Ameen Qudir

Published:
2016-12-17 04:57:58 BdST

হাসপাতালের কান্নাভালো লোকটারে নিয়ে এলাম, এখন যেতে হবে লাশ নিয়ে


 

   

 

       


শামীমুল হক
__________________________
হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ।
হাসপাতালের সিসিও রুমের প্রথম সিটটিতেই সাদা কাফনে জড়ানো নিথর দেহ। পাশে দাঁড়িয়ে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো দু’ফোঁটা পানি। হৃদয় ভেদ করে আসছে কান্না। স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠলো, মাত্র চারদিন আগে একটি ফোন। হ্যালো বলতেই, শামীম ভাই আমি জিতু। মেজো ভাই হাসপাতালে। তিনটি রিং বসানো হয়েছে। রিং বসাতে অনেক কষ্ট হয়েছে। প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লেগেছে। মেজো ভাই খুব করে আপনার কথা বলছে। আর চার দিন যেতে না যেতেই সোমবার বিকালে অফিসে এলো মৃত্যু সংবাদ। আমাদের আমির হোসেন ভাই আর নেই। শুরু হয় হৃদয়ে রক্তক্ষরণ। হাসপাতালে ছুটে যাই। সঙ্গে মানবজমিনের সহযোগী সম্পাদক সাজেদুল হক, চিফ রিপোর্টার লুৎফর রহমান।

 

সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ছয় তলা থেকে ভেসে আসছে কান্না। কাঁদছেন ভাবি। কাঁদছেন কন্যা। কি দিয়ে তাদের সান্তনা দেবো। এগিয়ে গেলাম ভাবির কাছে। দেখেই বললেন, শামীম ভাই ভালো লোকটারে নিয়ে এলাম, এখন যেতে হবে লাশ নিয়ে। শামীম ভাই, আমার সব শেষ হয়ে গেল। কিছু বলতে পারিনি। শুধু বলেছি, ভাবি মনকে শক্ত করেন। আপনি ভেঙে পড়লে সন্তানদের কি হবে? মনে পড়ে গেল সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যার সময় ছুটে গিয়েছিলাম হবিগঞ্জ। রিপোর্ট করতে। রাতে গিয়ে হোটেলে উঠি। ফজরের নামাজের পর হোটেল রুমের দরজায় নক করছেন কেউ। খুলে দেখি আমির হোসেন ভাই। জড়িয়ে ধরলেন। বললেন হোটেলে কেন ওঠলেন। আমার বাসায় এত জায়গা। বললাম আমির ভাই রিপোর্ট করতে এসেছি। হোটেলে থেকেই করব। বাসায় যাবো না। নাছোড়বান্দা। ঠিক আছে, খাওয়া-দাওয়া সব আমার বাসায়। এটা কিন্তু না করা যাবে না। জোর করে নিয়ে গেলেন বাসায়। ভাবি নাস্তা নিয়ে বসা। আর দেরি নয়, নাস্তা সেরেই ছুটলাম বৈদ্যেরবাজার। যেখানে গ্রেনেড ছুড়ে হত্যা করা হয় শাহ এএমএস কিবরিয়াকে।

শুধু বয়সে নয়, সাংবাদিকতায় আমার চেয়ে প্রবীণ তিনি। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে তখন দেখেছি তাকে দৌড়াতে একদম তরুণের মতো। অনুসন্ধানী রিপোর্ট করতে গিয়েছি কত জায়গায়। সব সময় আমির ভাই ছিলেন আমার পাশে। কাজ শেষে উনার বাসায় বসে লেখা। তারপর প্রেস ক্লাবে গিয়ে ঢাকা অফিসে ফ্যাক্স করা। ১০ দিন থেকেছি হবিগঞ্জে। একই রুটিন। রাত দশটার পর হোটেলে যাওয়া। সকালে আমির ভাইয়ের বাসা। নাস্তা শেষে রিপোর্টের উদ্দেশে দুজনের বের হওয়া। কাজ শেষে আবার আমির ভাইয়ের বাসায়। দুপুরের খাবার। তারপর লেখা। সবশেষে প্রেস ক্লাব থেকে ফ্যাক্স করা। এই ক’দিন তিনি কোর্টে যাননি। অনেক মামলা তার হাতে। আমি একাধিকবার বলেছি, কোর্টের কাজ থাকলে শেষ করে আমার সঙ্গে যোগ দিন। বলতেন, এমন দিন বছরে কয়বার আসে? আগে রিপোর্ট করতে হবে। তারপর কোর্ট। দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি একসঙ্গে। এমন বিনয়ী, ভদ্র মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। রিপোর্ট পাঠিয়ে কোনো দিন অনুরোধ করেননি রিপোর্ট ছাপাতে। রিপোর্ট না ছাপলেও কোনো অভিযোগ ছিল না মহান এ মানুষটির মুখে। ফোন দিলে কোনো দিন আগে সালাম দিতে পারিনি। হ্যালো বলতেই, সালাম দিয়ে বলতেন -শামীম ভাই। কেমন আছেন। বাসার সবাই ভালো তো? বলতাম, আপনার শরীরের খবর কি। হ্যাঁ ভালো। মাত্র দু’সপ্তাহ আগে রাত ১২টার পর ফোন করলাম। আমির ভাই শুয়ে পড়েছেন? জানালেন, এইমাত্র শুয়েছি। অসুবিধা নেই। বলুন। বললাম না, তেমন কিছু না। কেন জানি আপনার কথা মনে পড়ছে। তাই ফোন করলাম। রিপোর্ট তো ছাপা হচ্ছেই। কিছু এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট দরকার। তিনি বললেন, আপনি এসাইনমেন্ট দেবেন। সব রিপোর্ট পেয়ে যাবেন।

শরীরের কথা জিজ্ঞেস করতেই বললেন, বুকের বামপাশে একটু একটু ব্যথা করে। শিগগিরই ঢাকা যাবো। ডাক্তার দেখাবো। নিথর দেহের পাশে দাঁড়িয়ে মনে পড়ছে সেসব কথা। কত স্মৃতি যে তাড়া করছে আজ। কোন্টা বলবো? মেয়ের বিয়ের তারিখ হবে, যাওয়ার আবদার। বিয়ের দাওয়াত। ছেলেকে কুমিল্লা ইস্পাহানি স্কুলে ভর্তি করিয়েছে সে সুসংবাদ। কখনো কখনো গ্রামের বাড়ি চুনারুঘাটে কি সমস্যা হয়েছে তার কথা। সবই বলতেন অকপটে। বুঝতে পারলাম আমির ভাই আমাকে তার পরিবারের একজন করে নিয়েছেন। তার ভালোবাসা আমার কাছে অমর হয়ে থাকবে। সত্যিই আমির হোসেন ভাই, আপনি জয় করেছেন হবিগঞ্জের মানুষের হৃদয়। আপনি জয় করেছেন সাংবাদিকদের হৃদয়। আপনি জয় করেছেন অগণিত পাঠকের হৃদয়। আপনি জয় করেছেন সকল স্বজনের হৃদয়। আপনি জয় করেছেন হবিগঞ্জ বারের সকল সদস্যের হৃদয়। আপনার হাতে প্রথম প্রতিষ্ঠা হয় হবিগঞ্জ প্রেস ক্লাব। আর এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এর ভিত গড়ে উঠেছে আপনার হাতেই। তাইতো আপনার চলে যাওয়ার সংবাদে হবিগঞ্জ প্রেস ক্লাবের বর্তমান সভাপতি ফজলুর রহমান ফোন করে হাউমাউ করে কেঁদেছেন। বলেছেন, শামীম ভাই, একজন অভিভাবক হারালাম। এত তাড়াতাড়ি আপনার চলে যাওয়া খুবই কষ্টের।
________________________________

 

শামীমুল হক ,কথাসাহিত্যিক। নির্বাহী সম্পাদক , দৈনিক মানবজমিন ।

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়