ডাক্তার প্রতিদিন
Published:2020-05-10 17:30:34 BdST
"আমার ব্যক্তিগত সহকারী এসেই বলল, ও নাকি কোন করোনা রোগীর সংস্পর্শে এসেছিল!"
অধ্যাপক ডা. রেজাউল করীম
_________________________
হাসপাতালে একটু দেরী করেই যাচ্ছি আজকাল। আজ যেতেই আমার ব্যক্তিগত সহকারী এসে হাজির। ও নাকি কোন করোনা রোগীর সংস্পর্শে এসেছিল। একে একে টেকনিশিয়ান, সহকারী অধ্যাপক সবাই এসে হাজির। সবাই নাকি সেই একই রোগীর সংস্পর্শে এসেছিল।
-কি করে রোগীর সংস্পর্শে এলে? রোগী তো এই হাসপাতালেই আসে নি! সে তো রেল কোয়ার্টারে থাকে শুনেছি।
-রোগীর সংস্পর্শে একজন স্টাফ এসেছিল, তার সংস্পর্শে আসেন স-বাবু, তার সংস্পর্শে আমি এসেছিলাম?
-তার মানে তোমার তো টারশিয়ারী বা কোয়ার্টার্নারি সংস্পর্শ!
ওরা চুপ করে আছে। টেকনিশিয়ানদের বললাম মাস্ক লাগাও ঠিক করে, শারীরিক দূরত্ব রাখো। ইতিমধ্যে কয়েকজনের ভাইরাস পরীক্ষা করা হয়েছে।সবকটা সাম্পেল নেগেটিভ- ইনডেক্স কেস ছাড়া। তিনি আবার দিল্লির বাসিন্দা। দ্বিতীয়বার পরীক্ষা হবে অবশ্য। সেল্ফ আইশোলেনের কথা বলে কোন রকম এদের শান্ত করা গেল।
এত পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করলাম এটা বোঝানোর জন্য যে কিরকম আতঙ্ক সবাইকে গ্রাস করেছে। সবাই ভাবছে করোনা মানেই এবার যমদূতের নোটিশ।
একজন সিনিয়র ডাক্তারের সাথে কথা হচ্ছিল। তিনি লাইবেরিয়ায় যখন ইণ্ডিয়ান আর্মি স্কোয়াড্রনে ছিলেন তখন ওখানে এবোলা চলছে পুরোদমে। আমাকে বললেনঃ পুরো দেশটাই শেষ হয়ে গেল এবোলায়-মৃত্যুর মিছিল, তারপর অর্থনীতির ধস। অথচ, সারা বিশ্বজুড়ে কেমন হিরণ্ময় নীরবতা। কেউ একবার তাকিয়ে ও দেখে নি কিভাবে তিন তিনটা দেশ বিধ্বস্ত হয়েছে।
আজ যেমন রেল লাইনে শুয়ে থাকা লোকগুলিকে পিষে দিয়ে ট্রেন চলে গেল, আমাদের কিছুই যাই আসছে না। আমরা খাচ্ছি-দাচ্ছি ঘুমোচ্ছি। ফেসবুকের দেওয়াল ভরে কখনো খাবারের ছবি, কখনো রবীন্দ্রনাথের কোন লেখা কোট করে গাল ভরা পোষ্ট লিখছি, কখনো হয়তো অন্য কিছু লিখছি। কিন্তু, মরা মানুষগুলোর রক্তমাখা রুটির টুকরো দেখেও মনে হচ্ছে, ওরা আপন দোষে মরেছে। রেল লাইন কি শোবার জায়গা!! কি অদ্ভুত দেশ আমাদের। এত নিরাসক্তি, এত অন্যায় অসংবেদনশীল আচরণ?
করোনার আতঙ্কে নীল হয়ে যাওয়া লোকজন দেখে মাঝে মাঝে হাসি পেয়ে যায়। আমাদের বয়স একটু বেশি। অনেকের ডায়াবেটিস, হাঁপানি আর সব কত শত রোগে কাবু। তবু, জানি শতকরা তিন ভাগ কেস ফ্যাটালাটি। এক্সডেন্টে শতকরা পাঁচ ভাগ।
এর মধ্যে অনেকে আবার ধর্ম ও খুঁজছে। লাল হয়ে যাওয়া রেল ট্রাকে কাটা লাশ দেখে ধর্ম বোঝা সম্ভব নয়, রুটি গুলি দেখে ও বুঝতে পারলাম না। তবে, নির্বোধ রাজনীতি ও আদর্শহীন অমানুষ কথা শুনলে চেনা যায়।
করোনা আতঙ্কের মধ্যে সব ধরনের প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা যে সরকারের চক্ষুশূল হয়ে উঠছে তাও বুঝতে কোন অসুবিধা নেই। আইন বদলে ফেলতে চাইছে। মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বলে কিছু নেই। ফেসবুকে লেখিলেখি করলে সেখানেও প্রোফাইল রিপোর্ট করছে। একদল সংগঠিত গেস্টাপো খুব সুচতুরভাবে দেশের গণতন্ত্রের মজবুত ভিতটাকেই ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। আর আরেকদল তথাকথিত শিক্ষিত লোক নিজের চোখে আর কিছু দেখছে না, ফ্যাসিবাদী চিন্তার আসল মালিকের চোখে সবকিছু দেখছে। আর বুক ফুলিয়ে সেকথা জাহির করছে। নির্লজ্জতার কোন যে শেষ নেই এই ভণ্ডদের দেখলে সেটা বেশ বোঝা যায়।
করোনার ভয়ে ভীত নই কিন্তু এই বদলে যাওয়া দেশের জন্য ভাবিত। একটা আধুনিক, সভ্য দেশ সর্বনাশের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে। এর পর ও যদি ভয় না হয়, তাহলে ভয় কাকে বলে তা নতুন করে বুঝতে হবে। করোনার ভয় তো সে ভয়ের কাছে রীতিমত তুচ্ছ!
আপনার মতামত দিন: