Ameen Qudir
Published:2017-11-20 15:55:53 BdST
গালিব,তাঁর রচনা ও বিশ্বাস
অধ্যাপক ডা. অনির্বান বিশ্বাস
________________________________
ধর্ম
....
সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম হলেও, ধর্মপালন গালিবের সয়নি। বরং স্রষ্টার সঙ্গে হাসি-ঠাট্টায় তিনি উৎসাহী ছিলেন।যেমন,
"হামকো মালুম হ্যায় জান্নাত কি হক্বিকৎ
লেকিন দিল কে খুশ রাখনে কো গালিব ইয়ে খ্যয়াল আচ্ছা হ্যায়।" (আমাদের জানা আছে স্বর্গ বিষয়টা কেমন, সেই ভাবনায় মনটা খুশি রাখার চেষ্টা করা, খারাপ না।)
গালিব স্পষ্টই উল্লেখ করেছেন, তিনি প্রার্থনা আর ধর্মানুরাগের পুরস্কার বিষয়ে সম্যকভাবেই ওয়াকিবহাল; কিন্তু এসবের প্রতি অনুগামী নন, নমিত নন। গালিব একনিষ্ঠ একেশ্বরবাদী ছিলেন, তিনি বলছেন,
"জো দুই কি বুঁ ভি হোতি তো কাহি দো চার হোতা" অর্থাৎ যদি দ্বৈততার ক্ষীণতম ঘ্রাণও পাওয়া যেত, তবে তার সঙ্গে মিলন ঘটত কোথাও না কোথাও।
গালিব মনে করতেন, তিনি আর স্রষ্টা আলাদা কেউ নন। অন্যদিকে তাঁর ছিল প্রচন্ড স্বাতন্ত্র্য বা অহংবোধ, সেইসঙ্গে প্রায়শই নিজেকে নিয়ে খামখেয়ালিপনা।চির-অবকাশপ্রিয় গালিব ভুগেছেন তাঁর হৃদয়ের অতৃপ্তি নিয়ে। ভেতরে ছিল নিগূঢ় নাজুকতা, এক শিরা-ছটফটানো অসন্তোষ, যা তাঁর কবিতার ভেতর গভীরভাবে প্রোথিত আছে।
"জিন্দেগি আপনি যব ইস শকল্ সে গুজরি
গালিব হম ভি ক্যায়া ইয়াদ করেঙ্গে কি খুদা রাখতে থে"
(নিজের জীবন যখন এমনই বিবর্ণ, গালিব,কী করে যে ভাবি, একদা আমাতেই ছিল স্রষ্টার বাস?)
রচনাশৈলী ও জীবন বোধ
...............................................
প্রথমদিকে গালিবের কবিতায় ফার্সী প্রভাব ছিল প্রবল।কিঞ্চিৎ লঘু চালে। কিন্তু ১৮৫৭ থেকে ১৮৬৮, এই সময়ের কবিতায় গালিব সাবলীল,রচনায় ক্ষিপ্র বোধের তীব্র প্রকাশ; উর্দু শব্দ চয়নও চরম উৎকর্ষ লাভ করেছে
"হাজারোঁ খাহিশে এ্যয়সে কে হর খাহিশপে দম নিকলে
বহত নিকলে মেরে আরমাঁ লেকিন ফিরভি কম নিকলে"
(হাজারো বাসনা হৃদয়-গভীরে, যার প্রতিটিই প্রাণহরা যদিও মিটেছে অনেক বাসনা, রয়ে গেছে কত অধরা)
"ইয়ে মাসায়িল-এ তাসাউফ ইয়ে তেরা বায়াঁ গালিব
তুঝে হাম ওলি সামাঝতে জো না বাদাখবার হোতা"
(এমন মরমিয়া বাণী আর তোমার মহিমান্বিত বয়ান ,যদি না মদ্যপ হতে তোমায় গালিব পীর মানতাম)
"বফা ক্যয়সি, কাহা কি ইশ্ক, যব শর ফোড়না ঠ্যহরা
তো ফির, এ্যয় সঙ্গদিল, তেরা হি সঙ্গ-এ আসত্মাঁ কিউ হো"
(আনুগত্য কেমন, প্রেম কী, এ-তো প্রায় মাথা ফাটানোর মতো ব্যাপার বটেই! হে পাথরপ্রাণের প্রেয়সী তবে আর তোমার ত্রিসীমানায় যাওয়া কেন!)
গালিবের রচনার সৃজনশীল ধরনটি নানা চিন্তা আর কল্পনার দিকে ঠেলে দেয়। যেমন :
"লাগ হো তো উস কো হাম সামঝে লাগাও
যব না হো কুছ ভি তো ধোঁকা খায়ে ক্যায়া"
(শত্রুতা, যদি থাকেও বা, আমি তাকে প্রেমজ্ঞান করি কিন্তু যদি না থাকে অনুভব, কী করে নিজেকে প্রতারণাকরি?)
"না থা কুছ তো খুদা থা, কুছ না হোতা তো খুদা হোতা
ডুবোঁয়া মুঝ কো হোনে নে, না হোতা ম্যায় তো ক্যায়া হোতা"
(যখন আর কিছুই ছিল না তখন স্রষ্টা ছিল, যদি কিছুনা-ও থাকত স্রষ্টা থাকত আমি ছিলাম বলেই ডোবাতে পারলে, যদি না থাকতাম তবে কী করে পারতে?)
"বস্ কি দুশবার হ্যায় হর কাম কা আসাঁ হোনা
আদমি কো ভি মায়াসার নেহি ইনসাঁ হোনা"
(কোনো কিছু ঠিকঠাক হয়ে ওঠা যেমন দুঃসাধ্য ,মানুষের মানবিক হয়ে ওঠাও কখনো অসাধ্য)
গালিবের ইঙ্গিতধর্মী পঙ্ক্তি অনেক আছে : তার নিহিতার্থ অনুমান ও হৃদয়ঙ্গম করতে, এমনকি এর বাইরেও ভাবনার জগৎ আঁকতে পাঠককে বাধ্য করার যে শিল্প, তা গালিব বেশ রপ্ত করতে পেরেছিলেন।তাঁর সর্বাধিক স্বীকৃত ইঙ্গিতবাহী পঙ্ক্তিটি এরকম
"আয়না দেখ আপনা সা মুহ লে কে র্যহ গ্যয়া
সাহিব কো দিল না দেনে পে কিৎনা গুরুর থা"
(আয়নায় তাকিয়ে, মুখচ্ছবিই তোমায় লজ্জায় ফেলে দিল,হৃদয় হারাবে না বলে তোমার না ভীষণ দেমাক ছিল!)
কবি-সুরসিক
.....................
গালিব ছিলেন ‘কবি-সুরসিক’, ‘রসিক-কবি’ নন। কখনো তিনি বিদ্রূপাত্মক, চতুর, রসিক, কখনো বা সূক্ষ্ম কৌতুকমিশ্রিত তাঁর রচনা, যেটাই হোক, ভঙ্গিটা তিনি তাঁর মতো করে সাজিয়ে নিয়েছিলেন। যেমন,
" যতটা অসম্মানই সে আমাকে করুক, আমি তা গ্রহণ করব হাসিমুখে, ওর ঘরের দ্বাররক্ষী আমার চিরচেনা বন্ধু হয়ে উঠেছে যে’, এখানে, পর্যদুস্ত হয়ে ওঠার এক সম্পূর্ণ চিত্র ধরা পড়ে, যাতে দেখা যায়, কবি গালিব প্রেয়সীকে পাওয়ার আশায় ঘুরেফিরে মরছেন আর এরই ফাঁকে তিনি ওই প্রিয়ার বাড়ির দ্বাররক্ষীর বন্ধুস্থানীয় হয়ে উঠেছেন।
অন্য আরেক পঙ্ক্তিতে তিনি বলছেন, ‘শোধ নেব এই পরীর মতো সুন্দরীদের ওপর, খোদার কৃপায়, ওরা যদি স্বর্গে হুর হয়ে আসে’, মর্ত্যে সুন্দরীদের বাগে আনতে না পেরে, ওদেরকে স্বর্গে গিয়ে হলেও বাগে পাওয়ার আশা করছেন কবি। গালিব এমনও বলেছেন যে, প্রিয়ার সান্নিধ্য পাওয়ার পথে তিনি যতটুকু হাঁটতে চেয়েছেন বরং তারচেয়ে কমই সেই আকুতি শব্দে-বর্ণে ধরতে পেরেছেন।
গালিবের চতুরতা শিখর ছোঁয় যখন তিনি বলেন, ‘ঠিক আছে, চুমু দিও না, তারচে’ বরং একটু কটাক্ষই করো। চুমু দেওয়ার মতো ঠোঁট তোমার না থাকতে পারে; কিন্তু কণ্ঠ তো আছে’
গালিবের দর্শন
..........................
‘যদিও যন্ত্রণা জীবন-সংহারী হয়ে গেছে; ভালোবাসার জন্য কোনো দুঃখও যখন নেই, তবে বেঁচে থেকে কষ্ট-যাপনই হোক।’ এই হল গালিবের দর্শন।
যখনই কোনো কৌশল, উপমা বা তুল্যমূল্যের বিচারে গেছেন, স্বীয় দর্শনকে ভুলে যাননি একবিন্দুও। প্রশ্ন রেখেছেন, যদি গনগনে সূর্যালোকের তলায় ভস্মীভূত হওয়াই নিয়তি তাহলে কেন স্রষ্টা মানুষ সৃষ্টি করলেন? প্রায় সবকিছুকেই একটা দার্শনিক ছাঁচে ফেলে ভাবতেন তিনি। স্বীয় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে মানুষের যে নিরন্তর লড়াই সেটা তাঁকে ভীষণ উদ্বিগ্ন করত। মানুষকে সৃষ্টি করে, পরে তাঁকে এমন দুর্মর কষ্টের মধ্যে নিপীড়িত করার জন্যে, খোদ মানবসৃষ্টির প্রযোজ্যতা নিয়েই তিনি প্রশ্ন তুলেছেন স্রষ্টার প্রতি। ধর্মীয় বিধিবিধানকে পাশ কাটিয়ে চলেছেন আজীবন, খাপ খাইয়ে নিয়েছেন অদ্বৈতবাদের পথে, যা তাঁর রচনায় বিধৃত হয়েছে নির্মলরূপে সুন্দর আঙ্গিকে। তাঁর কাব্যে মানুষের বিদ্যমানতার বিষাদপূর্ণ মনোগতির প্রকাশ, অগম্য দুঃখের অস্তিত্ব, ভ্রাতৃত্ববোধে নিস্পৃহতা আর শেষতক ধুলোয় মিশে যাওয়ার এই খেলা, এক অনন্য সৌকর্য প্রকাশের নিরাবলম্বী প্রয়াস।
‘তাহলে কেন এই বেঁচে থাকার নামে এতটা হট্টগোল’ বারবার এই প্রশ্ন তুলে গালিব প্রতি মুহূর্তে আমাদের অন্তরে আছেন।
-
( ঋন স্বীকারঃসরফরাজ খান নিয়াজির "ওয়াইন অব প্যাশন : দ্য উর্দু গজলস অব গালিব" )
_______________________________
অধ্যাপক ডা. অনির্বান বিশ্বাস । প্রখ্যাত লোকসেবী চিকিৎসক। কলকাতা। কবি। সুলেখক।
আপনার মতামত দিন: