Ameen Qudir
Published:2017-06-11 15:29:45 BdST
" মিনু ভাই বললেন, 'তোমাদের সাথে হয়তো আর বেশীদিন নাই "
ডা. আরিফুর রহমান
_____________________________
মিনু ভাই ।
ডা: আমিনুর রশিদ মিনু -আমার তথা আমাদের অতি প্রিয় মিনু ভাই। তিনি ছিলেন আমার অভিভাবক -বন্ধু। বয়সের ব্যবধান আমাদের বন্ধুত্বে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি কখনোই। মিনু ভাই আমার শিক্ষকও বটে-আমার ল্যাপারস্কোপিক সার্জারীর হাতেখড়ি মিনু ভাইয়ের কাছে।
মিনু ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয়ের যোগসূত্র অবশ্যই আমাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান 'হেল্থ এন্ড হোপ হাসপাতাল। কখন কিভাবে এই নিপাট ভদ্রলোক, বিনয়ী , মার্জিত, স্বল্পভাষী মিনু ভাইয়ের সাথে আত্মার বন্ধন হয়েছে টেরই পাইনি। শুধু জানি মিনু ভাই আমার একান্তজন। পোষাকে কেতাদূরস্ত মিনু ভাই মননে একজন আধুনিক মানুষ-মিনু ভাইয়ের ক্ষেত্রে 'উত্তরআধুনিক' শব্দটাই হবে বেশী প্রযোজ্য।
মিনু ভাই নেই। চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছিনা-মেনে নেয়ার তো প্রশ্নই আসে না। সবকিছু কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ঘটে গেল। মিনু ভাই অসুস্হ হলেন-চিকিৎসা চলছিল-আস্তে আস্তে অবস্হা খারাপের দিকে এগুলো। মিনু ভাইকে নিয়ে এ সময় এতটাই অকুপায়েড ছিলাম-এর মধ্যে আমাদের আরেক প্রিয় বড় ভাই স্বপন ভাইয়ের মা অসুস্হ হয়ে হাসপাতালের আইসিইউ তে ছিলেন, তাঁর খবরটাও ঠিকমত নিতে পারিনি।
এরই মধ্যে একদিন ভোরবেলা বন্ধু সুব্রত এর ফোন এলো-'মিনু ভাই আর নেই'। হঠাৎই মাথাটা শূন্য হয়ে গেল-ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল সবকিছু-সেই সময়ের অনভূতি কোনভাবেই ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। ঘরের মধ্যে পায়চারী করতে লাগলাম। মন স্হির করলাম মৃত মিনু ভাইকে দেখতে যাব না। কুহুর ঘুম ভেংগে গেলে-কি হয়েছে জানতে চাইলো-আমি কথা বলছিলাম না। পরে যখন জানতে পারলো, তৎক্ষণাৎ আমাকে বললো 'রেডি হও' বারডেম হাসপাতালে যেতে হবে।
আমি বলি 'যাব না'। কুহু আমাকে জোর করে বারডেমে নিয়ে আসলো-আমি পুরোই ঘোরের মধ্যে -মৃত মিনু ভাইকে নিয়ে 'হেল্থ এন্ড হোপে' আসলাম-জানাজা হলো-আগারগাঁও নিউ কলোনী কবরস্হানে দাফন হলো-কেবলই মনে হচ্ছিল এটা সত্যি না। মিনু ভাই ফিরে আসবেন আমাদের মাঝে- নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন। আবার আমরা একসাথে আড্ডা দিব-একসাথে ভ্রমনে বেরোব।
মিনু ভাই ছিলেন আমাদের ভ্রমন সংগী। আমরা সবাই মিলে কোথাও যাব ঠিক করলাম-মিনু ভাইকে বললাম চলেন মিনু ভাই। দেখি তোমাদের ভাবীর সাথে আলাপ করি-মিনু ভাইয়ের উত্তর। কিন্তু আমরা জানতাম যাওয়ার সময় মিনু ভাই সঠিক সময়ে হাজির থাকবেন। আমরা যেমন মিনুভাইয়ের সংগ পছন্দ করতাম তেমনি উনিও আমাদের সংগ উপভোগ করতেন। আমাদের এক বন্ধু সুবীর খুব মজা করে কথা বলে-মিনু ভাই সুবীরের বড় এক ফ্যানই বনে গেলেন।
মিনু ভাইয়ের মৃত্যুর পরদিন পত্রিকায় মিনু ভাইয়ের ছবি দেখে আমার ঘোর কাটে-নিজেকে সংবরণ করতে পারি না। হাসপাতালে আমার রুমে বসে আছি পত্রিকাটা সামনে মেলা-ওদিকে রোগী অপারেশনের টেবিলে এ্যানেস্হেসিয়া দেওয়া হয়ে গেছে-ডাক্তার আমাকে ডাকতে এসে দেখে তার স্যারের দু'চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল গড়াচ্ছে। আমি আর কি করতে পারি-মিনু ভাইয়ের জন্য কিছুই করতে পারলাম না -আমাদের চোখের সামনে প্রিয় মানুষটাকে একটু একটু করে শেষ হতে দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারলাম না-চোখের জলই একমাত্র সম্বল।
মিনু ভাইয়ের রোগটা ধরা পড়ার সময় অর্থাৎ যখন প্রথম বুকের এক্স রে করানো হলো-ঐদিন সকাল ১১ টা নাগাদ মিনু ভাই আমাকে ফোন করলেন 'আরিফ একটু আমার হাসপাতালে এসো'-কন্ঠটা ম্লান। বিআইএইচএস হাসপাতালে এসে মিনু ভাইয়ের রুমে বসলে উনি আমাকে একটা বুকের এক্সরে দেখতে দিয়ে বললেন, ডায়াগনসিস বল। আমি tuberculosis বলাতে উনি বললেন -একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বলেছেন malignancy. এরপর মিনু ভাই বললেন, 'তোমাদের সাথে হয়তো আর বেশীদিন নাই'।
আমি তখনও জানিনা এক্স রে টা কার। মনে খানিকটা সন্দেহ হওয়ায় জিজ্ঞেস করলাম-কার এক্স রে এটা। মিনু ভাই বললেন 'আমার'। আমার অন্তরে অজস্র কাটার মত গেথে আছে মিনু ভাইয়ের সেই কথা ' তোমাদের সাথে হয়তো আর দুই তিন মাসের বেশী নাই'-সেটা ছিল ফেব্রুয়ারী মাস ,১৮ই ফেব্রুয়ারী ২০১৬। (মিনু ভাইয়ের মৃত্যুর পর শোক বইয়ে লেখাটি লিখেছিলাম)
মিনু ভাইয়ের রোগের ডায়াগনসিস হলো 'সারকয়ডসিস'।
ডায়াগনসিস দেশেই হলো তবু নিশ্চত হবার জন্য মিনু ভাই দিল্লী গেলেন। মিলন ভাইয়ের পরিচিত দিল্লীর গংগারাম হাসপাতালের রেসপেরটরি মেডিসিনের একজন কনসালটেন্ট আমাদের দেশের কনসালটেন্টদের সাথে সহমত প্রকাশ করে একটা চিকিত্সা প্রটোকল লিখে দেন। চিকিৎসা চলছিল- মিনু ভাইয়ের অবস্হার দিন দিন অবনতি হচ্ছিল। মিনু ভাইকে প্রথমে বিআইএইচএস হাসপাতাল, পরে হেল্থ এন্ড হোপ হাসপাতাল ,সেখান থেকে সমরিতা হাসপাতাল ও পরবর্তীতে বারডেম হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখান থেকেই মিনু ভাই চলে যান না ফেরার দেশে।
আজ ১১ জুন মিনু ভাইয়ের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী।
মিনু ভাইয়ের একমাত্র ছেলে অদ্রি, ভাবী ও মিনু ভাইয়ের পরিবারের অন্যদের প্রতি বুকভরা ভালবাসা।
________________________________
ডা. আরিফুর রহমান । সুলেখক। লোকসেবী প্রথিতযশ চিকিৎসক।
আপনার মতামত দিন: