ডা কামরুন লুনা

Published:
2022-05-17 20:58:40 BdST

বৃষ্টি"আমি চমৎকার লম্বা সুদর্শন এক ইয়াং ডাক্তার পেয়েছি যে আমার ডেথ ডিক্লেয়ার করছে, ব্যপারটা মন্দ না"


ডা. তারিক অনি,রেজিস্ট্রার, সার্জারী সানশাইন কোস্ট ইউনিভার্সিটি হসপিটাল, অস্ট্রেলিয়া

 

ডা. তারিক অনি
———

৯৭ বছর বয়স্ক এক চমৎকার হাসিখুশি বৃদ্ধা পেটে ব্যথা নিয়ে ইমার্জেন্সীতে এসছেন। বৃদ্ধা বার্ধক্যজনিত কারণে স্মৃতিশক্তিহীন, একেবারে শিশুর মত হাসিখুশি, খুবই মিশুক । স্ক্যান এ বৃদ্ধার কোলন( বৃহদান্ত্র) অবস্ট্রাকশন ধরা পড়লো।

বৃদ্ধার হেলথ কন্ডিশন এবং অনুসাঙ্গিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত হল অপারেশন করা হবেনা। আমি বৃদ্ধাকে দেখতে গেলাম। তাকে সব এক্সপ্লেইন করে সিদ্ধান্ত জানালাম। বৃদ্ধা হেসে বললো,

- ওয়েল! আমি চমৎকার লম্বা সুদর্শন এক ইয়াং ইন্ডিয়ান ডাক্তার পেয়েছি যে আমার ডেথ ডিক্লেয়ার করছে, ব্যপারটা মন্দ না। বেচে থাকলে আমি তোমার সাথে ফ্লার্ট করতাম। ডাক্তার, আমার হাতে কতটুকু সময় আছে ?

আমি একটু চুপ করে উত্তর দিলাম,
- ডিয়ার … এই প্রশ্ন টা সবসময় কঠিন। আমি গড না, কিন্তু আমার হিসেব বলছে আমরা বেশিদিন প্রেম করতে পারবো না, হাতে বেশি সময় নেই। সম্ভবত ২-৩ দিন। আমি সত্যি সরি।

বৃদ্ধার চোখের এক কোন দিয়ে নিমিষে একবিন্দু জল গড়িয়ে পড়লো। সেটা সে দ্রুত সামলে নিল। আবার সেই সুন্দর মায়াময় হাসি,
- কিন্তু ডক্টর, আমার পেটে ব্যথা সত্যি বেশি না। তোমার পেইন কিলারের পর ব্যাথা অনেকটাই কমে গেছে।
- হু
- আমি কি খেতে পারবো ? ওরা আমাকে খেতে দিচ্ছেনা। বলেছে তুমি না বললে খেতে দিবে না।
- হ্যা কেন পারবে না। অবশ্যই পারবে। কি খেতে চাও বল …
- টার্কি ফ্রাই, কিছু চিপস, সাথে এক গ্লাস ওয়াইন
- ঠিক আছে ।
- তোমার নাম কি ?
- অনি
- অনি, আমি তোমাকে মনে রাখবো, থ্যাংক ইউ ফর টেকিং কেয়ার অব মি। থ্যাংকস ফর বিইং কাইন্ড।

আমি ডিটেইল নোট লিখে সবার নীচে ছোট্ট দুটো লাইন লিখে সাইন করলাম,
- নট ফর সার্জারী।
- কেয়ার অব ডাইয়িং পাথওয়ে প্লিজ।

এরপরের দশ-বারো ঘন্টা আমি ব্যস্ত হয়ে গেলাম। একগাদা রোগী দেখতে হল। পরপর তিনটা সার্জারী হল। একটা সার্জারী ভালো ঝামেলা হল - ঘাম ছুটে গেল। রাত দুটায় থিয়েটার থেকে বের হয়ে মুখে পানির ছিটা দিয়ে ফ্রেশ হয়ে একটা কফি নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হলাম। বাইরে ঝিরঝির বৃষ্টি। কফিতে চুমুক দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিতেই বৃদ্ধার শেষ কথাগুলো মনে পড়লো,

“অনি, আমি তোমাকে মনে রাখবো, থ্যাংক ইউ ফর টেকিং কেয়ার অব মি। থ্যাংকস ফর বিইং কাইন্ড”

কথাগুলো কানে ঘুরতে লাগলো,
.
থ্যাংক ইউ ফর টেকিং কেয়ার অব মি … থ্যাংকস ফর বিইং কাইন্ড .
.
থ্যাংক ইউ ফর টেকিং কেয়ার অব মি … থ্যাংকস ফর বিইং কাইন্ড …

নাহ। বৃদ্ধা মাথায় ঢুকে গেছে দেখছি। গাড়ি থেকেই হাসপাতালের সুইচ এ ফোন দিয়ে সার্জিক্যাল ওয়ার্ড কল ডাক্তারকে অনুরোধ করলাম বৃদ্ধাকে এক নজর দেখে আমাকে একটু জানাতে। ওয়ার্ড কল জুনিয়র জানালো, “বৃদ্ধা কমফোর্টেবল, অর্ধচেতন. শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। সিরিন্জ ড্রাইভার চলছে।” আমি ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রাখলাম।

সানশাইন কোস্টের আকাশ আজ সারাদিন ই একটু মেঘলা। দিন এ কয়েক পশলা বৃষ্টি হওয়ায় সন্ধ্যা থেকেই একটু ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। তার উপর এই রাত দুটোয় ঝিরঝির বৃষ্টি,সাথে মৃদুমন্দ বাতাস। আমার হঠাৎ মনে হল মৃত্যুর জন্য আজকের রাত টি চমৎকার একটি রাত। আমি মনে মনে বৃদ্ধার জন্য প্রার্থনা করলাম, “তার জীবনের শেষ মুহুর্তগুলো যেন সুন্দর প্রশান্তিময় হয়।”

ড্রাইভ স্টার্ট দেওয়া মাত্রই প্লে লিস্ট অন হয়ে গাড়িতে গান শুরু হল। বাইরের চমৎকার আবহাওয়া আর কফির আমেজের কারণেই কিনা জানিনা, কিংবা হয়তো একটি প্রশান্তিময় মৃত্যুর অপেক্ষার কারণেই, বন্যা চৌধুরী তার অমৃত কন্ঠের সবটুকু উজাড় করে গাইছেন, কন্ঠে তার সুর ঝরে পড়ছে…

“আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ।
খেলে যায় রৌদ্র ছায়া, বর্ষা আসে বসন্ত ॥
আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ।”

আমার গাড়ি রাতের অন্ধকার চিরে নিকলিন হাইওয়েতে ঘন্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে দ্রুত ছুটে চললো।

তারিক, চমৎকার বৃষ্টির রাত ।
৬.৫.২০২২

তারিক
,

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়