Dr.Liakat Ali

Published:
2022-01-04 05:37:14 BdST

প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করার অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি


লেখক

 

ডা. আহমেদ শরীফ শুভ
________________

অনুভূতির গল্প………

বাংলাদেশের দু’একজন সাংবাদিক আছেন যারা মানুষের চরম দূর্যোগের সময় তাদের ‘অনুভূতি’ জানতে চেয়ে অহরহ সমালোচিত হন। মানুষের চরম প্রতিকূল সময়ে তার অনুভূতি জানতে চাওয়া এক ধরণের প্রহসন মনে হতে পারে। তবে সে কঠিন সময়টা অতিক্রান্ত হয়ে গেল তার অভিজ্ঞতা থেকে অন্যদের শেখার এবং প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নেয়ার অবকাশ থাকতে পারে। সেই লক্ষ্যেই আমার কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি যদি কারো উপকার হয় এই ভেবে।

আমার বাইপাস অপারেশনটি অন্য অনেক বাইপাসের চেয়ে আলাদা বলে মনে হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কি হয়? হঠাৎ করে বুকে ব্যথা, শ্বাস কষ্ট, এম্বুলেন্স কল। ভেঁপু বাঁজিয়ে হাসপাতালে যাওয়া। অক্সিজেন, মরফিন, এনজিওগ্রাম- তারপর স্ট্যান্টিং কিংবা বাইপাস। সব কিছু হয়ে যায় ঘোরের মধ্যে। রোগী কিংবা তার কাছের মানুষেরা খুব একটা কিছু বুঝে উঠার আগেই অপারেশনের টেবিলে। ভাবাভাবির সময় খুব একটা থাকে না।

আমার বেলায় বিষয়টি ছিল ভিন্ন। বুকে ব্যথা নেই। অনেক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলে সামান্য একটু শ্বাসটান হতো। চেক আপ করাতে গিয়ে একাধিক ব্লক ধরা পড়লো। সেগুলো আবার স্ট্যানটিং করার উপযুক্ত না। মেলবোর্ণের কার্ডিওলজিষ্ট, ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিষ্ট এবং কার্ডিয়াক সার্জন মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন বাইপাসই সর্বোত্তম পন্থা। যেহেতু আমি এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নই সেহেতু তাঁদের সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দেয়ার মনস্থির করলাম। তবুও ভাবলাম কয়েকজন কাছের মানুষের সাথে পরামর্শ করি। আমার দুই সহপাঠি বন্ধু দেশে বিশিষ্ট কার্ডিওলজিষ্ট। আরেকজন অনুজপ্রতিম বন্ধু দেশের একটি নামকরা কর্পোরেট হাসপাতালের কার্ডিওলজিষ্ট। রিপোর্ট দেখে তাঁরা একই মত দিলেন। আমাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের একজন অনুজ বর্তমানে নিউইয়র্কে কর্মরত ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিষ্ট (যিনি আমার অনেক জুনিয়র বলে তাঁর সাথে ক্যাম্পাসে কোনদিন দেখা হয়নি, আগে কোনদিন কোন আলাপ পরিচয়ও হয়নি ভার্চুয়ালি) আমার ফোন নম্বর সংগ্রহ করে আমাকে ফোনে প্রায় ৪০ মিনিট ধরে বোঝালেন কেন আমার বাইপাস করা উচিত, কার্ডিয়াক সার্জনকে কি কি প্রশ্ন করতে হবে, কোন এপ্রোচ নিতে হবে। ওর সাথে কথা বলে আমি ১০০% কনভিন্সড হলাম। আমার পরিচিত ও বন্ধুদের মধ্যে যাদের বাইপাস হয়েছে তারাও কয়েকজন ফোন করে আমাকে সাহস দিলেন।

তারপর অপারেশনের জন্য অপেক্ষার পালা। অনেক খোঁজ খবর নিয়ে কার্ডিয়াক সার্জন নির্বাচন করলাম। মেলবোর্ণের সবচেয়ে নামকরা ২/৩ জনের একজন। তাঁর সাথে এপোয়েন্টমেন্ট করা হলো। বাইপাসের প্রকৃয়া, রিস্ক-বেনেফিট নিয়ে আলাপ হলো। উনি জানালেন, হার্ট – লাঙ্গস ষ্টপ করে বাইপাস মেশিন দিয়ে রক্তসঞ্চালন আর শ্বাস প্রশ্বাস কৃত্রিম উপায়ে চালানো হবে অপারেশনের সময়। সব কিছু ঠিক থাকলে ব্রেষ্টবোনের দুই পাশ থেকে দু’টো এবং প্রয়োজনে বাম ফোরআর্ম থেকে আরেকটা ধমনী নিয়ে হার্টের রোগাক্রান্ত ধমনীগুলো বাইপাস করে দেবেন। বললেন, এ ধরণের অপারেশন উনার জন্য ডাল-ভাত। সাথে এটাও বললেন, অপারেশনের সময় মৃত্যুঝুঁকি ১% এবং ষ্ট্রোকের ঝুঁকি ৫%। সেই সাথে মাল্টি-অর্গান ফেইলিউর (বহু-অঙ্গ বিকল) এর সম্ভাবনা, এরিদমিয়া (হার্টের অনিয়ন্ত্রিত ও অনিয়মিত স্পনন্দ) সহ অন্যান্য ঝুঁকি তো রয়েছেই। একেবারে রক্ত হিম হয়ে আসা তথ্য। অথচ অপারেশনের বিকল্প নেই। বাইপাস অপারেশন না করা মানেই একটি বিস্ফোরনোম্মুখ টাইম বোমা বুকের মধ্যে পুষে রাখা। সব আশংকা ঝেড়ে ফেলে অপারেশনের মন স্থির করলাম। এই সিদ্ধান্তে রুমার ইতিবাচক মনোভাব আমাকে অনেক সাহস যুগিয়েছে। ওর মধ্যে কখনো সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিধা দেখিনি।

আপনারা যারা ফ্যামিলি মেডিসিন, সাইকিয়াট্রি কিংবা সাইকোলজির ছাত্র তারা যানেন যে, মানুষ যখন কোন দুঃসংবাদ বা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয় তখন সে ৫ স্তর প্রতিক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যায়। তাকে আমরা বলি DABDA.

D (Denial): অসম্ভব! আমার এটা হতেই পারে না। আমার ডায়বেটিস, হাইপারটেনশন কিছুই নেই। বুকে ব্যথা নেই। সিগারেট খাই না। কোলেষ্টেরল নিয়ন্ত্রণে। আমার কেন হার্টে ব্লক হবে! এক বন্ধু ঢাকা থেকে ফোন করে বললেন, আমার মনে হয় অন্য কারো রিপোর্ট তোর রিপোর্টের সাথে মিক্স-আপ হয়ে গেছে। ভালো করে খবর নে (হা হা হা…)। যে দিন এনজিওগ্রাম করতে যাই সেদিনও ভেবেছি খুব বেশি কিছু হলে হয়তো একটা ষ্ট্যান্ট লাগবে, দেশে যাওয়া ২ সপ্তাহ পেছাবে। সুতরাং, অন্তরা আর রুমাকে দেশে যাওয়ার শপিং করতে পাঠিয়েছি।

A (Anger): আমার কেন হার্টের ব্লক হবে। তাইলে নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করে, এতো একটিভ থেকে লাভ কি হলো? কত মানুষ চেইন-স্মোকার, কারো ডায়বেটিস আছে, হাইপারটেনশন আছে, কোলেষ্টেরল কখনো চেকই করে না, শরীর ভর্তি মেদ। তাদের কিছু হয় না, অথচ আমার! এ কেমন বিচার!! মা’কে দেখতে দেশে যাওয়ার প্রিপারেশন নিলাম ২ বছর পর। আর এখনই আমার হার্টের ব্লক ধরা পড়তে হবে???

B (Bargaining): এতদিন পর দেশে যাওয়ার সব প্রিপারেশন কমপ্লিট। ছুটি নেয়া হয়ে গেছে। টিকিট কিনে ফেলেছি। ব্যাগ গোছানো অর্ধেক শেষ। দেশের আইটিনারারি সাজিয়ে ফেলেছি। আচ্ছা, দেশ থেকে এসে ফুল এনজিওগ্রাম করালে হয় না? তখন না হয় যা করার করবো।

D (Depression): নিজের পরিনতি, সম্ভাব্য বিপদের আশংকা, অপারেশনের ঝুঁকি ইত্যাদি ভেবে অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দা, বিষন্নতা, মনোসংযোগে চিড় ধরা।

A (Acceptance): কোন উপায় তো নেই। যতই ঝুঁকি থাকুক বাইপাসের বিকল্প নেই। না করালে ঝুঁকি বহুগুণে বেশি। ভাগ্যিস, সমস্যাটা ধরা পড়েছে। নইলে তো বাইপাস করানোর সুযোগ নাও পেতে পারতাম। নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তার কৃপা আছে বলেই হার্ট এটাক হবার আগেই ব্লকগুলো সনাক্ত হয়েছে। সুতরাং, বাইপাসের জন্য মনকে প্রস্তুত করাই শ্রেয়। সেভাবেই প্রস্তুত হলাম।

এই পাঁচ স্তর প্রতিক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন জন ভিন্ন ভিন্ন সময় নেন। সৌভাগ্য বশতঃ আমি ১ – ২ দিনেই পঞ্চম স্তরে পৌঁছে গিয়েছিলাম বলে আমার জন্য নিজেকে সামলানো খুব একটা কঠিন হয়নি। হয়তো আমার চিকিৎসাবিজ্ঞানের জ্ঞান আমাকে সাহায্য করেছে। কার্ডিওলজিষ্ট বন্ধুদের পরামর্শ এবং যাদের বাইপাস হয়েছে তেমন কয়েকজনের সাহস যোগানোও কাজে লেগেছে। সর্বোপরি রুমা, অন্তরা ও সৌরভের ইতিবাচক মনোভাব আমাকে ইতিবাচক থাকতে সাহায্য করেছে দারুনভাবে। এমন নয় যে ওদের মধ্যে কোন আশংকা ছিল না। কিন্তু সেটা তাদের প্রকাশে ছিল না। সব কিছুই স্বাভাবিক ছিল বাসায়। যেন এপেন্ডিসেকটমির মতো সাধারণ কোন অপারেশন হবে। তবে তাদের হৃদ-স্পন্দন ঠিকই টের পেয়েছি।

পরিবারের বাইরে আমার যারা খুব কাছের মানুষ আছে তারাও সাহস যুগিয়েছে নিরন্তর। জানতাম, সবাই আমার পাশে আছে।

দেশ দেশান্তর থেকে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু ও প্রিয়জনেরা ফোন করে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। আমার এই অবস্থা তাদের কাছে অবিশ্বাস্য। সেই সাথে অভয় দিয়েছেন। তাঁদের দোয়া ও শুভ কামনার কথা বলেছেন। তবে এর মধ্যেও কারো কারো কথায় প্রচ্ছন্ন আশংকার ইঙ্গিত টের পেয়েছি। এতো শুভেচ্ছা ও শুভ কামনার মধ্যেও নিজের অজান্তে অলক্ষেই তা কিছুটা হলেও মানসিক চাপ তৈরি করেছে। তবে এই ফোন কলগুলো যদি না পেতাম মানসিক চাপটা আরো অনেক বেশি হতো এইটুকু বলতে পারি। তার মানে, যে কোন ভাবেই মানসিক চাপ থেকে মুক্তি নেই। কারো কারো সাথে কথা বলার সময় উভয়পক্ষের কন্ঠই ভারি হয়ে এসেছে, অশ্রুপাত হয়নি এমনও নয়। কেউ কেউ ভেবেছেন আমি হয়তো ভয় পেয়েছি, ভেঙে পড়ছি। বিষয়টি মোটেও তেমন ছিল না। কন্ঠ ভারি হয়ে আসা কিংবা অশ্রুপাতকে আমি দুর্বলতার নামান্তর মনে করি না। আমার মনে হয় এগুলো ভালোবাসা আর আবেগের নামান্তর। আশংকা যে ছিল না তা নয়। তবে আমি আমার নিয়তিকে ততক্ষণে সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছের কাছে সমর্পণ করেছি। পরিবারের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত ছিলাম, আশংকা ছিল অনাগত সময় নিয়ে; কিন্তু ভয় সামলে নিয়েছিলাম। এই কঠিন সময়ে সৃষ্টিকর্তা তাঁর অপার মহিমায় আমার সাহসকে লালন করেছেন। সাহস ধরে না রেখে তখন আমার কীইবা করার ছিল!

অপারেশনের আগের দিন ৭ই ডিসেম্বর আমার শ্যালক শোভন আমাকে ড্রাইভ করে হাসপাতালে নিয়ে গেল ভর্তির জন্য। সাথে রুমা, অন্তরা ও সৌরভ। সকালে ঘুম থেকে উঠে রুমা বললো সারারাত স্বপ্ন দেখেছে ওর সামনে নানা বাধা আসছে। কিন্তু সবগুলোই পার হয়ে যাচ্ছে কষ্ট হলেও। ওর এই কথাগুলো আমার সাহসে নতুন মাত্রা যোগ করলো। সৃষ্টিকর্তাকে বললাম, ‘তোমার অপার মহিমা এবং করুনা গ্রহণে আমি প্রস্তুত’।

কোভিড নিষেধাজ্ঞার কারণে আমাকে হাসপাতালের গেইটেই ওদের বিদায় জানাতে হলো। সৌভাগ্যক্রমে যদি বাসায় ফিরতে পারি তবেই আবার দেখা হবে। রুমা, অন্তরা ও সৌরভ গভীরভাবে আলিঙ্গন করে বিদায় দিল। ওরা খুব শান্ত ছিল। আমিও। আমাদের জীবন তো তাঁর ইচ্ছের কাছে সমর্পিত। আমি এবং ওরা অনিশ্চিত গন্তব্যে যাত্রা করলাম বিপরীতমুখি পথ ধরে।

আমার যে কেবিন সেখানে ঢোকামাত্র বেয়ারা নিয়ে এলো ফুলের স্তবক। একজন অনুজপ্রতিম বন্ধু (সিএমসিয়ান) সুদূর পার্থ থেকে পুষ্পস্তবক পাঠিয়েছে। জানি না, আমি কোন হাসপাতালে কোন কেবিনে ভর্তি হয়েছি তা কীভাবে ট্র্যাক করেছে। চরম উৎকন্ঠার মধ্যেও তার এই বদান্যতায় নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হলো, সাহসী হয়ে উঠলাম। এইসব ভালোবাসার দায়ে হলেও সুস্থ হয়ে উঠতে হবে!

তারপর থেকে পরদিন আন্ডার এনেস্থেশিয়া হওয়ার আগে পর্যন্ত সময়টা ছিল প্রচণ্ড ইন্টিমিডেটিং (সঠিক বাংলা খুঁজে পেলাম না)। মনের মধ্যে হরেক রকম ভাবনা এবং আশংকা আসা যাওয়া করতে লাগলো। ইতিবাচক দিক হলো সময়টা ওরা এমনভাবে সাজায় এবং ব্যস্ততায় কাটিয়ে দেয় যে ইন্টিমিডেটিং ভাবনাগুলো বেশিক্ষণ স্থায়ী হওয়ার সময় পায় না। ক্ষণে ক্ষণে টেম্পারেয়ার চেক, ব্লাড প্রেসার মাপা, ইসিজি করা, হিষ্ট্রি নেয়া, না না রকম কনসেন্ট ফর্মে সাইন করা – সব মিলিয়ে ওভারহোয়েলমিং সময়।

এর মধ্যে সন্ধ্যায় প্রি-অপারেটিভ ভিজিটে এলেন কার্ডিয়াক সার্জনের সহকারী। তাঁর বসের মতোই সব কিছু বুঝিয়ে বললেন। শুধু একটা পার্থক্য। অপারেশন টেবিলে মৃত্যুঝুঁকি আসলে ১% নয়, ২%। অর্থাৎ, আগে যা শুনেছিলাম তার দ্বিগুণ। পশ্চিমা দেশের বিবেচনায় একটু বেশিই বৈকি! ততক্ষণে আর ফেরার উপায় নেই। দাঁতে দাঁত চেপে রইলাম। আমার জীবন তো স্রষ্টার ইচ্ছের কাছেই সমর্পিত। কার্ডিয়াক সার্জন এলেন। বললেন, নিশ্চয়তা তো দিতে পারবো না। তবে আস্থা রাখতে পারো। এই অপারেশন আমার ব্রেড এন্ড বাটার। এই কাজে আমার চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ সার্জন অষ্ট্রেলিয়ায় বড়জোর দুইজন।

এনেস্থেটিস্ট এলেন প্র-অপারেটিভ ভিজিটে। সাহস দিলেন। এনেস্থেশিয়ার প্রকৃয়া ব্যখ্যা করলেন। বললেন, কার্ডিয়াক এনেস্থেশিয়া উনার স্পেশালিটি। আমাকে নির্ভয় থাকতে বললেন। বললেন, আগামী কালের দিনটা নিয়ে ভেবো না। সেটার দায়িত্ব আমাদের। তোমার কিছু করারও নেই। তুমি রিকভারির সময় নিয়ে ভাবো। সেখানে নিজেকে সুস্থ করার ব্যাপারে তোমার দায়িত্ব অনেক। যদিও ১০০% নিশ্চয়তা দিতে পারবো না, তবুও বলছি আগামীকাল নিয়ে নির্ভাবনায় থাকতে পারো। আমরা আমাদের সর্বোচ্চটাই দেবো। সেটা তো জানি। সাহস পেলাম।

সবচেয়ে ইন্টিমিডেটিং সময়টা এলো যখন নার্স একটা ড্রাই শেভিং ইলেকট্রিক রেজর নিয়ে আর দু’টো বিটাডিন এন্টিসেপটিক বার নিয়ে এসে বললো, বাথরুমে গিয়ে গলা থেকে হাঁটু পর্যন্ত শেভ করো আর এন্টিসেপটিক বার দিয়ে এখন একবার আর সকালে একবার গোসল করো। এটা অপারেশনের প্রস্তুতি। এই গোসলটা আমার কাছে কিছুটা হলেও ভীতির সঞ্চার করলো। কেন জানি আমার কর্ণেল তাহেরের অন্তিম সময়ের কথা মনে পড়লো (অনেক বিপদের সময়ই নিজের অজান্তে আমার কর্ণেল তাহেরের কথা মনে হয়ে যায়)। তিনি জানতেন সেই গোসলের পর উনার জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা ০%। আর পরিসিংখ্যান অনুযায়ী অপারেশনের পর আমার সুস্থ হয়ে উঠার সম্ভাবনা আল্লাহর রহমন্তে ৯০% এর বেশি। তিনি সেই ভয়ংকর পরিস্থিতি কীভাবে সামলেছিলেন তার বাহ্যিক দিকটা আমরা জানলেও অন্তর্নিহিত দিকটা কোনদিনই জানতে পারবো না। সে সব কথা ভাবতে ভাবতে আর দোয়া দরুদ পড়তে পড়তে সেই সময়টা পার করলাম আর নার্সের নির্দেশ পালন করলাম।

অন্ততঃ ৮ ঘন্টা খালি পেটে থাকতে হবে। হাসপাতালের দেয়া ডিনার সেরে ওদের দেয়া ঘুমের অষুধ খেয়ে ঘুমাতে গেলাম। নইলে সেই বিভিষিকার মধ্যে ঘুমানো সম্ভব হতো কি? চোখ বন্ধ হওয়ার আগে বাসায় ফোনে কথা হলো। দোয়া সব সময় মুখ ফুটে চাইতে হয় না। দু’ একজন কাছের মানুষ ফোন করলেন। সবাই দোয়ার কথা বললেন, অভয় দিলেন। সবাই আপ্রাণ চেষ্টা করলেন নিজেদের উৎকন্ঠা আড়াল করতে।

দোয়া দরুদ পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। ভোর সাড়ে পাঁচটায় নার্স এসে জাগিয়ে দিল। বিভিন্ন ডকুমেন্টে আবারো সাইন করতে হলো। ওটিতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। ফাইনাল গোসলে পাঠালো বিটাডিন দিয়ে গোসল করাতে। তার আগে রুমাকে একবার ফোন করলাম। বললাম, যাচ্ছি; দোয়া করো।

গোসল সেরে আসার পর ঘুমের অষুধ দিল। ওটির ট্রলিতে উঠতে বললো। সেই সাথে মরফিন ইঞ্জেকশন। আর কিছু বলতে পারবো না। যখন গলার মধ্যে এন্ডোট্রাকিয়াল টিউব একটু একটু করে টের পেলাম, ডাক্তাররা এসে তাঁদের আঙুল চেপে ধরতে বললেন, পায়ের আঙুল নাড়াতে বললেন, ঘুমের ঘোরে বুঝলাম, বেঁচে আছি তাহলে। ঢাকাই সিনেমার ভাষায় – অপারেশন সাকসেসফুল। ঘোরের মধ্যেই জিজ্ঞেস করলাম, কয়টা বাজে? একজন ডাক্তার উত্তর দিলেন রাত সাড়ে ১২টা। আমার জানামতে অপারেশন শুরু হয়েছিল সকাল ৮টায়, এনেস্থেশিয়া দেয়ার কথা তারো আগে। স্মরণ থেকে উধাও ১৭ ঘন্টা। ঘুমের ঘোরেই সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। তাঁর কাছে যে জীবন সমর্পণ করেছিলাম, পরম অনুগ্রহে তিনি তা ফিরিয়ে দিয়েছেন। তুমি তাঁর কোন মহিমাকে অস্বীকার করবে!

৮ই ডিসেম্বর সারাদিন গেল এনেস্থেশিয়ার ঘোরে। সেদিনের কোন কিছুই আমার স্মরণে নেই। নিজে সজ্ঞানে না থাকায় সেদিনের কোন উৎকন্ঠাও আমাকে প্লাবিত করতে পারেনি। অথচ সেদিনটি আমার পরিবার ও পরিবারের বাইরের প্রিয়জনদের জন্য ছিল ভিষন উৎকন্ঠার। দেশে ও প্রবাস থেকে আমার অপারেশন চলাকালীন রুমার কাছে উৎকন্ঠিত প্রিয়জনদের ফোন এসেছে মুহুর্মূহু। যাদের সাথে দেখা হয়নি, কথা হয়নি বছরের পর বছর তারাও প্রতি মূহুর্তে আপডেট জানতে চেয়েছেন। পরে শুনেছি আর অবাক হয়েছি। তাদের অনেকের উৎকন্ঠা টের পেয়েছি নয় হাজার কিলোমিটার দূরে বসেও।

প্রথমে যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম তা দিয়েই শেষ করি। বলছিলাম অনুভূতির কথা। আমার এই পথ পরিক্রমায় (যা এখনো চলমান) যদি কোন একটি অনুভুতিকে প্রাধান্য দিতে হয় তবে তার নাম ‘কৃতজ্ঞতা’। আমার জীবনের এই ক্রান্তিকালে আমি যে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ পেয়েছি, জানি আমি তার যোগ্য নই। তবুও সেই ভূবনছাপানো ভালোবাসার নিয়ে না লিখলে অকৃতজ্ঞতা হবে। সেটা নিয়ে লিখবো।

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়