ডা শাহাদাত হোসেন

Published:
2022-12-07 23:54:48 BdST

"স্যার, একটি কিডনি নেই জেনে আমার বউ চলে গেছে "


অধ্যাপক ডা. সিরাজুল হক

 


অধ্যাপক ডা. সিরাজুল হক
________________________

(১)
মিলনের বাড়ি চাঁদপুর ।ওর বয়স যখন ছয়বছর তখন ফুটফুটে দেখতে হলেও শিশুদের মত তেমন ছটফটে ছিল না কারণ সারাদিন পেটে ব্যথা যেটা আবার চালকুমড়ার মত দ্রুত ফুলেও যাচ্ছিল ।
তার চেহারায় কেমন একটি বিমর্ষভাব যেন শরতের চাঁদটি পেঁজা পেঁজা মেঘে ঢেকে দিয়েছে ।প্রতিদিন পেট ব্যথার প্যানপ্যানিতে জেরবার হয়ে ওর বাপ সুজন আমার কাছে নিয়ে এসেছিল ,’ স্যার, এতটুকুন বাচ্চা প্রতিদিন কান্নাকাটি করলে ঘরে কি সুখশান্তি থাকে ? সবার তাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা লাগে ।
তাই স্থানীয় ডাক্তার কিডনির রোগ বলে আপনার কাছে পাঠিয়েছে – একটা কিছু করুন স্যার ‘ ওনার কণ্ঠে দারুণ আকুলতা ।
পরীক্ষানিরীক্ষায় তার ডান কিডনি পানি জমে একেবারেই অকেজো ধরা পড়লে ঐ বয়সেই “ দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো “ বলে বুঝিয়ে সেটাকে ফেলে দিয়েছিলাম ।
সুস্থ হয়ে গেলে কেউ কাউকে মনে রাখিনা ।
পচিশ বছর বয়সে একেবারে টগবগে যুবক হয়ে সে আবার এসে বলে – স্যার, আমায় চিনতে পেরেছেন ? আমি মিলন ,শিশু বয়সে আমার একটি কিডনি ফেলে দিয়েছিলেন , আমি এখন ওমান থাকি ,সাগরে মাছ ধরি , বিয়ে করার জন্য দেশে এসেছি , একটি কিডনি নেই বলে কোন অসুবিধা হবে নাতো ?বউয়ের কাছে ছোট হবো নাতো ?
‘ নাহ ,তুমিতো দারুণ আছো । বিদেশে নিজেকে প্রমাণ করেছো । বিয়েশাদির পর মিলামেশার লাইন আর কিড়নির লাইন আলাদা । তুমি সানন্দে এগুতে পারো ‘ আমি আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললাম ।
‘ স্যার,বিদেশ ফেরত ধনীপাত্র বলে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে পাশের উপজেলার মেম্বারের কলেজপড়ুয়া পরীর মত সুন্দরী মেয়ের সাথে -তাই একটু ভয় ভয় লাগছে ‘
‘ও কিছু না ,আমাদের দেশের সব পুরুষরাই বিয়ের আগে ওরকম দ্বিধাদ্বন্দে ভুগে ।
তারপরও যদি সমস্যা হয় বিয়ের পরে নতুন বউকে নিয়ে একবার এসো , তাকেও বুঝিয়ে বলবো ‘
একমাস পরে মিলন এসে বলে- স্যার বাসর রাতে আমার পেটে কাটা দাগ থেকে সে চিৎকার করে বলে –তুমি আমকে ঠকিয়েছো , কেন তুমি এসব লুকিয়েছ , আমার কি কপাল ! একটি কিড়নি কাটা লোকের সাথে বিয়ে হয়েছে , ঐটি যদি বিকল হয় তাইলেতো আমার কপাল পুড়বে –আমি খুতওয়ালা তোমার সাথে থাকব না ; সারাজীবন কাটাতে পারবনা ‘।
আমি অনেক বুঝালাম ,আপনার কাছে আসতে বললাম কিন্তু ওর বাপ আর এক কাটি সরেস ; বুঝেনতো ক্ষমতার দাপট । সে পারলে মামলা মোকদ্দমা করে ফেলার হুমকি দেয় ।
অবশেষে দেনমোহর ও কাবিনের পাচ লাখ টাকা দিয়ে উদ্ধার পা্ই ।
এখানে নিজেকে খুব ছোট এবং অপমানিত লাগে তাই আবার ওমান গিয়ে সাগরে মাছ ধরা শুরু করি ।মাছ ধরাতে আমার দারুণ ভাগ্য । সবাইকে টপকে যাই ।মালিক খুব পছন্দ করে একটি নৌকা আমার জিম্মায় দিয়েছেন । পালাপাবনে তার বাড়িতে আমায় দাওয়াত দেয় ।
দিনগুলি ভালই কাটে কিন্তু আমার বাপ খালি আবার বিয়ের জন্য চাপ দেয় । মা বলে – তোর জন্য এবার দেখেশুনে লক্ষীমা ঘরে তুলব ।আমারো অনেক টাকাপয়সা জমেজে তাই আবার ঘর বাধার সাধ জাগে ।
আমি একটি কিডনি দিতে চাই ওনাকে ।
(২)
আমায় চিনতে পেরেছেন ?
সে এতো স্বাস্থ্যবান হয়েছে যেঁ তাকে অনেক কষ্টে ও চেনা গেল না ।অনুমান হল –মধ্যপ্রাচ্যে দুব্বা বা ভেড়ার মাংস রোজ খেয়ে এই অবস্থা হয়েছে ।
পাশে একটি হিজাব পরা বেশ লম্বা মেয়ে , চোখগুলি অনেক উজ্জ্বল ,হাতে দামী সোনার বালা এবং হিরের আংটি ; মখমলের গোলাপি বোরকায় ঢাকা সারা শরীর ।
কিন্তু কিছু কিছু মানুষকে আসলে ভুলা যায় না ,একটু গভীর ভাবে দেখলে স্মৃতির দিঘি থেকে পদ্মফুলের মত ফুটে ওঠে ; মিলনকেও চেনা গেল ।
‘স্যার ,আপনিতো ডান কিডনি ফেলে দিয়েছিলেন এখন আমার বামটাতে ব্যথা হয় ,সারারাত ঘুমাতে পারিনা । ও ,না ঘুমিয়ে মালিশ করে ।সেই ছোটবেলার মত ।মনেহয় এটাও গেছে ।ওদিকে আমার মালিক হোটেল দিয়েছে । বলছেন আমি যেন গিয়ে সেটা দেখভাল করি ; আর কতদিন সাগরে সাগরে ভাসবে ? সে বলে ।
ওনি কে ?
আমার স্ত্রী ,এবার জেনেশুনেই আমায় বিয়ে করেছে সাত বছর হল ,একটি ছেলে স্কুলে দিয়েছে আর একটি পানিতে ডুবে মরে গেছে ; বাপ কাছে না থাকলে যা হয় ‘
আপনি কি জেনেশুনেই তাকে বিয়ে করেছিলেন ? হিজাববোরকা পরা সুনয়নার কাছে গতবারের অঘটন মনে পড়াতে জানতে চাইলাম ।
‘ হ্যাঁ ,ইউ টিউব আর গুগলে দেখেছি একটি দিয়েই সারাজীবন সুস্থ থাকা যায় আর স্যার, এইলোকটি অসম্ভব ভালো । আমিতো সৎ মায়ের ঘরে বড় হয়েছি ,জীবনে পেয়েছি শুধু অবহেলা আর লাঞ্ছনা আর সারাদিন খেটেমরা । তার সাথে বিয়ে হওয়াতে সবকিছুর সাথে নিজের মাবাবার মত শ্বশুরশাশুড়ি পেয়েছি ।সংসারসুখ উপভোগ করছি ‘ ।
আবার তাকে বিদেশ পাঠিয়ে ভালো থাকবেন ?একা থাকার কষ্ট বইতে পারবেন ?প্রবাসঃপতি বিরহিণীদের নানান অসহায়ত্বের কথা মনে এলে জানতে চাইলাম ।
কি আর করা ! ছেলেকে স্কুলে দিয়েছি ,মাসে পাচছয় হাজার লাগে । সংসার খরচতো আছেই । রোজগারতো ওনার একার ।ওনি ঠিক না থাকলে চলবে কেমনে ? তাকে অনেক ভালবেসে ফেলেছি ।
তাই ঠিক করেছি – আমার একটি কিড়নি দেবো ... গভীর আন্তরিকতা দিয়ে সংসারগরবিনি বলে যায় যেন আলোর জগত থেকে দৈববাণী এলো ।
আমার মধ্যে একটি শিহরন বয়ে গেল , এটি এত সহজে কিভাবে বললেন ওনি? অনেক টাকা ,জমি বা সম্পত্তি দিয়েওতো কেউ দিতে চায় না ।
ভালোবাসার নতুন একটি দিক জোরালোভাবে মনে ঝড় বইয়ে দিলো ।
পরীক্ষানিরীক্ষায় দেখা গেল মিলনের বামটি সম্পুর্ন ভালো আছে ;দু’টির কাজ একা করতে করতে বেশ বড় হয়েছে ।
আসলে দুশ্চিন্তাই তাকে এসব ভাবনায় ফেলেছে ।
সুখবর জেনে খুশিতে বলল – মালিক বলছেন যদি হোটেল ভাল চালাতে পারি তাইলে ওদেরকে ও নিয়ে যাবার সুযোগ করে দেবেন ।
____________________
অধ্যাপক ডা. সিরাজুল হক
ইউরোলজি বিভাগ
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ।

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়