ডেস্ক

Published:
2021-07-09 13:58:32 BdST

অক্সিজেন সংকট আর ব্যবস্থাপনা নিয়ে কয়েকটি কথা


 


অধ্যাপক মওদুদ আলমগীর পাভেল
________________________


সব প্রস্তুতি, প্রতিরোধ আর সতর্কতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে করোনা সংক্রমণ বেড়েই চলেছে, এখন দৈনিক মৃত্যু ২০০ ছাড়িয়ে, হাসপাতালে শয্যা আর অক্সিজেনের হাহাকার। এবারের আক্রমণ আর শহরে কেন্দ্রীভূত নয়, এটা এখন গ্রামের ঘরে ঘরেও পৌছে গেছে। অবশ্য এটা খুব অপ্রত্যাশিত তা বলা যাবে না। করোনা নিয়ে আমাদের তাচ্ছিল্য আর স্বাস্থ্য বিধি না মানার ধনুর্ভঙ্গ পণ সরকারের সব কার্যক্রমকে সফল হতে দেয়নি। যেদেশে স্বাস্থ্য বিধি ভঙ্গের দায়ে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকা জরিমানা আদায় হয় সেখানে এসব নিয়ে কথা না বলে বরং অন্য কথা বলি।
ক্রমবর্ধমান করোনা অতিমারী/ মহামারীকালে এর একমাত্র প্রমাণিত চিকিৎসা অক্সিজেন সংকট আর ব্যবস্থাপনা নিয়ে কয়েকটি কথা বলি। ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটলে মাঝপথে সঙ্গত্যাগ করবেন নির্দ্বিধায়।

অক্সিজেন সাশ্রয় -
-হাসপাতালে ভর্তি রোগীর ক্ষেত্রে অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯২-৯৩ এর নীচে না এলে বাড়তি অক্সিজেনের দরকার নেই।
- অহেতুক সেটা ৯৬ উপরে তোলার জন্য বাড়তি অক্সিজেন প্রবাহ অপ্রয়োজনীয় এবং অপচয়মাত্র।
-ফেস মাস্কের মাধ্যমে রোগীকে অক্সিজেন দিলে তার বেশীর ভাগই অপচয়, কারন শুধুমাত্র নিঃশ্বাসের সময়ই অক্সিজেন আমাদের ফুসফুসে পৌঁছে যা মিনিটে মাত্র ১৫-২০ বার অথচ অক্সিজেন প্রবাহ সার্বক্ষণিক চলমান। ফলে এই অপচয় রোধে নন রিব্রিদিং মাস্ক, ভেনচুরি মাস্ক ব্যবহারে স্বাস্থকর্মী, নার্স সবাইকে অভ্যস্থ হতে হবে। সাথে সাথে সারাক্ষণ অক্সিজেন না দিয়ে মাঝে মাঝে প্রয়োজন মত সিপ্যাপ, বাই প্যাপও ব্যবহার করতে হবে।
- পর পর ২-৩ দিন অক্সিজেন ছাড়া শরীরে স্বাভাবিক অক্সিজেন মাত্রা থাকলে তাকে দ্রুত ছুটি দিয়ে অন্যকে ভর্তির সূযোগ দিতে হবে।

মনে রাখা দরকার -
- হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা স্বাভাবিক অক্সিজেন প্রবাহের চাইতে কমপক্ষে ৬ থেকে ১০ গুন বেশী পরিমাণ অক্সিজেন ব্যবহার করে।
-তাই হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার সংখ্যা শুধু বাড়ালেই চলবে না, এর জন্য যে পরিমাণ বাড়তি অক্সিজেন প্রয়োজন হবে সেটার ব্যবস্থা আগে করা - নইলে বিরূপ জন প্রতিক্রিয়া হবে।
- অক্সিজেন ফ্লো মিটার নিয়মিত পরীক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা।
-শেষ বিন্দু অক্সিজেন নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত সেটা খালি না বলা।
- রোগী বা তার পরিচর্যাকারী যেন নিজে নিজে অক্সিজেন প্রবাহ বৃদ্ধি না করতে পারে।

আমরা জানি-
- দেশে মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদন সীমিত, লিন্ডে স্পেক্ট্রা মিলে স্থানীয় ভাবে ১১০+৫৫-৬০, আনুমানিক ১৫০-১৬৫ টন তরল অক্সিজেন দৈনিক উৎপাদন করে আর প্রায় ৩০ টন আসতে শুরু করেছে ভারত থেকে।
- এস আলম বা অন্যরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন তৈরী করে ৫০-৬০ টন, তাদের চাহিদা অনুযায়ী, এগুলোই সম্বল।
- দেশে অক্সিজেন সিলিন্ডার তৈরী হয় না, আমদানি করতে হয়, যার রয়েছে বিরাট সংকট।
- বিভিন্ন কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের তরল অক্সিজেন প্লান্টের ধারণ ক্ষমতা ৫০০০-১৫০০০ লিটার তরল অক্সিজেন।
- মূল নির্ভরতা অক্সিজেন সিলিন্ডারের উপর।

আমরা না জানলেও, চাইলেই জানতে পারি -
- দেশে সব মিলিয়ে কতগুলো মেডিকেল অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে ?
- ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন সিলিন্ডার সংখ্যাই বা কত?

জানবো কি ভাবে?
- লিন্ডে, স্পেক্ট্রা দেবে মেডিকেল অক্সিজেন সিলিন্ডার এর হিসেব আর এস আলম দেবে ইন্ডাস্ট্রিয়ালের হিসেব।

এই সব তথ্য একখানে করে যা করা যায় -

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে জাতীয় অক্সিজেন গ্রীড তৈরী ( বিদ্যুতের লোড ডেসপ্যাচ সেন্টারের আদলে)

- তাদের মাস্টার কন্ট্রোল রুমে দেশের সকল কোভিড হাসপাতালের ডিজিটাল ডাইনামিক হালনাগাদ তাৎক্ষণিক তথ্য থাকবে, রোগীর সংখ্যা, রেগুলার-হাই ফ্লো -ভেন্টিলেটরসহ অক্সিজেন ব্যবহার পরিমাণ, অক্সিজেন প্লান্টে তরল অক্সিজেনের পরিমান, খালি-ভর্তি- ব্যবহাররত সিলিন্ডারের সংখ্যা, এসব কিছু ডিসপ্লে হবে।
-লিন্ডে - স্পেক্ট্রার মূল উৎপাদন প্লান্টে তরল অক্সিজেনের দৈনন্দিন উৎপাদন তথ্য
-ভারত থেকে আমদানি তথ্য
- ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্লান্টএর উৎপাদন তথ্য
- বিভিন্ন ডিপোতে খালি- ভর্তি সিলিন্ডার সংখ্যা
- রোগী ও সংক্রমণ তথ্যের ভিত্তিতে জেলাভিত্তিক অগ্রাধিকার ম্যাপ, কালো- লাল- হলুদ- সবুজ
যশোর, বগুড়া, ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশালে আন্চলিক অক্সিজেন বিতরণ কেন্দ্র। তাৎক্ষনিক বিতরণের জন্য
-ভারত থেকে আমদানি করা তরল অক্সিজেন লিন্ড- স্পক্ট্রার মূল প্লান্টে না নিয়ে সরাসরি দক্ষিণ পশ্চিমের জেলাগুলোয় চাহিদা মোতাবেক সরবরাহ।
- আরো অবনতি হলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন সিলিন্ডার জীবাণু ও ফাংগাস মুক্ত করে মেডিকেল অক্সিজেন হিসাবে ব্যবহার করা।
- প্রয়োজন বোধে নাইট্রাস অক্সাইড সিলিন্ডার গুলো অক্সিজেন সিলিন্ডার এ রুপান্তর করা
- পরিস্থিতির বিবেচনায় বিদ্যুৎ এর লোড সেডিং এর মত আক্রান্ত নয় এমন জেলার মজুদ ডাইভার্ট করা
- স্পেক্ট্রা, লিন্ডের নির্মানাধীন প্লান্ট দ্রুত চালু করার সব বাধা দূর করা
- প্রয়োজনে পরিবহন বিমানে অক্সিজেন সিলিন্ডার, ছোট ও মাঝারী আকারের অক্সিজেন জেনারেশন / কনসেনট্রেশান ইউনিট ( প্রতি মিনিটে ৫০০-৫০০০ লিটার অক্সিজেন উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন) যা কনটেইনার হিসাবে প্লাগ এ্যান্ড প্লে হিসাবে বিদ্যমান সেন্ট্রাল অক্সিজেন পাইপ লাইনের সাথে লাগিয়ে দেয়া যায়।

দেশের এই সংকটকালে অনিশ্চিত সম্ভবনার দিকে না তাকিয়ে অনাগত অশনী সংকেতের প্রস্তুতি নিই, সেটাই কাজের কথা।
মৃত্যুর এই চলমান, ক্রমবর্ধমান মিছিল আমরা আর দেখতে চাই না।
একটা মৃত্যু পরিসংখ্যানের খাতায় নিছক একটা সংখ্যা, কিন্তু একটা পরিবারে এটা অনাথের আর্তনাদ, বিধবার অসহায় চিৎকার, পিতার বুক চাপা দীর্ঘশ্বাস, মায়ের অন্তহীন অশ্রুস্রোত। আমাদের অদূরদর্শীতা এই যন্ত্রণার ঐকতানকে যেন নিদ্রাহীন বিষন্নতায় চিরস্থায়ী না করে প্রত্যাশার সুবাতাসে সবাইকে আন্দোলিত করে এই হোক প্রত্যাশা।

----------

অধ্যাপক মওদুদ আলমগীর পাভেল
অধ্যাপক (সার্জারী), টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ, বগুড়া
প্রাক্তন অধ্যক্ষ
শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, বগুড়া এবং দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ, দিনাজপুর; এবং
সাবেক সভাপতি, সোসাইটি অব সার্জনস অব বাংলাদেশ।

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়