DR. RAZ MAHAJAN

Published:
2023-09-11 21:46:42 BdST

স্বাভাবিক প্রক্রিয়া


ডা. তারিক অনি ঢামেক, ব্যাচ কে-৬১ রেজিস্ট্রার, সার্জারী সানশাইন কোস্ট ইউনিভার্সিটি হসপিটাল কুইন্সল্যান্ড অস্ট্রেলিয়া তে কর্মরত

 

 

ডা. তারিক অনি

—————
কিছুদিন আগে ঢাকার এক প্রাইভেট হাসপাতালে এক প্রসুতির চিকিৎসার অব্যবস্থাপনায় নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে। প্রসুতি মা কে আরেক হাসপাতালের আইসিইউ তে কোনরকম ট্রান্সফার করা হয়, তিনি এখনও অচেতন হয়ে পড়ে আছেন।

দুজন জুনিয়র চিকিৎসক তাৎক্ষনিক গ্রেফতার হয়েছে। একজন ডিউটি ডাক্তার। এরা বলির পাঠা। আইওয়াশ। জুনিয়র মেডিকেল অফিসার হল দেশের সবচেয়ে সস্তা প্রাণী যে গিলোটিন যন্ত্রে গলা বিক্রি করেই চাকরী তে দস্তখত দেয়, রিকশাওয়ালার চেয়েও কম টাকায় হাসপাতালে দৈনিক কামলা দেয়। এটা দেশে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ডাক্তার সমাজ এই পাঠা বলি সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত।

যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অধীনে রোগী ভর্তি হল, সামগ্রিক চিকিৎসা যজ্ঞটি হল, সেই চিকিৎসক ম্যাডাম দুবাই। তিনি বলেছেন, তিনি এসবের কিছুই জানেন না। এটাও স্বাভাবিক রেসপন্স। তিনি আরব সাগরের পাশে বসে বেদানার জ্যুস খাচ্ছেন আর হোটেলের জানালা দিয়ে মরুর সৌন্দর্য উপভোগ করছেন, এরকম স্নিগ্ধ সময়ে পূতিগন্ধময় দরিদ্র দেশের সামান্য এক নবজাতকের মৃত্যু নিয়ে আমাকে-আপনাকে বিব্রতকর প্রশ্ন করা হলে আমি-আপনি ও সেম উত্তর দিতাম। এটাও স্বাভাবিক।

দুর্ঘটনাটি না ঘটলে রোগীটি স্বাভাবিকভাবে বাড়ি যেত, রোগীর বিলের অংশ এলিট বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দুবাই বসেই পেয়ে যেতেন, অতীতেও বহুদিন ধরে পেয়ে আসছেন, হাসপাতালও এভাবেই দিয়ে আসছে। তিনি দুবাই থাকলেও তার রোগী তার আন্ডারেই ভর্তি হচ্ছে। এটাই সিস্টেম।

ভ্রু কুচকানোর কিছু নেই, দেশের প্রাইভেটে এটা খুবই স্বাভাবিক একটি নিয়ম। এক কনসালটেন্টের রোগী আরেক কনসালটেন্টের আন্ডারে যদি ভুলক্রমেও ভর্তি হয়, সেদিন হাসপাতালে ছোটখাটো কুরুক্ষেত্র হয়। আমি বিলাতি ডিগ্রী লাগানো খাঁটি ব্রিটিশ উচ্চারণে ইংরেজী বলা অসম্ভব ভদ্র প্রফেসর কে খাঁটি দেশী ভাষায় “ কোন ***** আমার রোগী হের আন্ডারে দিসে?” গালি দিতে দেখেছি। কারণ এডমিশনেই স্যারের প্রায় ৩ হাজার টাকা লস হয়! স্যার অবশ্য টাকার শোক দ্রুত সামলে ওঠেন, বিলাতী ভদ্রতা এবং ব্রিটিশ টানের ইংরেজী তে ফিরে যান। বাকি দিনটা সুন্দর রোগী দেখেন এবং রাতে শান্তিতেই ঘুমাতে যান।
খুব ই কি স্বাভাবিক না ?

টিভিতে টকশো দেখলাম। সাধারণ দর্শক কে প্রশ্ন করা হল, “রোগীর নরমাল ডেলিভারি কে করবে।” দর্শক এক বাক্যে উত্তর দিল- “ডাক্তার।” এটাও স্বাভাবিক। ডাক্তার চিকিতসা করবে এটাই জনগণের ধারণা। আমি এই এক্সপেকটেশনের মধ্যেও কোন অস্বাভাবিকতা পেলাম না।

প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রতি উত্তরে বলছেন, তার নিজের বাচ্চা বিলেতে হয়েছে, ডাক্তার ছিল না, শুধু মিডওয়াইফ ছিল। কি সুন্দর সিস্টেম। দেশে কেন ডাক্তার ডেলিভারী করাতে হবে? এটাও স্বাভাবিক রেসপন্স। আসলেই বিলাতে যদি ডাক্তার ডেলিভারী না করায় তাহলে বাংলাদেশে কেন করতে হবে? আমরা তো মেডিকেল শিক্ষায় বিলাতের কারিকুলাম ই ফলো করি। তাই না?

সবচেয়ে স্বাভাবিক কাজটি করেছে প্রশাসণ। তারা পুরো হাসপাতালে সার্জারী বন্ধ করে দিয়েছে, সাথে দুজন তাৎক্ষণিক গ্রেফতার। মামলা হয়েছে। সম্ভবত হত্যা মামলা। নাহলে এভাবে গ্রেফতার হয়ে জেলহাজতে প্রেরণের কথা না। এখন কিছুদিন দৌড়াদৌড়ি হবে। মিটিং হবে, সিটিং হবে। আলোচনা হবে, মিছিল হবে, মানববন্ধন হবে। ডাক্তার রা স্ট্রাইক করবে, অলরেডী করেছেও। একটা নৈরাজ্য হবে। জল ঘোলা হবে। স্বাভাবিক রেসপন্স।

দেশের যেখানেই জল ঘোলা সেখানেই আমাদের দেশপ্রেমিক রাজনীতিক রা ছুটে যান। সাংবাদিক ছুটে আসেন। সবাই ছুটে আসবেন। তারা প্রচন্ড ব্যস্ত আর বিরক্তি ভাব নিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে চা সিগারেট খেতে খেতে কথা চালা শুরু করবেন। হাত কচলাতে কচলাতে বিভিন্ন ব্যানারে ডাক্তার নেতৃবৃন্দ আসবেন। হাসপাতাল কতৃপক্ষ আসবে। পুলিশ প্রশাসন আসবে। চুপি চুপি সেই দুবাই এ থাকা গাইনী কনসালটেন্টও আসবেন কোন এক ফাকে। শুরু হবে সমাধান পর্ব।

বাংলাদেশে সবসময় রুদ্ধদ্বার বৈঠকের আলোচনায় সবকিছুর সুন্দর সমাধান হয়ে এসেছে। এখানেও হবে। সবকিছু স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চললে কয়েকমাসের মধ্যে একটা সুন্দর গ্রহণযোগ্য মিউচুয়াল হওয়ার কথা। পেরিফেরিতে অঘটন ঘটলে কয়েক লাখ টাকায় এখন মিউচুয়াল হয়। ঢাকায় ধানমন্ডি এলাকার হাসপাতালে রেট আমার সঠিক জানা নেই। তবে সবটাই মুলামুলির ব্যাপার। মুলামুলি সবার জন্যই ভালো, বনিবনা না হলেই বরং বিপদ বেশি, তাই একসময় মিউচুয়াল হয়েই যায়। এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।

দুবাই বসে থাকা কনসালটেন্ট গাইনোকলজিস্ট কে ব্যপারটা আসলেই টাচ করে না। কারণ তার আসলেই দোষ নেই। তিনি তে দেশেই ছিলেন না। তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন, সম্পূর্ণ নির্দোষ হয়েও তাকে অকারণে যথেষ্ট মানহানির মধ্যে দিয়ে যেতে হল। জুনিয়র ডাক্তারগুলো যা তা। এরপর ভালোভাবে ভাইভা নিয়ে এদের নিয়োগ দিতে হবে। পরীক্ষায় পরীক্ষক হিসেবে বসলে তিনি আরও সুক্ষ্মভাবে মান যাচাই করে পাশ করাবেন। হাজার হোক সমাজের প্রতি চার একটা দ্বায়িত্ব আছে। এর আগে হাসপাতালে না থেকেও যে তিনি রোগীর বিল পেতেন এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটি এখানে আলোচিত হয়না। তিনি দুমাসের মধ্যে পূর্ববর্তী প্রাকটিস ফিরে যান। দেশে পোকামকড়ের মত অগনিত রোগী। রোগী না এসে যাবে কোথায়?!

মিউচুয়াল শেষে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ , প্রশাসণ, রাজনীতিক নেতা, ডাক্তার নেতা রা প্রশান্তচিত্তে যার যার কাজে ফিরে যান। আরও একটি সামাজিক কাজ সুন্দরভাবে বিলি বন্টনের মাধ্যমে সম্পন্ন হল। সমাজের উপকার হল।

এসব স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে সন্তান হারানো মা টিও একসময় ভাবতে শুরু করেন আসলেই তার সন্তানটির মৃত্যুটি হওয়ার ই ছিল। সে হয়তো আজীবন ক্রনিক গিল্টি ফিলিংস এ থেকে বাকী জীবনটা সাইকিয়াট্রির রোগী হয়ে কাটাবে। বাবাটাও এক সময় মেনে নেন যে মৃত্যুটিই বোধহয় ভালো ছিল, কারণ কথায় আছে যা কিছু হয় ভালোর জন্যই নাকি হয়। আমি নিশ্চিত এই পরিবারটি এখন বিদেশে মাইগ্রেশন করার জন্য উঠে পড়ে লাগবে। প্রিয় বাংলাদেশ স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই পরিবারটিকে এখন প্রবাসের পথে ঠেলবে। অথবা পরিবারটি ভেঙ্গে হয়ে যাবে। ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো কোন নতুন কাচের ছাঁচে দাগসহ জোড়া লাগবে।

যে ডাক্তার দুজন জেলে গেল তারাও এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া থেকে শিক্ষা নেয়। তারা অনুধাবন করতে পারে এদেশে এভাবেই ডাক্তারী করে বেচে থাকতে হবে, অথবা বিদেশ পাড়ি দিতে হবে। দেশমাতৃকাকে সেবা করা সহজ না এটা তারা এতদিন এ বুঝে গেছে। স্বাভাবিক তাই না ?

এত সব স্বাভাবিকতার মধ্যে আমি ভাবছি ভুল টা কোথায় হল? আমি তো কোন অস্বাভাবিকতা খুঁজে পাইনা। চিকিতসা হবে, অব্যবস্থাপনা হবে, মৃত্যু হবে, ঝামেলা হবে, সমাধান হবে। এটাই তো স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যা খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রকৃতির নিয়মেই হচ্ছে সেটা নিয়ে আমরা কেন এত মাতামাতি করি।

মন খারাপ হচ্ছে নবজাতকটির জন্য। সে একটি সুন্দর স্বাভাবিক বাংলাদেশ দেখার সৌভাগ্য হল না। এর ক্ষতিপূরণ অবশ্যই হওয়া উচিত।

ডা. তারিক অনি
ঢামেক, ব্যাচ কে-৬১
রেজিস্ট্রার, সার্জারী
সানশাইন কোস্ট ইউনিভার্সিটি হসপিটাল
কুইন্সল্যান্ড অস্ট্রেলিয়া তে কর্মরত।

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়