Dr.Liakat Ali

Published:
2023-06-12 17:45:39 BdST

লাইফ এজ সার্জিক্যাল রেজিস্ট্রার:একটি মৃত্যু ও কফি ব্রেকফাস্ট


লেখক

 

ডা. তারিক অনি
——————————————

রাত ৩ টা।

নাইট অন কল করছি। সানশাইন কোস্ট ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের সার্জারী নাইট অন কল বেশ দৌড়ের উপর যায়। প্রায়সময়ই সারারাত থিয়েটার চলে সাথে নতুন রোগী আসছেই।

তেমন ই ব্যস্ত এক নাইট পার করছি। ইমার্জেন্সী থেকে একের পর এক রেফারাল আসছে আর ওয়ার্ক-আপ প্ল্যান হচ্ছে। আমি থিয়েটার আর ইমার্জেন্সীর মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করছি। রাত তিনটা বেজে গেছে তাও ব্যস্ততা কমার নাম নেই। এসব ব্যস্ততার মধ্যে ওয়ার্ড কল জুনিয়র ডাক্তার ফোন দিল ওয়ার্ডের এক ভর্তি রোগী নিয়ে। বলা বাহুল্য এই ব্যস্ত হাসপাতালে, ওয়ার্ডে ভর্তি রোগী খারাপ হয়ে সুনামি না হয়ে গেলে সাধারণত অন কল রেজিস্ট্রার কে কল করা হয়না। ওয়ার্ড কল ডাক্তার ই ম্যানেজ করে ফেলে। তারা যথেষ্ট চৌকষ।

আজ যে ওয়ার্ড কল জুনিয়র ডাক্তার ফোন করছে সে এই সিস্টেমে একেবারেই নতুন। সম্ভবত, চাইনিজ কিংবা ভিয়েতনামিজ ডাক্তার। আমি প্রথম দশ সেকেন্ড কথা শুনেই মনে মনে বিরক্ত এবং একই সাথে হতাশ হলাম। আমি নিশ্চিত সে ফোনে পাঁচ মিনিট প্রচুর এলোমেলো তথ্য হ-য-হ-র-ল করে বলবে এবং সেখান থেকে কিছুই বোঝা যাবে না। ব্যস্ত নাইটে সার্জারীর অন কলের কাছে রেফারাল যে ত্রিশ সেকেন্ড “স্ট্রেট টু দ্য পয়েন্ট” এটাই সে এখনও জানেনা, অথবা জানলেও রপ্ত করতে উঠতে পারেনি।

আমি বিরক্তি চেপে ফোন কানে লাগিয়ে ধৈর্য ধরে হু হা করে শুনছি, এমন সময় মোবাইলে টুং করে মেসেজের শব্দ। অর্থোপেডিক্স রেজিস্ট্রার আমার পার্সোনাল নম্বরে টেক্সট করে চওড়া হাসির স্মাইলি ইমো দিয়ে লিখেছে, “মোটর বাইক ট্রমা আসছে, ১৫ মিনিট রেসপন্স টাইম। রক এন্ড রোল। সী ইউ মেইট। রিসাস-৪ ”

আমি ভাগ্যকে দুটা গালি দিয়ে মনে মনে ভাবছি  রাত তিনটায় খারাপ ট্রমা রোগী পেয়ে অর্থো রেজিস্ট্রার এত খুশি হয়ে “রক এন্ড রোল” বলার কি আছে? তার কি ঘুম টুম পায়না নাকি ?…. ওদিকে ভিয়েতনামি কথা বলেই যাচ্ছে…

৮৪ বছর বয়ষ্ক এক বৃদ্ধের ইন্টেস্টাইনাল অবস্ট্রাকশন, পেটে টিউমার ছড়ানো, অপারেশন করা পসিবল না, সব রকম নন-সার্জিক্যাল ট্রীটমেন্ট ফেইল করেছে, যেকোন সময় খারাপ হয়ে গেলে প্যালিয়েট করে কম্ফোর্ট কেয়ার দেওয়া হবে। তিনদিন আগে আমার ই ভর্তি করা রোগী। অলরেডী প্ল্যান ফাইনাল করা। সার্জারীর আর কিছু করার নেই, কম্ফোর্ট কেয়ার এর রোগী। রেফারালে আমি খুবই বিরক্ত হলাম।

আমি সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, “রিভিউ কেন চাইছো? এই মুহূর্তে ইমার্জেন্সী সার্জিক্যাল সমস্যা টা কি? “

সে জানালো, “রোগী তার সার্জারীর ডাক্তারের সাথে কথা বলতে চাইছে। সে খেতে চাইছে। ওদিকে তার ইন্টেস্টাইনাল অবস্ট্রাকশন। সে ক্লিনিক্যালি খারাপ হয়ে গেলেও কিছুতেই কম্ফোর্ট কেয়ার এক্সেপ্ট করছে না। সে খুবই স্টেসড। ফ্যামিলি ও প্যানিক করছে … ”

আমার বিরক্তি চলে গেল। আমি শান্ত স্বরে বললাম, “আমি আসছি। আমার একটা ট্রমা রোগী আছে। তুমি রোগীকে বল আমার আধা ঘন্টা সময় লাগবে।”

আমি ট্রমা সামলে বৃদ্ধকে দেখতে গেলাম। বৃদ্ধের  ইন্টেস্টিনাল অবস্ট্রাকশন প্রকট আকার ধারণ করেছে। পেট ফুলে ঢোল। নাকের নল দিয়ে যে পরিমাণ তরল আসছে তাতে বোঝা যাচ্ছে তার হাতে বেশি সময় নেই। এসময় খাওয়া মানে মৃত্যু তরান্বিত হওয়া। অবশ্য না খেলেও ফলাফল একই।

আমাকে রুমে ঢুকতে দেখেই বৃদ্ধ খুশী হয়ে উঠলো, “হিয়ার কামস মাই ইন্ডিয়ান সার্জন। লুক, আই এম স্টিল হ্যাংগিং এরাউন্ড। এখন ও মরে যাইনি! ”

আমি চওড়া হাসি দিয়ে বললাম, “ইয়াং ম্যান, কি ব্যাপার? তুমি নাকি ওয়ার্ডে কারও কথা শুনছো না? কি হয়েছে আমাকে বল”
- ওরা আমাকে কফি খেতে দিচ্ছে না। বলেছে তোমার অনুমতি ছাড়া সম্ভব না।”
- হু । ঠিক ই বলেছে। তোমার বাওয়েল মুভ করছে না। কফি খেলে বমি হওয়ার সমুহ সম্ভাবনা….
- ডাক্তার, আমি সেসব জানি। বাট তুমি আমাকে বলেছ আমি মারা যাচ্ছি তাইনা?
- হুম …
- আমার হাতে ঠিক কতক্ষন সময় আছে?
- আমি কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বৃদ্ধের হাত ধরে বললাম, আমি ঈশ্বর না, তবে আমার হিসেব বলছে, একদিন বা দুইদিন। আমি সত্যি সরি…
- ডাক্তার, আমি যদি নিশ্চিত মারাই যাই তাহলে মৃত্যুর আগে কেন আমাকে এক কাপ কফি দেওয়া হবেনা? আমি একটা সিগারেট ও খেতে চাই। আমার কুকুরটার সাথে একটু বাইরে যেতে চাই। তোমাদের এ কেমন নিয়ম ? আমি ৮৪ বছর বেচেছি, অস্ট্রেলিয়াকে সার্ভ করেছি, আমার কোন রিগ্রেট নাই কোন। আমি যদি কফি খেয়ে দ্রুত ও মারা যাই তাতেও রিগ্রেট নাই। আমি তোমার উপর রাগ ও করবো না।

বৃদ্ধের পাশে তার ছেলে আর ছেলের বউ বসে আছে। তাদের চোখ ভিজা, চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি।

ডিফিকাল্ট সিচুয়েশন হ্যান্ডেল করার মুখস্ত স্ট্যান্ডার্ড এপ্রোচের উত্তর দিতে যেয়েও দিলাম না। রোগীর যুক্তির কাছে আমাকে পরাজিত হতে হল।

আমি রোগী আর তার পরিবারের সাথে কথা বলে নিজেই নোট লিখলাম, “আমি রোগীর বাওয়েল অবস্ট্রাকশন জেনেও সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ডিসিশন মেক করছি, রোগী যা চায় খেতে দেওয়া হোক। তার ট্রিটিং ডাক্তার হিসেবে এটাও রেকমেন্ড করছি যে তাকে ইচ্ছানুযায়ী সিগারেট খেতে দেওয়া হোক এবং হুইল চেয়ারে করে সকালে বাইরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। এই মুহূর্তে আমার বিবেচনায় রোগী এবং তার পরিবারের জন্য এটাই বেস্ট কম্ফোর্ট কেয়ার।”

বৃদ্ধ কে বললাম, “শুনো নীচতলায় মারলো কফিশপ নামে একটা কফিশপ আছে, আমার খুবই পছন্দের। ওরা চমৎকার কফি বানায়। আমি রেগুলার খাই। আমি তোমাকে আজ কফি খাওয়াচ্ছি। আমি নীচেই যাচ্ছি, তোমার জন্য কফি পাঠিয়ে দিচ্ছি। ”

বৃদ্ধ ও তার পরিবারের মুখ কৃতজ্ঞতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, তাদের অস্থিরতা মুহুর্তে কেটে গেল। তাদের প্রশান্তিটা আমি সত্যিই আমার মধ্যে অনুভব করতে পারলাম। আমি মাত্র ৪ ডলার ২০ সেন্ট এর সস্তা কফি দিয়ে ৪ মিলিয়ন ডলারের কৃতজ্ঞতা আর ডক্টর স্যাটিশফ্যাকশন কিনে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম।

ঘন্টা তিনেক পর ভোর ৬ঃ৩০ এর দিকে হাসপাতালের কোথাও ইমার্জেন্সী মেট কল হল। ইমার্জেন্সী এলার্ম বেজেই চলছে। কিছু ডাক্তার নার্স দ্রুত সেদিকে ছুটছে। হয়তো সেই রোগী, হয়তো অন্য কেউ।

বৃদ্ধ কি তার শেষ কফিটি খেতে পেরেছিল? নাকি পারেনি? নাকি কফি খাওয়ার পরই তার অবস্থার অবনতি হল? জানা নেই। জেনে খুব একটা লাভও নেই। এক ঘন্টা পর আমার হ্যান্ডওভার। সারারাতের এক গাদা রোগীর নোট প্রিপেয়ার করে সকালে প্রেজেন্ট করার কাজ আমার হাতে। আমি সেদিকে মনোনিবেশ করলাম।

হ্যান্ডওভার শেষ হল। সকাল ৮ টায় হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার আগে শুনলাম বৃদ্ধকে সব ট্রীটমেন্ট বন্ধ করে সিরিন্জ ড্রাইভারে ঘুমের ঔষধ আর পেইন কিলার দেওয়া হয়েছে। বৃদ্ধ হালকা নীল রং এর স্বল্প আলোর রুমে শান্তির ঘুমে চলে গেছে। ঘুমের মধ্যে শান্তিময় মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা। আগামীকাল নাইটে এসে কম্পিউটার চেক করলে হয়তো দেখবো সে আর নেই। কি সুন্দর একটা মৃত্যু!

হাসপাতাল থেকে বের হলাম। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম যে আমার বৃদ্ধের নাম কিছুতেই মনে পড়ছেনা। অথচ একটু আগেও মনে ছিল! বরং রাতে আমি দুটা এপেনডিক্স অপারেশন করেছি, দুজনের নামই মনে আছে। যতগুলো এডমিশন করেছি প্রতিটি রোগীর খুটিনাটি মনে আছে। মস্তিষ্ক কত চালাক! প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি তথ্যও সে জমা করে না।

ডাক্তারী একটি বীজগণিতের সরল অংকের সমস্যার মত। অংক সমাধান হয়ে গেলেই আমার মস্তিষ্ক আর সেটা মনে রাখছে না। আমার এই বৃদ্ধের জন্যও মন খারাপও হচ্ছেনা। বরং স্যাটিসফাইড লাগছে যে আমি আমার অংক সমাধান করতে পেরেছি, রোগীকে আর তার পরিবারকে আমার সাধ্যের মধ্যে বেস্ট কম্ফোর্ট দিতে পেরেছি।

ইদানিং আমার নেশা হয়েছে নাইট শেষ করে বের হয়েই হাসপাতালের পাশেই গিজম্যান-গোমেজ নামক এক মেক্সিকান রেস্টুরেন্টে নাস্তা করা। প্রতিদিন একই ব্রেকফাস্ট খাই, ডিম, টাকো, হ্যাশ ব্রাউন আর মেন্ডারিন জ্যুস। তারপর বাসায় যেয়ে ঘুমাই। বাসায় যেয়ে ঘুমাবো বলেই কোনদিন ও ব্রেকফাস্ট এ কফি অর্ডার করিনা। আজ কফি অর্ডার করলাম। চমতকার হলুদ কাপ। আমার ফেভারিট কাপুচিনো কফি, সাথে দুই চামচ চিনি।

দোকানের কাচের বাইরে ছবির মত সুন্দর গাছপালা ঘেরা টুরিস্ট শহর সানশাইন কোস্টের নিকলিন হাইওয়ে ধরে হুস হুস করে ব্যস্ত গাড়িগুলো ড্রাইভ করে চলে যাচ্ছে। ঝকঝকে নীল আকাশে শাদা পেজা তুলোর মত কিছু বিচ্ছিন্ন মেঘ ছড়িয়ে ছিটিয়ে। মন ভালো করে দেওয়ার মত উজ্জ্বল একটি দিন। সকাল ৮ টার হালকা মিষ্টি রোদ শরীরে আদর করে হাত বুলায়। আইল্যান্ডে সারি সারি পাইন গাছ। মৃদুমন্দ বাতাসে পাইনের পাতাগুলো দোলে। বাইরে হালকা শীতের আমেজ। নাহ! এরকম একটি চমৎকার সকালে কফি না খেলে হয় ?

লাইফ এজ সার্জিক্যাল রেজিস্ট্রার

ডা. তারিক অনি
রেজিস্ট্রার, সার্জারী
সানশাইন কোস্ট ইউনিভার্সিটি হসপিটাল
কুইন্সল্যান্ড অস্ট্রেলিয়া

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়