Ameen Qudir

Published:
2020-03-19 18:48:04 BdST

রোগী কাহিনি"আমার জন্যে আসিনি,এসেছি আমার ছেলের জন্য: সে ভয় পায়: ভাবে কে যেন ধরতে আসছে"



লেখকের ছবি

অধ্যাপক ডা. ঝুনু শামসুন নাহার
বাংলাদেশের প্রথিতযশ
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
প্রাক্তন চেয়ারপারসন , মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা
___________________________

মাদকাসক্তি। বিশ্বব্যাপী একটা ভয়াবহ সমস্যা। এর থেকে পরিত্রান কিভাবে পাওয়া যায়? একটা রোগী ও তার অভিভাবক সম্পর্কে কিছু কথা বলা যাক। আমার চেম্বারে এক ভদ্রলোক আসলেন। বেশ ধোপদুরস্ত। চেহারাতেও আছে আভিজাত্য। তবে খুব দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হলো তাকে। তার সাথে কথপোকথনের কিছু অংশ।
ভদ্রলোকঃ আমি কিন্তু আমার জন্যে আসিনি। এসেছি আমার ছেলের জন্য। আমিঃ কি সমস্যা ছেলের? ভদ্রলোকঃ ভয় পায়। এদিক ওদিকে তাকায়। একা একা বিড় বিড় করে। আমিঃ আর কোনো সমস্যা? ভদ্রলোকঃ ভয় পায়। ভাবে কে যেন তাকে ধরতে আসছে। তার ক্ষতি করবে। আমিঃ ঘুম, খাওয়া? ভদ্রলোকঃ না। একেবারেই ঘুম নেই। খাওয়ার রুচিও কম। অনেক ওজন কমেছে। আমিঃ আপনার ছেলেকে এনেছেন? ভদ্রলোকঃ হ্যা, বাইরে আছে। আমিঃ তাহলে ডাকি? ভদ্রলোকঃ আচ্ছা।
আমি বেল দিলাম। পিয়ন ঊঁকি দিল। বললাম ওনার ছেলেকে ডেকে ভেতরে বসাতে। বিশ একুশ বছরের শীর্ণকায় একটা ছেলে ঘরে ঢুকলো। চেহারায় কেমন যেন একটা কালচে ভাব। জামা কাপড় তেমন পরিষ্কার না। ময়লাই বলা চলে। বাবার চেহারা ও আভিজাত্যের সাথে ছেলেকে মেলানোই যাচ্ছেনা। ছেলেকে দেখেই মনে প্রশ্ন জাগলো – মাদকের অপব্যাবহার নয় তো? ছেলেটির নাম জিজ্ঞেস করলাম। বলল – রাজ (আসল নাম নয়)। আমিঃ তোমার সমস্যাগুলো বল তো? রাজ অন্যমনস্ক, ভীত সন্ত্রস্হ, এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আমি আবারো জিজ্ঞেস করলামঃ তোমার সমস্যা কি? রাজঃ ঘুম হয়না। ওরা আমাকে মারবে। আমিঃ ওরা কারা? রাজঃ যাদের সাথে আমি পিজা খেতে গিয়েছিলাম। রাজ দুদিন আগে বন্ধুদের সাথে পিজা খেতে গিয়েছিল। এখন ভাবছে সেই বন্ধুরাই তাকে মারতে আসছে। আরো কিছুক্ষন কথা বলে আরো কিছু উপসর্গ জানবার পরে আমি সরাসরি রাজকে জিজ্ঞেস করলামঃ তুমি কি কোনো drug misuse করো? রাজঃ হা, ইয়াবা আর গাঁজা।
ইয়াবা-তে থাকে amphetamine, আর গাঁজায় আছে cannabis। এ দুটো রাসায়নিক দ্রব্য কিন্তু Schizophrenia-র মতো গুরুতর মানসিক রোগের উপসর্গ তৈরি করতে পারে। কি পরিমান মাদক শরীরে আছে সেটা নিরুপন করবার জন্যে urine পরীক্ষা করতে বললাম ও in-depth interview-এর জন্যে পরেরদিন আসতে বললাম।
রাজ একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে BBA পড়ছে। চারটা সেমেস্টার সে ভালো ফল করেই পাশ করেছে। পঞ্চম সেমেস্টারে রেজাল্ট বেশ খারাপ হ’লো। আর তার পরের সেমেস্টার-এ তো পরীক্ষাই দিতে পারলো না। নানান উপসর্গ দেখা দিল; ঘুম নেই, খাওয়া নেই, সর্বদা ভীত সন্ত্রস্হ।
রাজের বাবা রায়হান (আসল নাম নয়) সাহেব বিজনেস করেন। মা মাল্টিন্যাশন্যাল কম্পানিতে চাকরি করেন। রাজের বড় ভাই ইন্জিনীয়ারিং পড়ছে আমেরিকায়। ব্যাস্ত বাবা মা। একমাত্র ভাই বিদেশে। রাজ বিষন্ন ও নিসঙ্গ বোধ করে। মনের কথা share করার কেউ নেই। সচ্ছল পরিবারে অর্থের অভাব নেই। রাজকে সময় দিতে না পারায় বাবা মার হয়তো বা অপরাধ বোধ হয়েছে কখনো কখনো। তাই না চাইতেই রাজ অনেক দামী gift পায় ও যথেস্ঠ পরিমানে টাকা পয়সাও তাকে দেয়া হয়। রাজ ক্যাডেট কলেজ থেকে এস এস সি ও এইচ এস সি পাশ করেছে । কঠোর নিয়মের মধ্যে চলেছে তার স্কুল ও কলেজ জীবন। ভার্সিটিতে admission-এর পরে সে নিজেকে বেশ মুক্ত ও স্বাধীন মনে করতে লাগলো। কয়েকজন বন্ধুও জুটে গেল। রাজ খুব খুশি। তাদের সঙ্গে বেশ আমোদেই আছে। প্রায়ই তাদের খাওয়ায়। কৌতুহল ও বন্ধুদের চাপে রাজ প্রথমে সিগারেট তারপরে গাঁজা ও ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়লো। খুব শীগগীরই রাজের দৈনন্দিন জীবনে মাদকাসক্তির প্রভাব পড়তে শুরু করলো। রেজাল্ট খারাপ হ’লো। খাওয়া ও ঘুমের ওপরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ল। গুরুতর মানসিক রোগের বিভিন্ন উপসর্গও দেখা দিল। ব্যাস্ত বাবা মা রাজের মাদকাসক্তির ব্যাপারটা শুরুতে বুঝতেই পারেননি।
এবারে আমরা মাদকাসক্তির কারন গুলো খুব সংক্ষেপে আলোচনা করতে পারি। আসলে মাদকাসক্তির জন্যে নির্দিষ্ট ভাবে কোনো একটি কারনকে দায়ী করা যায়না। তবে কয়েকটি কারন ঊল্লেখ করা যেতে পারে। যেমনঃ
· মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতাঃ
আমরা তিন ভাবে ড্রাগ পেয়ে থাকি। এক - বৈধ ড্রাগ যেগুলো ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই পাওয়া যায়। যেমন নিকোটিন, এ্যালকোহল ইত্যাদি। দুই - ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনের মাধ্যমে পাওয়া যায়। যেমন বিভিন্ন প্রকারের ঘুমের ওষুধ। এগুলো অপব্যবহারের ফলে প্রায়ই আসক্তি হয়। তিন – অবৈধ বা নিষিদ্ধ ড্রাগ।
· ব্যাক্তিত্বের অসঙ্গতিঃ অনেকের vulnerable personality থাকে। তারা মাদকের ভয়াল থাবা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারেনা এবং সহজেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।
· মানসিক রোগঃ বিভিন্ন মানসিক রোগ যেমন ডিপ্রেশন, সোস্যাল ফোবিয়া, ম্যানিয়া, স্কিজোফ্রেনিয়া ইত্যাদির কারনেও মাদকের অপব্যবহার হয়ে থাকে।
· কৌতুহল, বন্ধুদের চাপ (Peer Pressure): বন্ধুদের চাপে বা কৌতুহলের বশবর্তী হয়েও অনেকে মাদকাসক্ত হয়।
· প্রতিকুল সামাজিক পরিবেশঃ সামাজিক অস্হিরতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, হতাশা, বেকারত্ব ইত্যাদিকেও মাদকাসক্তির কারন হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
· নিউরোলজিকাল মেকানিজমঃ ডাগ মস্তিস্কের reward system-এ dopamine নামক নিউরোট্রান্সমিটারের নিঃস্বরন বাড়িয়ে দেয়। এই ডপামিন নিঃস্বরনের কারনেই ব্যক্তি অত্যন্ত উৎফুল্ল বোধ করে। তবে দীর্ঘদিন মাদক ব্যবহার করলে brain reward system- এ স্হায়ী পরিবর্তন আসে এবং দৈনন্দিন জীবনের সুস্হ বিনোদন গুলো পানসে মনে হয়। মাদকসক্ত ব্যক্তি বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কখনো কখনো সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
রাজ এখন কি করবে? মাদকের ভয়ংকর থাবা থেকে নিজেকে মুক্ত করে সুস্থ জীবনে ফিরতে পারবে কি রাজ? রাজকে যে পারতেই হবে। রাজ যে সুস্হ জীবনে ফিরে আসতে চায়। এজন্য লাগবে প্রবল ইচ্ছা শক্তি বা strong motivation। প্রথমেই প্রয়োজন বিজ্ঞান সম্মত চিকিৎসা। শরীরকে মাদক মুক্ত করতে হবে, প্রয়োজন যথাযথ সাইোকলজিকাল ইন্টারভেনশন। সমস্যাটি রাজকে বুঝতে হবে গভীরে গিয়ে। আবেগপ্রবন বা ইমপালসিভ হলে চলবে না। ‘এখনি আনন্দ পেতে হবে’ – এ ধারনা থেকে নিজেকে নিবৃত (deter gratification) রাখতে হবে। সুন্দর সুস্হ আবেগীয় সম্পর্ক (healthy emotional relationship) তৈরী করতে হবে। ভর্সিটিতে ফিরে ক্লাশ ও পড়াশোনায় নিয়মিত হতে হবে। সেই সাথে চিকিৎসায়ও লেগে পড়ে থাকতে হবে। মাদকাসক্তির চিকিৎসায় adherence to treatment এবং পরিবারের সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরী।
মাদকাসক্তি প্রতিরোধে পরিবারের ভুমিকা নিয়ে কিছু বলা যেতে পারে। লক্ষ্য রাখতে হবে সন্তানরা যেন পরিবার থেকে detached হয়ে না পড়ে। ব্যাস্ততার মধ্যেও সময় বের করে নিতে হবে সন্তানকে দেবার জন্য। এবং সেটা হতে হবে quality সময়। বন্ধুর মতো কথা বলবেন তাদের সাথে। ক্লাশে কি হ’লো; বন্ধুদের সাথে কোথায় গেল; বন্ধুদের পারিবারিক background কি। প্রয়োজনে বন্ধুদের বাসায় দাওয়াত করুন। বন্ধুদের ও তাদের অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগ রখবেন, কথা বলবেন। সন্তান কোনো affair-এ জড়িয়ে পড়লো কি না, কোনো relationship break-up হ’লো কিনা, হতাশায় ভুগছে কি না, নিঃসঙ্গ বোধ করছেকি না এদিকে আপনাকে সচেতন দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রতি মাসে একবার পরিবারের সকলে মিলে বাইরে খেতে যান; বছরে একবার কাজ থেকে অবসর নিয়ে বেড়াতে যান – তা হতে পারে কোন রিসর্টে বা কক্সবাজারে বা বিদেশে। হৈ-হুল্লোড় করুন, সন্তানকে মন খুলে কথা বলার সুযোগ করে দিন।পরিবারের মূল্যবোধ সম্পর্কে বার বার বলুন।
আপনার সন্তানের সাথে যদি সুস্হু ও আন্তরিক কম্যুনিকেশন থাকে তবে আপনার সন্তান সহজেই আপনার সাথে শেয়ার করবে, নানা ধরনের গল্প করবে। আর আপনি সন্তান মাদকাসক্ত হওয়ার সাথে সাথেই বুঝতে পারবেন।
আবারো জিজ্ঞাস্যঃ রাজ কি পারবে মাদকমুক্ত হতে?
রাজ কি বলে? “মাদক অপব্যবহারের খারাপ দিক সম্পর্কে আমি বুঝতে পেরেছি। আমার পড়াশোনায় এবং পারিবারিক, সামাজিক বিভিন্ন সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সবাই আমাকে ‘drug addict’ বলে। আমার আছে প্রবল ইচ্ছাশক্তি।সেই সাথে আছে পারিবারিক সহযোগিতা।দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার আওতায় থেকে আমি মাদকমুক্ত হতে চাই। মাদককে না বলতে চাই’।

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়