Dr. Aminul Islam

Published:
2020-10-22 15:09:13 BdST

" সোনার হরিণ "হাসপাতালের ইদ : এক আনন্দ বেদনার কাব্য


 


 ডাঃ সুকুমার সুর রায় 
__________________________


চিকিৎসা সেবার কাহিনি -- (তেইশ পর্ব)/ ঈদের সকাল।

ঈদের দিন সকাল বেলা।
জরুরি বিভাগের বারান্দায় একটি লাশ রাখা আছে। হাসপাতালের সাদা চাদর যাতে লাল রঙের ছাপ দেওয়া আছে 'সরকারি সম্পত্তি', তাই দিয়ে লাশটির আপাদমস্তক ঢাকা আছে।
লাশটির পাশে বসে একজন মধ্যবয়সী গ্রাম্য মহিলা অবিরাম বিলাপ করে চলেছেন।
দুই একজন উৎসুক মহিলা ও পুরুষ কিছুদূরে দাঁড়িয়ে উৎকন্ঠায় তাকিয়ে আছে লাশের দিকে।
চাঁদ রাতের প্রথমার্ধেও এটি লাশ ছিল না।
মেয়েটির নাম মোসাম্মৎ সালমা বেগম। বয়স -উনিশ বছর। স্বামীর নাম - মোঃ মোশারফ হোসেন। গ্রাম - খোজাখালি। জেলা - সিরাজগঞ্জ।
জরুরি বিভাগের রেজিস্টারে এইরকমভাবেই লেখা আছে।
সালমার শাশুড়ির কাছ থেকে যেটুকু জানা গেছে তা এইরকম --
সালমা রাতে ভাত খায় নাই।
স্বামী মোশারফ সন্ধ্যা সাতটায় বাজার থেকে বাড়ি ফিরেছিল।
দুইজনকে তাদের ঘরে জোরে জোরে কথা বলতে শুনেছে সালমার শাশুড়ি।
কিছু পরে মোশারফ রাগ করে বাড়ির বাইরে চলে যায়।
রাত দশটা নাগাদ ঘরে গোঙানির শব্দ পাওয়া যায়। মোশারফও ততক্ষনে বাড়ি ফিরে এসেছে।
সবাই মিলে ঘরে গিয়ে দেখে সালমা মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর গোঙরাচ্ছে। সালমার পাশেই মেঝেতে পড়ে আছে কীটনাশকের খালি বোতল।
চিৎকার চেঁচামেচি শুনে পাড়া প্রতিবেশীরা এগিয়ে আসে।
শুরু হয় টোটকা চিকিৎসা।
তেঁতুলজল খাওয়ানো হয়। তাতেও বমি না করায় গোবর গুলে খাওয়ানো হয়। তাতে কিছুটা বমি হয়। বমির সাথে সবুজ সবুজ ফেনা ফেনা কিছু জিনিষ বের হয়।
কিছু বমি করার পরে সালমা কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে যেতে শুরু করে।
দক্ষিন পাড়ার অভিজ্ঞ কলিম ডাক্তারকে ডেকে আনা হয়।
তিনি স্যালাইন এবং তিন রকমের ইঞ্জেকশন পুশ করে দেন।
রাত বারোটা নাগাদ সালমার গোঙানি থেমে যায়।
তখনো হাত পায়ের নড়াচড়া ছিল।
পাশের বাড়ির শরাফত চাচা তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেয়।
ভ্যানওয়ালা সিদ্দিককে অতি কষ্টে রাজি করিয়ে সালমাকে ভ্যানে তোলা হয়।
রাত দেড়টায় সালমাকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয়।
তরুন ডাক্তার জ্যোতি ভাস্কর সাহা সালমাকে পরীক্ষা করে বুঝতে পারেন এটি অর্গানোফসফরাস পয়জোনিঙের কেস।
তিনি চিৎকার করে সুইপার গুরুচরনকে ডাকেন- " শিগগীর সিস্টারকে আসতে বলো, স্টমাক ওয়াশের সরঞ্জাম নিয়ে আসো।"
সালমার তখন শেষ অবস্থা।
সালমা যেভাবে নিশ্বাস টানছে তাকে মেডিকেলের ভাষায় বলা হয় - " গ্যাস্পিং রেস্পিরেশন।"
সে যেন শরীরের সকল শক্তি দিয়ে এক ফোঁটা বাতাস বুকের ভিতরে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে অনেক ক্ষন দম বন্ধ থাকার পর একইভাবে ঝাঁকি দিয়ে হাঁ করে আবার নিশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছে।
হাতের রেডিয়াল পালস পাওয়া গেল না।
প্রেশারও মাপা গেল না।
স্টেথোস্কোপ দিয়ে বুকে হার্টের অতি ক্ষীন ধুকপুকানি শোনা গেল।
তরুন ডাক্তার কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। সালমার মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে দিলেন।
সিস্টার আলপনা এবং সুইপার গুরুচরন ওষুধ ও সরঞ্জামাদি নিয়ে হাজির হলো।
ডাক্তার বললেন -"এই অবস্থায় স্টমাক ওয়াশ দেওয়া যাবে না। "
সিস্টারকে এট্রোপিন ও এড্রেনালিন ইঞ্জেকশন দিতে বললেন।
কিছুক্ষনের মধ্যে একটা ঝাঁকি দিয়ে সালমার দেহ স্থির হয়ে গেল।
স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে বুকের কোন ধুকপুকানি শোনা গেল না।
টর্চ লাইটের আলো ফেলে দেখা গেলো সালমার চোখের মনি প্রসারিত ও স্থির হয়ে গেছে! লাইটের প্রতিফলনেও কোন সাড়া দিচ্ছে না।
এমতাবস্থায় 'কার্ডিয়াক মেসেজ' দেওয়ার জন্য ডাক্তার জ্যোতির হাত নিশপিশ করে উঠলো, কিন্তু পরক্ষনেই তিনি নিজেকে এই বলে সংবরণ করলেন যে এটাতো গ্রামের হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নয়! ।
আরো কিছুক্ষন সময় নিয়ে বার কয়েক পরীক্ষা নিরিক্ষা করে তিনি ঘোষনা করলেন যে - " সালমা মারা গেছে। "
মারা যাওয়ার পরে ডাক্তার বিষয়টি হাসপাতালের আরএমও সাহেবকে অবহিত করলেন।
আরএমও সাহেব জানালেন - " এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর বিষয়টি লিখিতভাবে থানায় জানাতে হবে। থানা থেকে পুলিশ এসে লাশটি ময়না তদন্তের জন্য সদরে চালান করবে। তার আগে লাশ ছাড়া যাবে না।"
সেই মোতাবেক রাতেই দুই কপি চিঠি লিখে ভোর বেলায় গুরুচরনকে থানায় পাঠানো হয়েছিল। গুরুচরন থানা থেকে চিঠির একখানা রিসিভ কপি নিয়ে ফিরে এসেছে।
এখনো থানা থেকে কেউ আসে নাই।
ঈদের দিনে থানাতেও স্টাফ কম থাকে, তাই তারা কখন আসতে পারবে বলা যাচ্ছে না।
সেই থেকে সালমার লাশ জরুরি বিভাগের বারান্দায় পড়ে আছে।
ঈদের দিন সকালে হাসপাতালে একধরনের উৎসব উৎসব ভাব বিরাজ করে।
ভর্তি রোগিদের সকালের নাস্তায় চিরাচরিত কলা পাঁউরুটির সাথে উন্নত মানের খাবারের অংশ হিসাবে মিষ্টি ও সেমাই দেওয়া হয়।
রোগি ও রোগির লোকেরা অনেকটাই হাসিখুশি থাকে।
কিন্তু আজকের ঈদের সকাল অন্যরকম।
মৃত সালমার মায়ের আহাজারিতে জানা গেল - "সালমার মাত্র এক বছর আগে বিয়ে হয়েছিল! সে তিন মাসের গর্ভবতী ছিল"।
জরুরি বিভাগ থেকে এক বিষাদের কালো ছায়া ক্রমেই ইনডোর আউটডোর হয়ে সমগ্র হাসপাতাল চত্তর আচ্ছন্ন করে ফেললো।
-- ডাঃ সুকুমার সুর রায়।

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়