Ameen Qudir
Published:2019-04-18 07:59:53 BdST
ঢাকা শহরে চিকিৎসা সেবা নেয়ার অভিজ্ঞতা জানালেন একজন কবি ও অধ্যাপক
অধ্যাপক কামরুল হাসান
_______________________
কাল রাতে আমার চিকিৎসক বন্ধু অধ্যাপক ডা. শেখ আব্দুল ফাত্তাহ্ যে পরীক্ষাগুলো করতে দিয়েছিল সেগুলো করতে ল্যাব এইড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যাই। সাধারণত আমি এই পরীক্ষাগুলো ফেলে রাখি। যেমন কাল যে চশমা বানাতে দিলাম তা আরেক চিকিৎসক বন্ধু শেখ আবুল বাশার লিখে দিয়েছিল জানুয়ারি মাসে। চোখ ও হৃদপিণ্ড দুটোই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ দেহের, কবির দুটোই লাগে। তবে চোখ মরণ ডেকে আনে না সহসা, হৃদপিণ্ড আনে। তাই জানুয়ারির চশমা এপ্রিলে বানাতে দিলেও হৃদপিণ্ড নিয়ে ছিনিমিনি চলবে না। আর বুঝতেই পারছেন, শেখরা আমার বন্ধু, তাদের বলে বলীয়ান আমি!
বেগম রোকেয়া সরণি থেমে গেছে দশ নম্বর গোল চক্করে এসে। এরপর মিরপুরের প্রধান সরণি দশ নম্বর থেকে শুরু হয়ে এগার হয়ে শেষ হয়েছে বারো নম্বর সেকশনে। এর দুপাশে কত যে দালান, কত যে শপিংমল। হাসপাতাল আর ক্লিনিক আছে বেশ কয়েকটি। সাধারণত আমি প্যাথলজিক্যাল টেস্ট করাতে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যাই, আমার বাসা থেকে সেটাই কাছে। কিন্তু আজ মন চাইল কিছুটা দূরের ল্যাব এইডে যেতে। ক্লিনিক ব্যবসার দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর মিরপুর শাখা দুটির প্রধান পার্থক্য পপুলার পুরণো আর পুরণো বলেই তাতে ভীড় বেশি। মানুষ দেখতে দেখতে হাঁপিয়ে ওঠা আমার চোখ ভীড়হীন ক্লিনিকটি পছন্দ করল, আর নতুনের আনকোরা ভাবটি ভালো লাগে।
খালি পেটে রক্তে শর্করার পরিমাণ পরীক্ষাটি করতে ল্যাব এইডে পৌঁছাই ভোর সাড়ে ছয়টায়, দেখি ঝাঁপ বন্ধ। সেবা নিতে আমার অতিউৎসাহকে বাহবা দিতে কেউ ছিল না সেখানে। দেখা হলো কবি মিল্টন বিশ্বাসের সাথে। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সাতটার আগে ল্যাব এইডের একজন এসে জানাল সাতটায় খুলবে। সাত গড়িয়ে সাতটা বিশ, সাটার উঠল। তাও কী ওঠে! সাড়ে সাতটা নাগাদ প্রবেশাধিকারের সুযোগ পেলাম। ক্লিনিক ও তার লোকদের ধাতস্থ হতে ঠিক আটটা। আমিই প্রথম সেবাগ্রহণকারী, তা অতিভোরে আসা অতিউৎসাহী রোগীদের একটু করুণার চোখেই দেখে ক্লিনিকের লোকেরা। ভাবে, আহারে, এরা বুঝি অনিদ্রার রোগী!
রক্ত দিয়ে বাড়ি ফিরি সকালের নাস্তা খেতে। দুঘণ্টা পরে আবার যেতে হবে। লুবনা আমাকে কাজ ধরিয়ে দেয়। কাজটি হলো মেটলাইফ, যা বহুকাল ধরে আলিকো নামে আলীবাবা প্রতিশ্রুতির রত্নভাণ্ডার সাজিয়ে রেখেছিল, যেখানে ভেতরে ঢুকে মন্ত্র ভুলে যাওয়া চোরের মতো প্রিমিয়াম দিতে ভুলে গিয়ে আপনি আমও হারাবেন, ছালাও হারাবেন। আমরা অবশ্য আম হারালেও ছালা পেয়েছি। একটি পরিপক্ক হওয়া পলিসির সেটলমেন্ট করতে দশ নম্বর গোল চক্করে যাই। পাঁচ বছরে যত টাকা দিয়েছিলাম মেটলাইফ ঠিক তত টাকাই দিবে। টাইম ভ্যালু অফ মানির সূত্র মেনে আপনি জানেন আপনি হেরেছেন, ইন্সুরেন্স কোম্পানি জিতেছে। ওরা সবসময়ই জেতে।
সেখানে নিচে শপিংমল বা দোকানপাঠ উপরে অফিস গায়ে গায়ে লাগানো দালানগুলোর প্রতিটিতে বিবিধ কোম্পানির এত অফিস যে আপনি ভুলে যাবেন কোন দালানটিতে ইন্সুরেন্স কোম্পানিটির অফিস। ভালো করে সাইনবোর্ড দেখতে আমি সড়কের ওপাড়ে যাই। বেগম রোকেয়া সরণির প্রশস্ত মধ্যভাগ জুড়ে মেট্রো রেলের দজ্ঞযজ্ঞ। কয়েকটি দরকারি কাগজ ফটোকপি করতে গিয়ে ওপাশে আমায় যেতেই হতো। অযুত সাইনের ভেতর মেট লাইফকে দেখে বলি, 'ইউরেকা।'
এপাশে এসে দেখি সে ভবনে প্রবেশের পথ ও সিঁড়ি বন্ধ। তাকে বিশ্বস্তভাবে পাহাড়া দিচ্ছে এক বৃদ্ধ প্রহরী। ওপাশের এক ফুল বিক্রেতা উদ্ধার দেয়। বলে পাশের দালানের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলে পাশের ভবনে যাবার করিডোর পাওয়া যাবে। করিডোর খুঁজতে গিয়ে এসে পড়ি এক শেয়ার কেনাবেচার ব্রোকার হাউজে। গত কয়েকদিনের অব্যাহত দরপতনে মলিন শেয়ার বাজারের মতোই ব্রোকার হাউজটি মলিন, ক্রেতাহীন। মুক্তির করিডোর বন্ধ করা এক অবরুদ্ধতা। নিচে নেমে ব্যর্থতার রিপোর্ট দিতে অপর দুই অলস বসে থাকা যুবক বলে মেটলাইফের অফিস চারতলায়। চারতলা অবধি যাই, অফিসটি দেখতে পাই না। দ্বিতীয়বার ব্যর্থ হয়ে নিচে নামতেই এক প্রহরী বলে, 'আসুন আমার সঙ্গে।' তিনি অন্ধকার এক সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় এসে আমাকে সেই সিঁড়িটি দেখিয়ে দেন যার চতুর্থ তলায় মেটলাইফ। প্রথমবার আড়াল করা সাইনবোর্ডটি আমার চোখে পড়েনি। তৃতীয়বারের চেষ্টায় অফিসটি পেয়ে স্বস্তি। আমাকে প্রথমেই যে প্রশ্ন করা হলো, 'আপনি কি টাকা জমা দেবেন?' আমি বলি, 'না, আমি টাকা তুলবো, এক টাকাও দেব না।' শুনে বদনখানি বিরস হয়ে ওঠে। সে বলে, তিন দালান পরে মেট লাইফের যে অফিস সেখানে টাকা দেওয়া হয়। এটি এজেন্সি অফিস, এখানে শুধু টাকা নেওয়া হয়।
তিন দালান পাড়ি দিচ্ছি পাশের এক ভদ্রলোক শুধান, 'মেট লাইফ খুঁজছেন?' মাথা নাড়াই আর ভাবি, 'ঘরের কথা পরে জানলো কী করে?' তখন বুঝিনি আমার হাতে থাকা ফাইল দেখেই তিনি বুঝেছেন। ইনিও মেট লাইফের একজন এজেন্ট, আর কে না জানে এদের চোখ তীক্ষ্ণ হয়। অত যে দালান আর সিঁড়ির রহস্যময় ঘোরাঘুরি, ব্যর্থ আর সফল হওয়ার চক্কর, তা শেষাবধি ব্যর্থ হলো একটি কাগজের অভাবে, যদিও বাকি সব কাগজই ছিল। আমরা আবার খুব আমলাতান্ত্রিক। একটি কাগজ, যদি তা তালিকায় থাকে, ছাড়া কাজ হবে না।
কী আর করা? তখন নিচে নেমে এসে রিকশা ধরে ল্যাব এইড ডায়াগনস্টিকের দিকে। এখানে ভূগোল খুব বদলে গেছে। এখন চোখে পড়ে মেট্রোরেলের সারি সারি উঁচু ও শক্তিশালী স্তম্ভ, তাদের উপর বসানো সিমেন্টের স্প্যান। দেখে আশা জাগে প্রাণে এ নগর একদিন ট্রাফিক জ্যাম মুক্ত হবে। আমরা আকাশপথে না হলেও ভূমির অনেকটা উপর দিয়ে স্বচ্ছন্দে চলাচল করতে পারবো।
____________________________
অধ্যাপক কামরুল হাসান। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি। ভ্রমণ লেখক।
আপনার মতামত দিন: