Dr. Aminul Islam

Published:
2022-10-12 20:15:53 BdST

বেওয়ারিশ:" কানু ভোর বেলায় মারা গেছে" হাসপাতাল থেকে লেখা


লেখক ডা সুকুমার সুর রায়

 

ডাঃ সুকুমার সুর রায়
_____________________

বেওয়ারিশ।

পুরুষ ওয়ার্ডে রাউন্ডে ঢুকতেই দৃষ্টি আটকে গেল চার নাম্বার বেডের দিকে। । শুয়ে আছে লোকটি।

তার চেহারায় তাকে এক অদ্ভুত রকমের আগন্তুক বলে মনে হলো। তাকে এই এলাকার কোন বাসিন্দা বলে মনে হলো না।

আমার হতচকিত ভাব আন্দাজ করে সিস্টার বললেন ; গতকাল বিকেলে জরুরি বিভাগের মাধ্যমে ভর্তি হয়েছে।

তার চোখের মধ্যে এক করুন আর্তি! অথচ বিমর্ষ হাসি হাসি মুখ। শরীরটা কংকালসার। গায়ের রঙ কুচকুচে কালো, মাথার চুল কালো কোঁকড়ানো, ঠোঁট দুটি মোটা!

দমকে দমকে কাশি হচ্ছে! কাশতে কাশতে বিছানা থেকে বাঁকা হয়ে উঠে বসে পড়ছে! আর কোটরাগত চোখ দুটি দিয়ে যেন সাহায্যের করুন আর্তি জানাচ্ছে।

ফাইল হাতে নিয়ে দেখলাম ; নাম - কানু সরেন, বয়স - ৬৫ বৎসর , পিতার নাম - রবী সরেন, গ্রাম - নিমগাছি, থানা - রায়গঞ্জ, জেলা - সিরাজগঞ্জ।

নিমগাছি থেকে রায়গঞ্জ অথবা তাড়াশ উপজেলা হাসপাতাল অনেকটাই কাছে।
অথচ উনি সেদিকে না গিয়ে এই হাসপাতালে কেন এসেছেন তা বোধগম্য হলো না।

কানু সরেনের কাশি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হলো । একটা বুকের এক্সরে করতে দেয়া হলো।

আশা ছিল কফ পরীক্ষায় 'টিবি' ধরা পড়বে। আমরা বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়ে তাকে ভাল করে তুলবো ।

কিন্তু টিবি' ধরা পড়লো না।
এক্সরে তে ফুসফুসে ক্যান্সারের আলামত পাওয়া গেলো!

ঢাকা যেতে পারবে কিনা? না হলে অগত্যা সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতালে যেতে পারবে কিনা? একথা জিজ্ঞেস করায় মাথা নাড়িয়ে 'না' সূচক জবাব দিলো।

তার সাথে ছিল ছোট্ট একটা কাপড়ের পুটলি, তাতে একটা ছেঁড়া জামা আর লুঙি ছাড়া কিছুই ছিল না।

বাড়িতে আর কে কে আছে জিজ্ঞেস করাতে বিমর্ষ হাসি দিয়ে নিরুত্তর রয়ে গেল।

এই হাসপাতালে আসার কারন কি জিজ্ঞেস করায় যা জানা গেলো, তা হল -এই হাসপাতালের অনেক সুনাম আছে, তাই সে এখানে এসেছে।

প্রতিদিন সকালে রাউন্ডের সময় অন্য বেডের রোগী দেখাকালীন কাশতে কাশতে হাতের ইশারায় ডাকতো কানু সরেন। কাছে গেলে বলত -
ওষুদ দিবেক না?

কানু সরেনের চিকিৎসা সাধ্যমত চলতে লাগলো।

একদিন সকালে রাউন্ডে ঢুকে বুকের ভিতর ধ্বক্ করে উঠলো! কানু সরেনের বেড খালি। তার বেডশিট গুটিয়ে ফেলা হয়েছে!

কানু সরেন ভোর বেলায় মারা গেছে।

রাউন্ড শেষ করে কানু সরেনের লাশ নিয়ে চিন্তায় পড়তে হল । তার তো কেউ নেই!
হাসপাতালের প্রধান কর্মকর্তাকে জানানো হলো।

তিনি বললেন, আগেই থানায় জানানোর কোন প্রয়োজন নেই। যেহেতু অজ্ঞাত নামা নয় ; অফিসিয়াল রেকর্ডে তার নাম ঠিকানা আছে তাই বাড়ির ঠিকানায় লোক পাঠাতে হবে।

পরিচ্ছন্নতা কর্মী গুরুচরন কে পাঠানো হলো নিমগাছি।

দুপুরের পরে গুরুচরন একলা একলা শুষ্ক মুখে ফিরে এল। বললো - নিমগাছি গ্রামের শাঁওতাল পাড়ায় তন্ন তন্ন করে খুঁজেও এই নামের কাউকে পাওয়া যায় নাই। তবে গ্রামের একজন বয়স্ক লোক বলেছেন, অনেক আগে কানু সরেন গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। তার বা তার পরিবারের কথা আর কেউ জানেনা।

মহা চিন্তার বিষয়। মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হলে -' বেওয়ারিশ লাশ ' চলে যেতো কলেজের এনাটমি ডিপার্টমেন্টের ডিসেকশন রুমে। ছাত্রদের কাজে লাগতো।

লাশটি অনেকদিন যাবত বড় চৌবাচ্চায় ফরমালিনে ডুবিয়ে রাখা হতো। তারপরে ছাত্র ছাত্রীরা ধীরে ধীরে লাশটি কুচি কুচি করে কেটে কেটে ' এনাটমি ' স্টাডি করতে পারতো!

এখন আমি কি করতে পারি?

হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা হিসেবে আমার ঘাড়ে এসে পড়ল সব দায়িত্ব। ওয়ার্ডের বারান্দায় সরকারি চাদরে মোড়ানো শুয়ে আছে কানু সরেনের লাশ।

'বেওয়ারিশ লাশ' ডিসপোজালের জন্য থানায় একখানা চিঠি লিখে দায়িত্ব এড়ানো যেতো। সেটাও দীর্ঘ প্রক্রিয়া।

গুরুচরনকে পাঠালাম পাশের ফলিয়া গ্রামের হিন্দু পাড়ায়। কিছু চাঁদা তোলা হল নিজেদের মধ্যে।

হাসপাতালের ট্রলি ঠেলে লাশ নেওয়া হলো ফলিয়া শ্মশান ঘাটে।

গ্রামের লোকেরা দাহ করার প্রস্তুতি নিয়েছে।

এখানেও সমস্যা ; শাঁওতালি বিধিবিধান জানা নেই, অনেক শাঁওতালের মত কানু সরেন খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত কিনা তাও জানা নেই। দাহ করা হবে, নাকি কবর দেয়া হবে?

কবর দেয়ারই সিদ্ধান্ত হল।

অবশেষে পশ্চিম দিগন্তে যখন লাল থালার মত সূর্যটা বিদায়ের শেষ আবির ছড়িয়ে টুপ করে ডুবে গেল দিক চক্রবালের ঐ পাড়ে, আবছা অন্ধকার নেমে এল চরাচরে, কিচিরমিচির করে পাখিরা ফিরতে লাগলো নীড়ে, ঠিক সেই সময় কানু সরেনকে শুইয়ে দেয়া হলো কবরে।

ছেঁড়া কাপড়ের পুটলিটাও দেয়া হলো সাথে।

স্ত্রী নেই, পুত্র নেই, কন্যা নেই, আত্মীয়স্বজন নেই, পাড়া প্রতিবেশী নেই, নিজ ঠিকানা থেকে অনেক দূরে, অজানা অচেনা ফলিয়া গ্রামের লোকালয় থেকেও বেশ খানিকটা দূরে, নদীর ধারের শশ্মান ঘাটের ঝুড়ি ওয়ালা বটগাছের নিচে চিরকালের মত শুয়ে দেয়া হলো একজন মানুষকে। না সে হিন্দু। না সে খ্রিষ্টান কিংবা শাঁওতাল। স্রেফ একজন মানুষ ; জীবনযুদ্ধে পরাজিত একজন অসহায় মানুষ।

আস্তে আস্তে ফিরতি পথে পা বাড়ালাম। মনটা বিষাদে ভারী হয়ে গেলো। মানুষটা অনেক আশায় বুক বেঁধে আমাদের কাছে এসেছিলেন বাঁচার আকুতি নিয়ে।

আর তাকে আমরা রেখে গেলাম আপন জন থেকে অনেক দূরে অন্ধকার কবরে।

হঠাৎ মনে হলো! কানু সরেন আমাকে হাতের ইশারায় ডাকছেন -আকুতি ভরা চোখে হাত কচলাতে কচলাতে বলছেন -
ওষুদ দিবেক না?

c@ ডাঃ সুকুমার সুর রায়।

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়