Dr. Aminul Islam

Published:
2020-11-10 01:23:14 BdST

শাবানার কান্না



প্রতিকী ছবি। কাহিনির চরিত্রটির ছবি নয়।

ডা. সুকুমার সুর রায়
___________________________

সতেরো আঠারো বছরের সুন্দরী তন্বী মেয়েটি তার দুই তিন বছরের বাচ্চাটিকে বুকের সাথে সজোরে চেপে ধরে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ডাক্তারের চেম্বারে প্রবেশ করলো ।
বসতে বলায় সে ধীরে সুস্থে জড়সড় হয়ে কোন রকমে বসলো।
নাম জিজ্ঞেস করায় বলল "শাবু '- শাবানা। "
" তোমার সাথে আর কে এসেছে?"
কোন জবাব না দিয়ে সে অনেকক্ষন নিশ্চুপ বসে রইল। তার চোখে মুখে এক অদ্ভুত গ্রাম্য কিশোরীর সরলতা অথচ ছেয়ে আছে বিষণ্ণতার ছাপ।
" সাথে স্বামী আসেনি?" এই প্রশ্নেই তার মায়াবী চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো! দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল বাচ্চাটার গায়ে। তারপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে নিরবে কাঁদতে লাগলো!
বাচ্চাটা শক্ত করে মাকে জড়িয়ে ধরে আছে! নিরব কান্নায় কেঁপে কেঁপে উঠছে বাচ্চা সমেত মা'য়ের শরীর।
যেন কান্না নয়, অনেকদিনের জমানো কষ্ট বুক ঠেলে বাইরে বেড়িয়ে আসতে চাইছে ; বরফ গলে গলে অশ্রু হয়ে দুচোখ বেয়ে ঝরে পড়ছে!
" কেঁদো না। তুমিতো আমার মেয়ের বয়সী। তোমার কষ্টের কথা আমাকে খুলে বলো। "
ডাক্তার আবারো বললেন--
" তোমারতো বিয়ের বয়সই হয়নি, এই বয়সে তোমারতো পড়াশুনা করার কথা।"
আস্তে আস্তে মেয়েটি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে। একটু দম নিয়ে সে বলতে শুরু করলো --
'' আমার বাপজান আমারে খুব ভাল বাইসতো। আমি ছিলাম তার ছোট মাইয়া। আদর কইর‍্যা সিনেমার নায়িকার নামে আমার নাম রাইখছ্যে ' শাবানা '। কেলাশ নাইনে পড়ার সময় আমার বিয়া হয়।''
" তা তোমার বাপজান তো খুব ভাল বাসতো, তাহলে পড়াশুনা না করিয়ে এত অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দিলো কেন!? "
" আমার লেখা পড়ার খুব ইচ্ছা ছিল। ইচ্ছা ছিলো কলেজের লেখাপড়া শেষ কইর‍্যা ছোট খাটো কোন চাকরি বাকরি করবো। তার পর শহরের কোন শিক্ষিত চাকরি করা ছেলের সাথে আমার বিয়া হইবো ।"
" তা তোমার বাপজান লেখা পড়া না করিয়ে এতো অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দিলো! "
" বাপজান ছিল গরীব, চাষাভুষা মানুষ, লেখাপড়া জাইনতো না। এদিকে ইস্কুলে যাওয়া আসার পথে গ্রামের ছেলেপিলেরা আমারে ত্যক্ত কইরতো, এমনকি বড়রাও ড্যাব ড্যাব কইর‍্যা চাইয়া থাইকত্যো ।
ত্যক্ত বিরক্ত করা দিন দিন বাড়তেই লাগলো।
রাগ কইর‍্যা বাপজান একদিন কইল্যো - তোরে বিয়া দিয়া দিমু '।"
" একজন পাত্র আছিলো আর্মিতে চাকরি কইরতো। তারে আমি দেখি নাই, কিন্তু বাপজান কইল্যো - ' আর্মিতে চাকরি করে, সারা বছর বাদে একবার ছুটিতে বাড়িত আইসে ; এইরকম পাত্রের সাথে তোর বিয়া দিমু না। "
" আরো একটা পাত্র আছিল। শিক্ষিত, ব্যবসা করত্যো ।
আমারে দেইখতে আইছিল, পছন্দ ও করেছিল। আমিও মনে মনে পছন্দ করছিলাম । কিন্তু বাপজান বইলল্যো - "এতো দুরের জেলায় মাইয়ারে বিয়া দিমু না।"
"তাছাড়া এই পাত্র ব্যবসার জন্য টাকাপয়সা নিবার চায়, যৌতুক চায়। এইসব টাকা পয়সা দিবার গেলি একমাত্র ধানী জমিটা বেচা লাগব্যো! থাকব্যো খালি চরের ফুটা বালুর জমিটা। তাইলে সারা বছর খামু কি!?"
" তার পর বাপজান দেইখ্যা শুইন্যা এইখানে বিয়া দিছে।"
কথাগুলো এক'দমে বলে অবশেষে মেয়েটি চুপ মেরে গেল।
এইবার ডাক্তার বললেন - " তা তোমার স্বামী কি করে?"
" কিচ্ছুই করে না, আকাট মূর্খ! জমি চাষ করে, গরু বাছুর দেখাশোনা করে, বাড়িতে বড় টিনের ঘর, গরু ছাগল, খ্যাড়ের পালা, দেইখা বাপজান ভুইল্যা গেছিলো!
ঘটক বলছিল্যো- ' মোটা ভাত, মোটা কাপড়ের অভাব হবিনা।"
"তা বাপজান তো ভালই করেছে। দেখে শুনে অবস্থাপন্ন কৃষকের ঘরে তোমার বিয়ে দিয়েছে। তাতে তোমার সমস্যা কি?"
এইবার একটু ঝাঝালো গলায় মেয়েটি বলে বসল ;
" আমার স্বামী আমারে একদম ভালবাসেনা, শশুর শাশুড়িও দেখত্যে পারে না। তারা চায় আমি মুখ বুইজ্যা শুধু কাম করি ; ভাত রান্ধো, ধান সেদ্ধ করো, গরুর জাবনা দ্যাও ,! নুনের থ্যেকে চুন খসল্যে আমার বাপ মা তুইল্যা গালাগালি করে। চুলের মুঠি ধইর‍্যা আমারে নির্যাতন করে! আমার শখ আহ্লাদ তো দুরের কথা বাপের বাড়িও যাইতে দেয় না। আইজ বাপজানরে দেখতি যাইতে চাইছিলাম, শাশুড়ি কইল - ' বিয়ার আগে তোর বাপ একখান মালা দিব্যার চাইছিলো, মালা না দেওয়া পর্যন্ত তোর বাপের বাড়ি যাওয়া বন্ধ!' দ্যাখেন, দ্যাখেন আমার স্বামী কি কইরছে ; হাইল্যা নড়ি দিয়া আমারে পিটাইছে! আমার শাশুড়ি চাইয়া চাইয়া দেইখছে আর আরো জোরে জোরে পিটাইতে কইছে!"
বলেই সে বাম হাতের আঁচল সরিয়ে বললো - "এই যে দ্যাখেন! "
বাম বাহুতে চামড়ার নীচে জমাট বাঁধা রক্তের অনেক গুলি কালসিঁটে দাগ দেখা গেল! ।
মেয়েটি আবারো বাচ্চাটিকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপাতে লাগল।
ডাক্তার সাহেব কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল।
' একটি কিশোরী মেয়ে, স্কুলব্যাগ কাঁধে, বেনী দুলিয়ে, সহপাঠিদের সাথে হল্লা করতে করতে গ্রাম্য রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছে ' এই দৃশ্যটি কল্পনা করতে করতে কখন যেন ডাক্তারের চোখ ঝাপসা হয়ে গেল।'
বৈশাখের তীব্র গুমোট গরমের পর, বিকেল বেলায় ঈশান কোনে কালো মেঘ জমেছে! কালবৈশাখী ঝড়ের সাথে অঝোর ধারার বৃষ্টি যদি সব কিছু ধুয়ে মুছে ভাসিয়ে নিয়ে যেতো!!

 

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়