রাতুল সেন

Published:
2020-07-08 20:14:29 BdST

এই সময়ের সেরা আলোচিত লেখাকরোনা হাসপাতাল থেকে


অধ্যাপক ডা. আবদুল ওয়াহাব মিনার
__________________________

অধ্যাপক ডা. আবদুল ওয়াহাব মিনার লিখেছেন সুদীর্ঘ উপন্যাসোপম লেখা। করোনা হাসপাতাল থেকে। ডাক্তার প্রতিদিনে লেখাটি ধারাবাহিক প্রকাশ হচ্ছে

 

( প্রথম পর্ব )
১৯ জুন, ২০
রোগীদের সেবাঅভিজ্ঞতা নিয়েই চলেছি এতোদিন ৷
রোগী মানস কেমন হয় - বিশেষ করে কোভিড ১৯ এ আক্রান্ত রোগীদের তা জানা ছিল না ৷ আজ নিজে এই খাঁচায় আটকা পরে বুঝতে পারছি, টের পাচ্ছি হারে হারে কতটা মানসিক পীড়ন ধাপে ধাপে লুকিয়ে আছে ৷

আমি ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি হই ১৬/৬/২০২০ তারিখ ৷
আমাকে ফেভার ক্লিনিক থেকে জানতে চায় আমি কি ভর্তি হব না বাসায় থাকবো !
ব্রিগেডিয়ার মুঈদ , ব্রিগেডিয়ার জহির, কর্নেল মারুফ সবাই ভর্তি হয়ে যেতে অনুরোধ করলো ৷

সদ্য সমাপ্ত অফিসার কেবিন ব্লককে করোনার জন্য প্রস্তুত করেছে ৷ ব্রিগেডিয়ার তৌফিককে ছোট একটা টেক্সট করে জানিয়ে রাখলাম - ভর্তি হয়েছি ৷ সে জানে বলে আমায় আশ্বস্থ করে এবং কোন অসুবিধা হলে জানাতে অনুরোধ করলো ৷ তিনি এই বৃহৎ হাসপাতালের পরিচালক ও করোনা যুদ্ধের কমান্ডার।
অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে দক্ষতার সাথে তিনি সফলভাবে এই যুদ্ধ পরিচালনা করে যাচ্ছেন।

আমার কেবিন সাত তলায় ৭০৯ ৷
সেদিন নাকি ৮৫ থেকে হঠাৎ করেই রোগী বেড়ে গেছে ১২০ এর কোঠায় ৷
কারো সাথে কারও দেখা নেই- যে যার রুমে আছে ৷
চোখে মুখে আতংকের ছাপ-৮০ভাগই অহেতুক - রোগ তথ্য সঠিকভাবে জানা না থাকার কারণে।

আমার শারীরিক অবস্থা আল্লাহর ইচ্ছায় ভালো থাকার কারণে অন্য চিন্তার বাড়তি সুযোগ পাই ৷ তার মধ্যে প্রথমেই এই হাসপাতালের সাথে আমার জড়িয়ে থাকা সেই পুরাণ দিনগুলোর কথা ৷ ৯১-৯৬ খ্রিস্টাব্দ ৷ মাঝখানে আড়াইবছর তখনকার পিজিতে ছিলাম ডিপ্লোমা ডিগ্রি ও এফসিপিএস পার্ট ওয়ানের জন্য ৷

এই মুহূর্তে আমি শুক্রবারের আজানের সাথে ঝড় ঝড় বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাচ্ছি ৷ বারান্দায় দাঁড়ালেই পূব দিকের অফিসার ওয়ার্ড,নিচে সেই আইসিইঊ, সৈনিক ও জেসিওদের চিকিৎসার বিশাল বিল্ডিং তার সামনের পার্কিং চোখে পরে ৷ একদম প্রবেশ দার পর্যন্ত চোখে পড়ে। দেখা যায় আমার এই বিল্ডিং ঘেঁষেই পুরান অফিসার ফ্যামিলি ওয়ার্ড, অদূরে শিশু ওয়ার্ড ৷ তার পাশে আরেক নতুন ভবন ৷ জানি না কোনটায় কি ! আগের স্টাফ সার্জনের রুমটার ওখানে কেন্টিন, সামনে কিছু এম্বুলেন্স দন্ডায়মান ৷

কত ছুটাছুটি করেছি এই বিশাল প্রাঙ্গনে ৷ যাদের সাথে ট্রেনিং করেছি তাদের একজন গতকাল মেজর জেনারেলের র্যাংক পরে অবসরে গেছেন ৷ ঢাকা সিএমএইচে আমি চাকরি করেছি মাত্র সাত মাস - এম এই রুমে ৷ বাকি সময়টাই প্রশিক্ষণে ছিলাম ৷
এই হাসপাতালের সিনিয়র জুনিয়র অফিসারদের সাথে, কোর্সমেটদের সাথে-- রোগীদের সাথে আছে স্মৃতির পাহাড় ৷

এখানে করোনা রোগী নিয়ে ডাক্তার, নার্স, আয়া, ওয়ার্ডবয় ও সুইপার যারা কাজ করেন তাদের কয়েকটা বিষয় খুবই চোখে পড়ার মতো:
- সবাই যথাযথ ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে ডিউটি করছে
- অন্যান্য রোগীদের বেলায় সবাই যেমন আন্তরিক ও প্রাণবন্ত থাকে আমাদের ক্ষেত্রেও তেমন ৷
- নূন্যতম কোন হেসিটেশন দেখিনি
- সকাল দুপুর রাতে একইরকম ফ্রেশ
- বার বার দরজায় টোকা দিয়ে " স্যার কিছু লাগবে, কোন অসুবিধা !"

মনে মনে বলি আমার মতো সেবা সতেরো কোটি মানুষ পায় না যে এটাই আমার একমাত্র কষ্ট, একমাত্র অসুবিধা ৷

সময়মত পাঁচবেলা খাবার চলে আসে ৷
পরীক্ষা নিরীক্ষা হচ্ছে যা প্রয়োজন ৷
সামরিক বন্ধুরা , জুনিয়ররা খোঁজ নিচ্ছে বারবার - কোন অসুবিধা হচ্ছে কি না !

দিল্লির ম্যাক্স হাসপাতাল, সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ, থাইল্যান্ডের বামুনগ্রাথ হাসপাতালের চে আমাদের এই সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের চিকিৎসা মান কোন অংশেই খারাপ না ৷ নিজেই ঐসব প্রখ্যাত হাসপাতালে আত্মীয়দের চিকিৎসা করিয়েছি, ভিজিট গিয়েছি ৷
আমাদের প্রচার নেই, নিজের কাজকে নিজেদের স্বীকৃতি দিতে যত অনীহা ৷

২.
করোনা হাসাপাতাল থেকে ( পর্ব ২)১৯ জুন, ২০

যেহেতু এই প্যান্ডেমিক সিচুয়েশনটা বাংলাদেশ তথা বিশ্বজুড়ে নতুন ৷ চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, রাষ্ট্র নায়ক, সমাজচিন্তক কাউকেই কোন ভাবার সুযোগ দেয়নি ৷ আমরা চিকিৎসকরা যে দুটো দেশের বই পড়ে চিকিৎসাবিজ্ঞান শিখি সেই যুক্তরাজ্য ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা সবচে শোচনীয় ৷

সিডরের আগেও আমরা কম বেশি প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ পেয়েছি ৷
এই মহামারী সবার মধ্যে কিছুটা জানা আর অশিকাংশই অজানা ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে ৷
পত্র পত্রিকা, রেডিও টেলিভিশনে, সামাজিক মাধ্যমে লাগামহীন কুমন্তব্য করা ও বিপরীতে সরকারের পক্ষ থেকে দফায় দফায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন, প্রথমদিকে একদম গুরুত্ব না দেয়ার কারণে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে ৷

সবচে দুঃসংবাদ হচ্ছে শিক্ষিত অশিক্ষিত সকল মানুষের মধ্যে আতংক বিরাজ করছে ৷ আমরা আমাদের ছাত্রছাত্রীদের আতঙ্ক পড়াই ৷ এটা খুব খারাপ জিনিস ৷

করোনা পজিটিভ হলেই রোগী ভাবতে শুরু করে - এই বুঝি শেষ ৷ সাইকোলজিকাল শ্বাস কষ্ট শুরু হয়ে যায় ৷ পেসেন্ট হালকা গলা ব্যাথা বা নাক বন্ধকেই বিশাল কিছু ধরে নিয়ে নিজে নিজেই খারাপ অবস্থাকে ইনভাইট করে ৷
এখানে অবশ্যিই একটা কথা মনে রাখতে হবে - তা হচ্ছে যিনি রোগী তার লাভ লসটাই বেশি ৷

তাই আমি সুপারিশ করবো আমাদের জাতীয় পর্যায়ের টেকনিক্যাল কমিটি
১) সশরীরে কভিড হাসপাতাল ভিজিট করুন, পরিচালকদের সাথে সাক্ষ্যাতে কথা বলুন তাদের মতামত পরামর্শগুলো বাস্তবতার নিরিখে প্রয়োগ করুন

২ ) কভিড রোগীদের কাছে যান , তাদের সাথে কথা বলুন ৷
তাদের আত্মীয়দের অভয় দেন - একটা সরস মানবিক হাসি বিনিময় করুন যেখানে রোগী ও পার্টি দায়িত্বশীল বাংলাদেশ দেখতে পাবে ৷ তারা আস্থা পাবে ৷ মরণেও তাদের রবে তৃপ্তি ৷

৩) সারাদিন টেলিভিশনে ইতিবাচক খবর বেশি পরিবেশন করুন ৷ সাধারণ মানুষকে মেন্টালি বুস্ট করুন , কভিড রোগীর পরিণতি বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে তুলে ধরুন ৷

৪ ) অক্সিজেনসহ প্রাথমিক চিকিৎসা উপজেলায় নিশ্চিত করুন ৷

মাননীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রীকেও হাসপাতাল ভিসিট করতে হবে ৷
দেখবেন -
মানুষের মাঝে অহেতুক ভয় থাকবে না, আস্থা ফিরে আসবে ৷

এখনই বরিশালে আমার এক বছরের ছোট ডা. এমদাদ উল্লাহ খানের মৃত্যু সংবাদ পেলাম ৷ নিজে আদর্শিক এক মহৎ প্রাণ ৷ তার বড় অন্য দুইভাইর একজন কার্ডিওলজিস্ট ,অন্যজন ডেন্টাল সার্জন ৷
অন্য আরেক ভাইও ডাক্তার- কোথেকে পাশ করেছে জানি না ৷

বাউফল পটুয়াখালীর একটা উপজেলা যেখানে বাংলাদেশের শিক্ষিতের হার সবচে বেশি ৷
আমি হাসপাতালের বেডে এই ডেথ নিউজ দিচ্ছি ৷ জানি না- আল্লাহ আমার কপালে কি রেখেছেন ৷ যখন আব্দুল্লাহ ভাইকে কল করে ঢাকা নিয়ে আসতে বললাম ততক্ষনে সব শেষ ৷ আল্লাহ এমদাদের সকল ভালো কাজকে কবুল করুন, তাকে জান্নাতবাসী করুন ৷

করোনা হাসাপাতাল থেকে ( পর্ব ৩)১৯ জুন, ২০

কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তৌফিক ভিজিটে এলো ৷
এই রুমে আমার কোন অসুবিধা আছে কি না - একদম নিউ বিল্ডিং, রোগীর চাপে ওপেন করতে হয়েছে ৷
বললাম না, আমি কমফোর্টেবল -দোআ করো ৷
- স্যার করোনা আপনাকে ভয় পায় ৷
ফুল পিপিই পড়া থাকাতে পরিচয় দিতে হল - স্যার তৌফিক ৷
আমি মন থেকে একটা দোয়া করে দিলাম ৷ তোমাদের চার হাসপাতালের চারজন ব্রিগেডিয়ার যে সার্ভিস ঢাকা শহরে দিয়েছো তা যে কোন ব্রিগেড কমান্ডারদের চে কম কিছু নয় ৷ এই করোনা যুদ্ধের তোমরা কমান্ডার ৷ মেজর জেনারেল হিসেবে তোমাদের পদোন্নতি হওয়া উচিত ৷
আমি বেঁচে থাকলে এই আওয়াজ তুলবোই ৷ দেশের প্রধান নির্বাহী ইচ্ছে করলে এমন ত্বরান্তির প্রমোশন দিতে পারেন ৷

সে ঘুরে গেল ৷
অসুবিধা হলে আমি জানাব বলে দিলাম ৷ আশা করি কোন অসুবিধা হবে না ৷

এরপর ওষুধ নিয়ে বসলাম ৷
সিস্টার দুপুরে ১৬ টা ফেভিপিরামির ২০০ মিলিগ্রাম দিয়ে খাবার নিয়ম বলে গেল ৷
যাবার সময় বললো- স্যার ওষুধটার দাম অনেক ৷
- জ্বি ৷
অন্যান্য ঔষধ খেলাম ৷

বাসা থেকে , বন্ধুরা বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন করে খোঁজ নিচ্ছে ৷
এ প্রসঙ্গে সুনিদৃষ্টভাবে বলা চলে -

১) কভিড রোগীদেরকে ফোনে বিরক্ত করবেন না
২) অযাচিত প্রসঙ্গে কথা বলবেন না - অক্সিজেন লাগতেছে ?
হ্যা, লাগতেছে আপনি কি পারবেন এক ফোটা অক্সিজেন এনে দিতে !
৪) গ্রাম থেকে টেলিফোন করেই আত্মীয়রা কেঁদে দেয় ৷ এই কান্নাজড়িত কণ্ঠে খোঁজ নেয়া একধরণের কৃষ্টি ৷
পারলে এড়িয়ে চলুন ৷ ভীষণ মন খারাপের কারণ।
৫) আপনাকে মানসিকভাবে ডুম করার মতো কলাকৌশল তাদের জানা আছে ৷ চিবিয়ে চিবিয়ে অনেক কথা বলবে , শোনা থেকে বিরত থাকুন ৷
৬) মানসিক শক্তি অটুট থাকে এমন বাক্য বিনিময় করুন ৷
আমাকে এক প্রিয় ব্রিগেডিয়ার বলেছে - করোনা মনে হয় খারাপ জায়গায় হাত দিয়েছে ৷ এটা একটা রসাত্ববোধক মাইন্ড বুস্টিং পিল ৷
৭) ফোন যদি করবেনই তবে এক আল্লাহর কাছে নিত হবার পরামর্শ দেন, স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার কথা বলুন ৷

রোগী হিসেবে আপনি কি করবেন-
১) সম্ভব হলে কাউকে সাথে রাখেন ৷
২) মোবাইলের খচ খচানি হজম করতে না পারলে অফ করে রাখেন ৷
৩) হাসপাতালের সেবাকর্মী ও বাসা থেকে যারা খোঁজ নিচ্ছে তারাই আজ আপনার কাছে বেস্ট ম্যান ৷ তাদের শ্রদ্ধা করুন, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন বারবার ৷
আপনার হাসি মুখ সবার দোয়ার দরখাস্ত বাড়িয়ে দেবে ৷
৪) শক্তি ও সাহস থাকলে ফেইসবুকিং করুন ৷ সময় কেটে যাবে ৷
৫) ইমাম ফয়সালের কণ্ঠে কোরান তেলাওয়াত শুনুন ৷
নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসনকে মেনে চলায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে ৷
৬) মৃত্যুর জন্য এক ধরণের প্রস্তুতি নিতে পারলে বেস্ট ৷
ফোন করে দাবিদাওয়া ক্ষমা করা বা যারা টাকা পাবেন কার কাছ থেকে নেবেন সুনিদৃষ্টভাবে বলে যাওয়া ৷
৭ ) জীবন আপনার অতএব বেঁচে থাকার জন্য সবরকম বৈধ প্রচেষ্টা চালাতে লজ্জা পাবেন না ৷
৮) কোন ধরণের সমস্যা হলেই সেবাকর্মীকে অবগত করুন ৷

(পর্ব ৪) ২০ জুন, ২০

পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্যে ভালবাসা, শ্রদ্ধা - স্নেহ অত্যাবশ্যাকীয়।
আর বিনে পয়সার এই জিনিসটার ঘাটতিই সমাজে বেশী।

উদারতা, সহনশীলতার চর্চা - মায়া দয়া ভালবাসার চাষ হয়নি এ সমাজে। এই মৌলিক বিষয়গুলো সমাজকে পোক্তমত টিকিয়ে রাখতে সিমেন্টিং সাবসটানস হিসেবে কাজ করে।

সকাল বেলা যে লেডি মেডিকেল অফিসার রাউন্ডে এসেছিল সিস্টার তাকে বলে ম্যাডাম - স্যার হচ্ছেন এই ফ্লোরের সবচেয়ে হাসিখুশি পেসেনট যার কোন কমপ্লেইন নেই।
- স্যার কোন অসুবিধা বোধ করছেন?
- না
- আপনার ইনভেসটিগেশন রিপোর্ট ভালো।
অক্সিজেন স্যাচুরেশন, বিপি মেপে তারা হাসিমুখে বিদায় নিল।

কিছুক্ষণ পর সিস্টার আবার এসে ফলের এই ঝুড়িটা টেবিলে রেখে বললো —আপনার জন্য কমান্ডান্ট (পরিচালক) স্যারের উপহার।

আমি ঝুড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
ভালবাসার কাছে পরাজিত হতে আমার আরাম বোধ হয়।

ধন্যবাদ - ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তৌফিক । স্যালুট কমরেড।

( পর্ব ৫ ) ২১ জুন ২০

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বন্ধু অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আজিজুল ইসলামের করোনা পজিটিভ খবর গতকাল রাতে সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশনের জুম মিটিংএ সে সবাইকে অবহিত করে ৷

আগেরদিন আমার খোঁজ নিতে গিয়ে বললো - আমার শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না ৷
টেস্ট করতে বললাম, রাজি হচ্ছে না ৷ আরেকটু কঠিনভাবে বলাতে সম্ভবত কাল সে পরীক্ষা করে ও পজিটিভ রেজাল্ট পায় ৷

এমনভাবে প্রচুর মানুষ টেস্ট না করানোর কারণে জানতে পারছে না যে সে পজিটিভ ৷ হাজার মানুষ তার মাধ্যমে ইনফেক্টেড হচ্ছে ৷
চিকিৎসকরা কেন বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ও মারা যাচ্ছে ? এ প্রশ্নের সহজ কোন উত্তর আমার জানা নেই ৷ আমি নিজে চিকিৎসক হবার কারণেই বিষয়টা নিয়ে ভীষণ উদ্বিঘ্ন ৷

তারা রোগী সান্নিধ্যে বেশি যাচ্ছেন এটাই প্রধানতম কারণ ৷ এ ছাড়াও ব্যক্তি উদাসীনতা ও অবহেলা কোন কারণ কি না ভেবে দেখার সময় এসেছে ৷

আমার কন্টাক্টে ছিলেন এমন নন মেডিকেলদের টেস্ট করতে বললে যত দ্রুত তারা রেস্পন্স করছেন মেডিকেল কলিগ তা করছেন না ৷
তারা বলছে -
" উপসর্গ নেই- কেন করবো?"
এর কি জবাব দেব ! মেডিক্যাল সাইন্স পড়াটাই বৃথা হয়ে গেলো বোধ হয় ৷

আপনাদের যার যেখানে সম্ভব ফ্রি হোক বা টাকা দিয়ে হোক টেস্ট করে ফেলেন ৷
পসিটিভ হলে তিনি ঘরে থাকবেন, চিকিৎসা নেবেন - অন্যের মধ্যে আর ভাইরাস ছড়াবেন না ৷ সমাজের আর দশজনের জন্য আপনি বিপদ বয়ে নিয়ে আসছেন না ৷

যেসকল জেলাগুলোতে প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ আছে সরকার তাদের বাধ্যতামূলকভাবে RT PCR মেশিন কিনে টেস্ট করতে বলুক ৷ ব্যাঙের ছাতার মতো মানহীন মেডিক্যাল কলেজ করে বহু টাকা স্টুডেন্টদের বাবা মার কাছ থেকে উনারা হাতিয়েছেন ৷ এই ন্যাশনাল ক্রাইসিসে তারা পয়সার বিনিময়েই এতটুকু কাজে এগিয়ে আসুক ৷

সরকার কেন সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে টেস্টের ব্যবস্থা করছে না সেটাও বুঝে আসছে না !
করোনার বাজেটের টাকা দিয়ে কি শুধু ট্রিটমেন্ট করা হবে, আইসিইউ বানানো হবে, ভেন্টিলেটর কেনা হবে ? Rt pcr machine কিনুক , ল্যাবতো আছেই
৷ প্যাথলজিস্ট আছে, কোথাও হেমাটোলজিস্ট- ভাইরোলজিস্ট আছে ৷

সচেতনতা শুধু কভিড হাসপাতালে চাকরিরত ডাক্তারকে বাসা ভাড়া না দেয়া, মানহীন মাস্ক পড়ে যত্র তত্র ঘুরে বেড়ানো ও হাত ধোয়ার মধ্যেই সীমিত আছে ৷

আরেক ধাপ এগিয়ে নিজের পরীক্ষাটা করিয়ে নিন ৷
নিজেকে শংকামুক্ত ভাবুন ,অন্যদের ঝুঁকিহীন রাখুন ৷

( পর্ব ৬ ) ২১ জুন ২০

আমি এখন অদ্ভুদ এক জিনিস নিয়ে লিখবো ৷
যে জিনিস একেকজনের ক্ষেত্রে হয়তো একরকম হয় ৷
আমার অবস্থান থেকে আমি বিষয়টাকে বিশ্লেষণ করার সুযোগ নেবো ৷

আশা ও আতংক ৷

গুণীজনের টেলিফোনে খুব ভালো লাগে , তাদের পরামর্শে আশান্বিত হই কিন্তু কেউ যখন বারবার অক্সিজেন স্যাচুরেশন জানতে চেয়ে আবার বয়সের হিসেব করতে শুরু করে তখন অক্সিজেন সেচুরেশন ঠিকঠাক থাকলেও মেন্টাল স্যাচুরেশন ধরে রাখা কঠিন ৷

আজ আমার এক স্টুডেন্ট খোঁজ নিয়ে সাজেস্ট করলো হেপারিন নিতে ৷ পরে তার কভিড বিশেষজ্ঞ বান্ধবীর সাথে কথা বলার পরই হেপারিন শুরু করলাম ৷
কারণ এমআরসিপি করা সেই মেডিক্যাল বিশেষজ্ঞ বলেছেন" আপনি ভর্তি আছেন সার্বিক বিবেচনায় আপনার জন্য আমি হেপারিন সাজেস্ট করছি, ঝুঁকি কেন নেবেন!"
যৌক্তিক কথা বটে ৷

এখানে বিভিন্ন বয়সের সারভিং ও অবসরপ্রাপ্ত অফিসার , তাদের ফ্যামিলি চিকিৎসা নিচ্ছেন ৷ যারা চিকিৎসক নন তাদের বাড়তি সুবিধা আছে ৷
তারা অনেক কিছুই বুঝেন না- অতএব চিকিৎসকদের উপর পূর্ণ মাত্রায় আস্থাবান থাকলেই ভালো ৷ অন্তত যে সমস্ত হাসপাতালে সার্ভিস বেটার, নেগলিজেন্স নেই সেখানে একজন অনুগত রোগী হয়ে থাকাটাই শ্রেয় ৷

তাই চিকিৎসক হলেও সিএমএইচে আমি চেষ্টা করি ননমেডিক্যাল রোগীদের মতো আচরণ করতে ৷ আর যাই হোক অক্সিজেন লাগছে না- এটাই বড় স্বান্তনা ৷

কোন মানুষ বাসায় থাকলে টেরই পায় না কখন সে অসুস্থ হয়ে পড়ে ৷ এখানে যখনই কেউ খারাপ অনুভব করেন তার ব্যবস্থা একটা হবেই ৷

গতকাল আমার কাশি দেখে ইনহেলার ও পুরান আট আনা সাইজের ট্যাবলেট দিয়ে গেল আমার পরিচিত ডাক্তার ৷ প্রথমটা গিলে খেলেও পরে দেখলাম অল্প পানিতে গুলিয়ে খেতে হয়, মিষ্টি একটা স্বাদও আছে ৷
আজ এড হল এন্টিপ্লাটিলেট ৷ ট্যাবলেট এসপিরিন, হেপারিন ইনজেকশন ৷

এই যে খাতির যত্ন এর বিপরীতে কাজ করছে অজানা ভয়- কখন কি না জানি হয় !
নিশ্চিত বাঁচার গ্যারান্টি চাইলেই আমি মনে করি ভয় তখন আতংকে রূপ পরিগ্রহ করে ৷ নিজের উপর আস্থা থাকে না ৷ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায় মুহূর্তেই ৷
তাই যারা এটাকে নিছক চিকিৎসা হিসেবে মেনে নিয়ে আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ আস্থা রাখতে পারবেন তারাই আল্লাহর আনুকূল্য পাবেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ৷

সাঁতার জানা লোক নৌকা ডুবিতে হাটু পরিমান পানিতে ( চর এলাকা ) যুদ্ধ করতে করতে আতংকে মারা গেছে ৷ অথচ দাঁড়িয়ে গেলেই বেঁচে যায় ৷ শাড়ি পেঁচানো গ্রাম্য মহিলা বেঁচে গেলেও আধুনিক শিক্ষিত পোস্ট গ্রাজুয়েট ডাক্তার সাহেব জীবনকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন ৷

জীবন আপনার ৷ বাঁচার জন্য আল্লাহর কাছে আকুতি মিনতিতো করবেনই সাথে থাকতে হবে - প্রানান্তকর প্রচেষ্টা ৷
এটা বিজ্ঞান , নিজে লুকিয়ে কিংবা তথ্য গোপন করে সমাজকে ধোঁকা দিতে পারবেন ৷ নিজে ঠকবেন - সমাজকে ধ্বংস করতে পারবেন ৷

বৈরী আবহাওয়ায় বেড়ি বাঁধ ভেঙে গ্রামে পানি প্রবেশের খবর শুনে মাঝ রাতে কোদাল খোন্তা বেলচা নিয়ে যেমন পুরুষ নারী শিশু নির্বিশেষে সবাই রাস্তা মেরামতে ঝাঁপিয়ে পড়ে- আপনার জীবন বাঁচাতে আপনাকে তারচেও আন্তরিক ও একনিষ্ঠ হতে হবে ৷

(চলবে)

ডা. আবদুল ওয়াহাব মিনার
শেবাচিম একাদশ।
Ex Professor of psychiatry at Monno Medical College,Manikganj
Ex Professor of psychiatry at AD-DIN WOMEN'S MEDICAL COLLEGE,DHAKA

_________________INFORMATION____________________

 

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়