রাজীব দে সরকার

Published:
2021-03-08 05:05:01 BdST

২ মিনিট পর আবার ফোন... কাকুতি মিনতি এবং তারপর


ডা. রাজীব দে সরকার 

------------------------------------

 

অনেক পুরোনো ঘটনা।
তারপরো মনে হলো এটা নিয়ে লেখা উচিৎ।

সার্জারী বিভাগে কাজ করছি।
রবিবার। সেদিন ছিলো আমাদের রুটিন ওটির দিন।

তো আমি আমাদের বিভাগের বিভাগীয় প্রধান স্যারের সাথে একটি সার্জারীতে অ্যাসিস্ট করছি।

এমন সময় ফোন এলো আমার মোবাইলে।
স্যারের সামনে থাকায় আমি ফোনটি ধরতে পারলাম না। তবে অপরিচিত নাম্বার। ৩ থেকে ৪ বার ফোনটি এলো।

মিনিট ২০ পার হয়েছে।
সার্জারী তখনো শেষ হয়নি। তবে প্রায় শেষের দিকে। আমার স্যার তখন ওয়াশ আউট হয়েছেন।
এমন সময় আবার ফোন।

আমি কানে একটি ব্লু-টুথ হ্যান্ডস-ফ্রী ব্যবহার করি ট্রেইনি লাইফের শুরু থেকে। সে সময়টা স্যার সামনে না থাকায়, আমি সহকর্মী ইন্টার্নী চিকিৎসকের মাধ্যমে কলটি রিসিভ করলাম...

"কি বাবা, কেমন আছো, অনেক বড় ডাক্তার হয়ে গেছো নাকি? তোমারে তো ফোনে পাই না !"
"জ্বী, স্লামালিকুম, কে বলছেন, আমি আসলে একটা অপারেশন এ আছি।"
"আচ্ছা, যেখানেই থাকো, শুনো। আমি তোমার গ্রামের অমুক কাকা। অমুক বাড়ির পাশের বাড়ি। আমার সম্মন্ধি ঝিনাইদা থেকে গেছে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হইতে। তুমি একটু দ্যাখো, কি অবস্থা"

"কাকা, জরুরী কিছু? নাহলে আমি একটু ফ্রী হয়ে আপনাকে ফোন দেই?"
"আচ্ছা, সে না হয় দিও। এখন, শুনো... তুমি একটু ঢাকা মেডিক্যাল যাও। গিয়ে দ্যাখো, ভর্তি হইসে কী না। একটা ভালো বেড দিতে বলবা। আমার বড় সম্মন্ধি, বুচ্ছো না"

"কাকা, আমি আমার হাসপাতালে অপারেশনে আছি। আমি একটু ফ্রী হয়ে আপনাকে ফোন দেই"
"শ্যাইডা, ফোন দিও, কিন্তু এক্ষুনি ঢাকা মেডিক্যালে গিয়ে ভর্তিডা করো। বুচ্ছো, আমার সম্মুন্ধি"

যেহেতু আমার গ্রামের অপরিচিত এই কাকা বুঝতেই পারছেন না, যে অপারেশনরত অবস্থায় একটি হাসপাতাল থেকে বের হয়ে অন্য হাসপাতালে যাওয়া যায় না, তাই তার সাথে কথোপকথন সমাপ্ত করলাম।

২ মিনিট পর আবার ফোন...

"শুনো, কাকা, সার্জারী করতে হবে আমার সম্মুন্ধির। বড় ডাক্তার দেখাইসে। তুমি কাল পরশুর ডেট দিয়ে দাও। ওরা ডেট পাইসে দুই সপ্তাহ পরে"
"কাকা, আমি ফ্রী হয়ে আপনাকে ফোন দিচ্ছি। আমার অপারেশনে এখনো শেষ হয়নি"
(আমি সে সময় আমবিলিকাল পোর্ট ক্লোজার করছিলাম। আদতে যা একটি ঠান্ডা মাথায় করার মতো কাজ!)

আবার ফোন...
আমি এবার আর আমার ইন্টার্নীকে ফোন না ধরতে ঈশারা করলাম।

৫ মিনিটের মধ্যেই আমার কাজ শেষ হলো।

আমি ওনাকে ফোন দিয়ে সব কিছু শুনলাম। সংক্ষেপে যা হলোঃ গ্রামের র‍্যানডম এই কাকার র‍্যানডম সম্মুন্ধির পাইলস এর অপারেশন করাতে হবে।

আমি ওটিতে বসেই আমার ২ বন্ধুকে ফোন দিলাম এবং তাদের একজনের সেদিনই অ্যাডমিশন ডে।

আমার অনুরোধে আমার বন্ধু এই রোগীকে ভর্তি নেবার কথা আশ্বস্ত করলো ওরই ইউনিটে। সাথে এটাও জানালো নেক্সট রুটিন ওটিতেই অপারেশন করে দেবে। ওর রুম নাম্বার আমাকে দিলো। আমাকে বললো, রোগী যেন ওর সাথে দেখা করে।

এই কাকাকে আমি ফোন দিলাম। সব কিছু বুঝিয়ে বললাম র‍্যানডম এই কাকাকে। উনি বুঝলেন এবং সে অনুযায়ী কাজ করবেন বলে আমাকে জানালেন।

৩ ঘন্টা পরে আমার বন্ধুর ফোন।
"কি রে, তোর রোগী তো আসলো না।"

আমি বাধ্য হয়েই র‍্যানডম কাকাকে আবার ফোন দিলাম। প্রথম এবং দ্বিতীয়বার রিঙ বেজে শেষ হলো। উনি তৃতীয়বারে আমার ফোন ধরলেন।

"ও, বাবা, শুনো। তুমি তো ব্যস্ত ছিলা অপারেশনে। রোগী বাড়ি চলে গেছে। ওরা প্রাইভেটে অপারেশন করাবে। আর ঐ হাসপাতাল এতো ময়লা যে ওগোর আর রুচি অয় নাই। আচ্ছা ভালো থাইকো।"

"কাকা, এটা তো আমাকে আগে জানাতে পারতেন। আপনার জন্য আমার ফ্রেন্ড তো অপেক্ষা করছিলো। আপনার রোগী যায় নি দেখে, ও আমাকে ফোন... ...টুট টু টুট টু"
কাকা ফোন রেখে দিয়েছেন। আমি আর কিছুই ওনাকে বলতে পারিনি।

হঠাৎ করে এক সাগর বিরক্তিতে ডুবে গেলাম। সেদিন আর কোন কাজ করতে ইচ্ছে করছিলো না। মানুষের অকৃতজ্ঞতার বোঝা নিতে নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে যাই মাঝে মাঝে।

এই একই ধরণের ঘটনা, আমার সাথে আরো ঘটেছে। আরো ঘটবে, তাও জানি।

কারন এই জাতির অকৃতজ্ঞতার ইতিহাস বহু প্রাচীন।

র‍্যানডম ঐ কাকাকে ঐদিনই ব্লক করে দিলাম।

"সেবা"... "সহযোগিতা"... "সাহায্য"... শব্দগুলো সবাই ডিজার্ভ করে না!

#Random_কাকা_কাহিনী
#rajibdeysarker

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়