমল পর্যন্ত চিকিৎসা শাস্ত্রে DTM&H ( Diploma in Tropical Medicine & Hygiene ) নামক একটা স্নাতকোত্তর ডিগ্রী আমাদের দেশে চালু ছিল । এই কোর্স বিশ্বের অনেক দেশে এখনও চালু আছে, যেমন থাইল্যান্ড । বাংলাদেশের অনেক প্রখ্যাত মেডিসিন ও শিশু রোগ বিশেষজ্ঞের অন্যান্য ডিগ্রীর পাশাপাশি ট্রপিক্যাল মেডিসিনে ডিপ্লোমা ডিগ্রী ছিল, যেমন, প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক এম আর খান(DTM&H), প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম( TDD-Diploma in Tropical Diseases ), অধাপক আহমদ আবদুল মোমিন ( DTM&H ), প্রাক্তন রাস্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী ( TDD) প্রমুখ । স্বাধীনতার পর সম্ভবতঃ অধ্যাপক নুরুল ইসলামের পরামর্শে ট্রপিক্যাল মেডিসিনে স্নাতকোত্তর কোর্স বাতিল করা হয় এবং বিসিপিএস গঠন করে এর অধীনে মেডিসিনে এফসিপিএস কোর্স চালু করা হয় । আশি এবং নব্বই-এর দশকে চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান অধ্যাপক এম এ ফয়েজের নেতৃত্বে MRG ( Malaria Research Group ) গঠিত হয় এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড এবং থাইল্যান্ডের মাহিদল বিশ্ব বিদ্যালয়ের সাথে সমন্বিত ভাবে ম্যালেরিয়ার উপর বিস্তৃত গবেষণার মাধ্যমে সংগঠনটি কার্যক্রম শুরু করে । MRG ম্যালেরিয়া চিকিৎসায় নতুন দিক নির্দেশনামূলক গাইড লাইন তৈরী করে এবং তদনুযায়ী চিকিৎসকদেরকে ব্যাপক প্রশিক্ষণ প্রদান করে এই রোগ এখন আমাদের দেশে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে । MRG-র আরেকটা উল্লেখযোগ্য গবেষণার ক্ষেত্র হলো সর্প দংশন আক্রান্তদের চিকিৎসা । এই ক্ষেত্রেও সংগঠনটি ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে । MRG-র মাধ্যমে গবেষণা পরিচালনা করতে গিয়ে তাঁরা ট্রপিক্যাল মেডিসিনের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন এবং অধ্যাপক এম এ ফয়েজের নেতৃত্বে তাঁর গবেষকদল ( অধ্যাপক ইমরান বিন ইউনুস, অধ্যাপক রিদ্উয়ানুর রহমান, অধ্যাপক মাহতাবউদ্দীন হাসান, অধ্যাপক গোফরানুল হক, অধ্যাপক এম এ হাসান চৌধুরী প্রমূখ)-এর প্রচেস্টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ট্রপিক্যাল মেডিসিনে এম, ডি কোর্স চালু করা হয় ।এই ক্ষেত্রে একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে সমন্বিতভাবে এই রোগ সমূহের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার জন্য তাঁরা কাজ শুরু করেন । তারই ফলশ্রুতি আজকের বিআইটিআইডি ।

অনেক চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে ২০১৩ সালে এর পথ চলা শুরু হয় । সরকারের অমনোযোগের কারণে এবং সুদৃষ্টির অভাবে অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে থাকে প্রতিষ্ঠানটি । এক পর্যায়ে ২০১৭ সালে অধ্যাপক এম এ হাসান চৌধুরী প্রতিষ্ঠানটির হাল ধরেন । নিজ কর্মদক্ষতায় এবং সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা মোতাবেক বিআইটিআইডিকে তিনি টেনে তোলেন । চট্টগ্রামের দু'একটি দানশীল শিল্পগ্রুপের ( পিএইচপি গ্রুপ, প্যাসিফিক জিন্স লিঃ ইত্যাদি ) আর্থিক সহযোগিতায় এখানে অন্তঃবিভাগ, বহির্বিভাগ এবং এনিম্যাল বাইট ক্লিনিক ইত্যাদি চালু করেন । তাঁর প্রচেস্টায় ফ্রান্সের আর্থিক সহযোগিতায় স্থাপিত বি এস এল ( BSL-Bio-safety level)-3 ল্যাবরেটরী পূর্ণ উদ্দমে কার্যক্রম শুরু করে ।তিনি ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন শূন্য পদে চিকিৎসক পদায়নের ব্যবস্থা করেন । তাঁর নেতৃত্বে সীতাকুন্ডের সোনাইছড়ির ত্রিপুরা পাড়ার শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া মিজলস্ ( Measles ) এবং চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ, হালিশহর এবং সংলগ্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়া হেপাটাইটিস সফল ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় । সর্বশেষ বর্তমানে যে করোনা প্যান্ডেমিক চলছে, এর চিকিৎসা কার্যক্রম চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম বিআইটিআইডিতেই শুরু হয় । একেবারে শূন্য অবস্থায় কাজ শুরু করে এখানে তিনি বিআইটিআইডি-সংযুক্ত আই ডি এইচ ( Infectious Disease Hospital )-এ ৩২ শয্যার কোভিড ওয়ার্ড চালু করেন । সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা করা , পর্যাপ্ত পরিমাণে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা সহ চিকিৎসকদের পর্যাপ্ত পিপিই সংগ্রহ , তাদের আবাসন, খাদ্য, যাতায়াত ইত্যাদি সব কিছুই তাঁর সুযোগ্য দক্ষতায় সুন্দরভাবে পরিচালিত হয়ে এসেছে । স্যারের উপস্থিতিতে প্রতি কর্ম দিবসে টি- টাইমের ফাঁকে একাডেমিক ও ক্লিনিক্যাল আলোচনা ছিল অবশ্য পালনীয় । তিনি প্রতি দুই সপ্তাহ পর পর নিয়মিত সেমিনার আয়োজন করতেন । একজন দক্ষ ক্লিনিসিয়ানও যে একজন দক্ষ প্রশাসক হতে পারেন, তিনি সেটার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন । বিগত চার বৎসর ধরে এই প্রতিষ্ঠানটিকে গড়ে তুলতে গিয়ে প্রচুর শারীরিক, মানসিক চাপ তিনি সামলেছেন । এখন কিছুটা চাপমুক্ত হয়ে আবার শিক্ষকতায় ফিরে গিয়ে কিছুটা প্রশান্তি, বিশ্রাম তিনি চেয়েছেন এবং সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে পোস্টিং নিয়েছেন । যে উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি বিআইটিআইডি-তে এসেছিলেন, এটাকে একটা পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়ার জন্য, এই কাজে তিনি অনেকটাই সফল হয়েছেন । বাকীটা পরবর্তী প্রশাসন এবং অতি অবশ্যই সরকারের সদিচ্ছার উপর নির্ভর করবে । কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুরষ্কার কবিতার কয়েকটা লাইন উল্লেখ করেই শেষ করি-

" সংসার-মাঝে কয়েকটি সুর,
রেখে দিয়ে যাবো করিয়া মধুর,
দু'একটি কাঁটা করে দিব দূর,
তার পর ছুটি নিব "

আপনার মতামত দিন:


প্রিয় মুখ এর জনপ্রিয়