SAHA ANTOR

Published:
2020-09-06 02:23:29 BdST

ডায়াবেটিস ও ইনসুলিন:সাবধান ছোট্ট একটা ভুল ডেকে আনতে পারে মৃত্যু


 

ডা সুরেশ তুলসান
___________________________

সাবধান ছোট্ট একটা ভুল ডেকে আনতে পারে মৃত্যু।---------
ঘটনা - ১, আমার এক রোগীনিকে ইনসুলিন প্রেসক্রিপশন করে দেওয়ার পর পরবর্তী তে পর পর দুই ভিজিটেই দেখলাম যে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। ডোজ বাড়িয়েও লাভ হচ্ছে না। অবশেষে রোগীকে চেম্বারের বাইরে বসিয়ে রেখে রোগীর ছেলেকে বললাম বাড়ী থেকে ইনসুলিন আর সিরিঞ্জ নিয়ে আসতে। দেখে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। ইনসুলিন আমার প্রেস্ক্রিপশন অনুযায়ী ঠিকই কিনেছে 40iu/ml, কিন্তু সিরিঞ্জ কিনেছে 100iu/ml, অর্থাৎ 100iu/ml সিরিঞ্জ দিয়ে 40iu/ml ইনসুলিন দিলে প্রতি 100 ইউনিটের বিপরিতে প্রকৃতপক্ষে ইনসুলিন দেয়া হবে 40 ইউনিট। অর্থাৎ আমি যে পরিমাণ প্রেসক্রাইব করলাম তার আড়াই ভাগের এক ভাগ। ডায়াবেটিসের কি দোষ কন্ট্রোল না হওরার পিছনে ?
আবার মনে করি যদি এভাবেই যদি 40iu/ml ইনসুলিন আর 100iu/ml সিরিঞ্জ দিয়ে ডোজ বাড়াতে বাড়াতে একসময় ডায়াবেটিস হয়তো নিয়ন্ত্রনে আসলো আর রোগী হঠাৎ একদিন সিরিঞ্জ 100iu/ml না কিনে 40iu/ ml কিনলো। তাহলে কি হবে ? রোগী হঠাৎ করেই যে পরিমাণ ইনসুলিন পাচ্ছিল তার আড়াই গুন বেশী ইনসুলিন পাবে। ভাবতে পারেন কেউ কি ভয়াবহ পরিস্থিতি (হাইপোগ্লাইসেমিয়া অর্থাৎ রক্তে শর্করা অস্বাভাবিক হারে কমে যাওয়া ) হবে তখন।
ঘটনা -২, আমার এক রোগী ডায়াবেটিস এর কারনে পায়ে পচন । বেশ কয়েকদিন হল ভর্তি। রোগীর এক আত্মীয়া নার্স হিসাবে পরিচয় দিলো। রোগীর সাথে ক্লিনিকে থাকে। সে নিজে রোগীকে ঔষধ খাওয়ানো আর ইনসুলিন ও অন্যান্য ইনজেকশন দেয়ার মতো কাজগুলো করে। রাত ১২.৩০ মিনিটে হঠাৎ করে ক্লিনিক থেকে ফোন আসলো স্যার রোগী খারাপ, কেমন যেন করছে। বললাম ব্লাড সুগার কর। একটু পরে রিপ্লাই আসলো, স্যার 2mmol/litre. অর্থাৎ গুরুতর হাইপোগ্লাইসেমিয়া অর্থাৎ রক্তে শর্করা অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে । যে কোন সময় রোগী মারা যেতে পারে।
বললাম তাড়াতাড়ি শিরায় ২৫% গ্লুকোজ রানিং দাও আর পানিতে গ্লুকোজ গুলে খাওয়াও। যতটা দ্রুততার সাথে সম্ভব হাসপাতালে গেলাম। যেয়ে দেখি শিরায় 25% গ্লুকোজের অনেকটাই চলে গেছে। ব্লাড সুগার করে দেখলাম 12mmol/L. স্বস্তি পেলাম যাক এ যাত্রায় রোগীটি প্রাণে বাঁচলো। রোগীর সাথে থাকা রোগীর আত্মীয়া
নার্সকে বললাম রোগীর ব্যবহৃত ইনসুলিন আর সিরিঞ্জ নিয়ে আনতে, যা সন্দেহ করেছিলাম ঠিক তাই। ইনসুলিন 100iu/ml আর সিরিঞ্জ 40iu/ml. অর্থাৎ প্রতি 40 ইউনিটের বদলে 100 ইউনিট। অর্থাৎ রোগীর ইনসুলিনের আদেশ ছিল 20+20+16 ইউনিট, অথচ রোগীকে দেয়া হচ্ছে তার আড়াই গুণ বেশী। অর্থাৎ রোগীকে দেয়া হচ্ছে 50+50+40 ইউনিট করে ইনসুলিন। রোগীর সাথের নার্সের কাছে জানতে চাইলাম আগাগোড়াই কি এই সিরিঞ্জ দিয়ে ইনসুলিন দিচ্ছেন ? বললো না। এই সিরিঞ্জটা আজকে নুতন আনা। আগেরগুলো ভোঁতা ( ধার অর্থাৎ Sharpness কমে যাওয়া ) হয়ে গিয়েছিল। ব্যাথা লাগে তাই নুতন আনা। পুরাতন সিরিঞ্জটা দেখাতে বললাম। ঠিকই 100iu/ml. নার্স কে বললাম এই যে সিরিঞ্জ টা 100iu/ml এর বদলে 40iu/ml ব্যবহার করছেন খেয়াল করেন নাই কেন ? প্রথমত কোন উত্তর নাই। পরে ধমক দেয়ায় উত্তর দিল স্যার ভুল হয়ে গেছে খেয়াল করি নাই।হাইপোগ্লাইসেমিয়ার আর দোষ কি? একটু বেখেয়ালির জন্য রোগীটা মারা যেতে পারতো।
আমাদের দেশে অনেক দরিদ্র অশিক্ষিত ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগী আছে যাদের বাড়ীতে নিজে নিজে ইনসুলিন ইনজেকশন নেয়া লাগে।
আর শিক্ষিত হলেই যে তারা সকলেই সবসময় ইনসুলিন ঠিকঠাক মতো দিতে পারবেন তার কিন্তু গ্যারান্টি নেই। কেননা এবিষয়ে তারা কিন্তু লে-ম্যান। আর কিছু কিছু বেখেয়ালি অথবা বেশী বোঝেন এমন মানুষের সংখ্যা কিন্তু আমাদের সমাজে কম না।
জেলা শহর, উপজেলা,ইউনিয়ন পর্যায়ে এখন অনেক ক্লিনিক যেগুলোতে অধিকাংশ সময়েই পাস করা নার্সদের বদলে অর্ধশিক্ষিত মেয়েদের বা নারীদের দিয়ে নার্সিং এর মত গুরুত্ত্বপুর্ন কাজ করানো হয়। রাজধানীর সকল ক্লিনিকে যে শুধুমাত্র কোয়ালিফাইড নার্স কাজ করে একথা জোর গলায় বলার উপায় নেই। আর নার্স কোয়ালিফাইড হলে যে ভুল করবে না তার বা গ্যারান্টি কি।
পল্লী চিকিৎসক বা কোয়াক ডাক্তার পৃথিবীর অনেক দেশে আছে এবং তারা কি কি ঔষধ ব্যবহার করতে পারবেন বা পারবেন না তার একটা নীতিমালা আছে। তবে আমাদের দেশে খুব কম সংখ্যক পল্লী চিকিৎসক এধরনের নীতিমালা বা বিধিনিষেধ সম্পর্কে জানেন বা মানেন । মেডিকেল এসিসট্যান্ট বা DMF ( Diploma in medical faculty) - রা সচরাচর ডাক্তার হিসাবেই প্রাকটিস করেন। আমার অর্থাৎ একজন পোস্টগ্রাজুয়েট চিকিৎসকের রোগীর ক্ষেত্রে যদি এরকম ভুলভ্রান্তি হয় তাহলে এই দুই শ্রেণীর চিকিৎসক দের রোগীর ক্ষেত্রেও এধরনের ভুলত্রুটি হতে পারে। এবং এর পরিণতি কি রকম হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
আমাদের দেশে ইনসুলিন বাজারজাত করে এমন অধিকাংশ কোম্পানির অনেক প্রকার ইনসুলিন আছে যেগুলো 100iu/ml এবং 40iu/ml উভয় রুপে বাজারে পাওয়া যায়। সিরিঞ্জও 100iu/ml ও 40iu/ml এই দুই প্রকারের পাওয়া যায়।
আমাদের দেশে অধিকাংশ ঔষধের দোকানের আউটলেটে কোয়ালিফাইড, প্রশিক্ষিত, দক্ষ, ফার্মাসিস্ট বা ঔষধের ডিসপেনসার নাই যে সব সময় সব খুচরা ক্রেতার হাতে ইনসুলিন আর সিরিঞ্জ iu/ml অনুযায়ী match করে বিক্রয় করবে। আমাদের দেশে আইন থাকলেও প্রয়োগ না থাকার কারনে OTC Drugs এবং OTC বহির্ভূত Drugs সম্পর্কে সাধারণ মানুষ তো দুরের কথা অনেক ঔষধ বিক্রেতারও সম্যক জ্ঞ্যান নাই। একারনে ইনসুলিন এর মত OTC বহির্ভূত একটি ঔষধ যার অপপ্রয়োগ একজন মানুষের মৃত্যুর কারন হতে পারে অবলীলায় রেজিস্টারড ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। এখানে বলে রাখি OTC Drugs এর অর্থ হলো Over the counter, অর্থাৎ যে ঔষধ সমুহ ডাক্তারে প্রেসক্রিপশন ব্যতিরেকে ঔষধের দোকানে গেলেই কিনতে পাওয়া যায়।
তবে পেনফিল হিসাবে যে সকল
ইনসুলিন ডিভাইস পাওয়া যায় সেগুলোর কথা আলাদা। কেননা পেনফিল ইনসুলিন ডিভাইস এর ক্ষেত্রে এধরনের ভুলভ্রান্তির সুযোগ কম।
দেশের আনাচে কানাচে এধরনের ভুল প্রায়শ হচ্ছে।
যার ফলে অনেক রোগীকে ডায়াবেটিস সময়মত নিয়ন্ত্রিত না হওয়ায় পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যয় সত্ত্বেও অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস সংক্রান্ত জটিলতায় ভুগতে হচ্ছে।
অপর দিকে ঘটনা-২ এর মত হঠাৎ করে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার কারনে অনেক রোগী হয়ত মরতে মরতে বেঁচে যাচ্ছে বা মারা যাচ্ছে।
অনেক সময় এমনও হয় সংশ্লিষ্ট কেউ হয়তো বুঝতেই পারে না কি কারনে রোগীটি মারা গেল। সচেতনতার অভাব এবং রেকর্ড কিপিং এর অনভস্থ্যতার কারনে এসবের কোন পরিসংখ্যান কোনদিন পাওয়া সম্ভব না।
আরও একটা কথা এখানে না বললে হয়তো লেখাটাই সম্পুর্ন হবে না সেটা হল ডোজ আড়াই গুন কম দেয়ার সংক্রান্ত যে ভুল সেই ক্ষেত্রে রোগীর অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস সংক্রান্ত জটিলতা সমুহ হতে অনেক সময় লাগে। এবং ভুল ধরতে পারা ও ভুল শোধরানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায়। কিন্তু ডোজ আড়াই গুন বেশী দিলে যে জটিলতা হয় তা হল মরণঘাতী হাইপোগ্লাসেমিয়া। বুঝতে একটু দেরি হলে এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা না নিলে মৃত্যু অনিবার্য।
আপাতত পেনফিল ইনসুলিন না হয় পেনফিল এর জায়গায় থাক। কিন্তু সিরিঞ্জ দিয়ে যে ইনসুলিন ইনজেকশন দেয়া হয় সেগুলোকে অবশ্যই 100IU/ml আর 40iu/ml এর গোলক ধাঁধাঁ থেকে মুক্ত করে একই ধরনের ডোজ ফর্ম এর আওতায় আনা উচিৎ। তা না হলে এরকম অঘটন গুলো ঘটতেই থাকবে।
এতে করে হয়তো ইনসুলিন এর উৎপাদন বা ব্যবসা করে এধরনের প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিবর্গ সাময়িক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। তবে রাষ্ট্র এবং জনগনের কল্যানের স্বার্থে ব্যবসায়ীদের কথা ভাবলে আমাদের চলবে না।
তবে আরও ভালো হয় পেনফিল, 100iu/ml ও 40iu/ml নির্বিশেষে এসকলের মধ্য থেকে বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে যে ডোজ ফর্ম আমাদের দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে সবচাইতে সুবিধাজনক সেই একটি মাত্র ডোজ ফর্ম আমাদের দেশের জন্য নির্বাচন করা।
ব্যবসায়ীদের যা হয় হোক।
________________
ডা সুরেশ তুলসান।
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ।

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়