Ameen Qudir

Published:
2016-12-11 18:26:35 BdST

অপচিকিৎসা সম্প্রসারণ কেন্দ্র : দায় ডাক্তারের নয়, পাবলিকেরও !



ডা. উজ্জ্বল হোসেন
___________________________


চিকিৎসা সেবা পাওয়া টা আমাদের অন্যতম অধিকার। কিন্তু কেন এ অধিকার খর্ব হচ্ছে আমাদের? দায় কার?


ইদানিং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের উৎপাতে রোগীরা নাজেহাল।যার দায় পড়ছে ডাক্তারদের ঘাড়ে। ডায়াগনস্টিক মানেই টাকা কামানোর ধান্দা।
আপনি সামান্য ব্যাথা, চুলকানি, জ্বর নিয়ে গেলেই দেখবেন টেস্ট দেওয়া হয়েছে ১০০০-১৫০০/=
এটা ভাবছেন ডাক্তার ইচ্ছা করে দিয়েছেন?
নাহ্। ডায়াগনস্টিক সেন্টার তার লাভ পুষিয়ে নেবার জন্য ডাক্তারকে চাপ দিচ্ছেন অন্তরাল থেকে।এবং ওরা চায় না ডাক্তার পরীক্ষা ছাড়া আপনাকে ডায়াগনোসিস করুক।

 

গ্রামের যে মানুষটি আপনার বন্ধু সেজে আপনাকে ভাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে বলে সাথে করে শহরে নিয়ে আসে তার সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন? যে মানুষটি আপনাকে বলে অমুক ক্লিনিকে অপারেশন করান, তার সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?
কখনো কি প্রশ্ন করেছেন তাকে, আচ্ছা ভাই আপনার সময় নষ্ট করে আমার সাথে কেন যান? আপনার লাভ কি?


আচ্ছা এই প্রশ্ন করার আগে আপনি নিজেকে প্রশ্ন করেন তো, যে মানুষটা আপনাকে কোন কারনে এক টাকা দিয়েও কখনো সাহায্য করেনি সে কেন এখন সাহায্য করতে চায়?
জানি, এখন উত্তর টা পাবেন না। কারন হিসাব টা মিলছে না।
হ্যা,ওরাই দালাল। পারসেন্টেজ খায়। একটা অপারেশন করাতে পারলে পকেটে ওঠে ১০০০-১৫০০/=
আর পরীক্ষা নিরীক্ষায় পকেটে যায় ৪০%।


একটা বাস্তব গল্প বলি।
"একটা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আল্ট্রাসাউন্ড করতাম_____________
কল আসলো।আমাকে একটা আল্ট্রাসাউন্ড করতে হবে। আল্ট্রাসাউন্ড রুমে ঢুকলাম।দেখলাম এক মহিলাকে আগেই রেডি করে রাখা হয়েছে। মহিলার হিস্ট্রি নেয়ার আগে তাকে স্বতঃস্ফুর্ত করার জন্য বাড়ির খোজঁখবর নিচ্ছিলাম।তার কথায় জানতে পারলাম তিনি একজন বিধবা। তার সাত বছরের একটা ছেলে আছে। অর্থ কষ্টে ছেলের লেখাপড়া করাতে পারছে না। অন্যের বাড়ীতে কাজ করে খায়। কিন্তু আজ দশদিন হলো হাতে ঘা হয়েছে। কাজে যেতে পারছে না।তাকে সাহায্য করার মত কেউ নেই।


বাড়ির পাশের এক কোয়াক ডাক্তার তাকে এখানে এনেছে।আনার সময় বলেছে তোমার ক্যান্সার হতে পারে।তাই সম্পূর্ণ বডিপরীক্ষা করতে হবে।
তার শেষ সম্বল ছিল একটা ছাগল।সেটাই কম দামে বিক্রি করে ৩ হাজার টাকা নিয়ে এসেছে।সে আরও বলতে লাগলো আমার ভাই (কোয়াক ডাক্তার) না থাকলে আমার কি যে হতো।
অতঃপর তাঁর হিস্ট্রি নিয়ে যা জানলাম শুধুমাত্র হাতে ঘা হয়েছে।( পানিতে বেশি কাজ করতে করতে)।
তারপর জিজ্ঞেস করলাম, আপনাকে আল্ট্রাসনোগ্রাম কে দিয়েছে? উত্তরে বুঝলাম কোয়াক ডাক্তারই এটা দিয়েছ।

এবার চেম্বারে ঢুকে রোগীটাকে দেখবো।এমন সময় রোগীর পাশের বাড়ীর ভাই (কোয়াক ডাক্তার)ও ঢুকলেন।এবার তার হাতে আরও যা যা পরীক্ষার কাগজ দেখলাম তাতে আকাশ থেকে পরার মত।
রোগী বিশ্বাসের চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপাদে বিপদে এই ভাই যদি না থাকতো তাহলে আমার যে কি হতো!! আল্লাহই জানে।


আরও বলতে লাগলেন
জানেন ডাক্তার সাহেব, এই ভাই ছাগল বিক্রি করতে সাহায্য করেছে।আবার এখানে নিয়েও এসেছে।আল্লাহ ভাই টার মঙ্গল করুক।
আমি মনে মনে ভাবলাম লোকটা আপনার কত বড় শত্রু তা যদি বুঝতে পারতেন তাহলে এখনি তার মুখে লাথি মারতেন।

 

যা হোক আমি রোগী দেখা শেষে একান্তে রোগীকে তার বিশ্বাসী ভাইয়ের (কোয়াক ডাক্তারের) মুখোশ খুলে দিয়েছিলাম। বাড়ী গিয়ে কি হয়েছে সেটা জানি না। তবে মানুষ চেনাতে গিয়ে মূল্যস্বরুপ ৩ দিন পর আমার চাকুরী হারাতে হয়েছিল।কারণ কোয়াকের সাথে ডায়াগনস্টিক মালিকদের সরাসরি যোগাযোগ থাকে। "

এবার কিছু শিক্ষিত মানুষের কথা বলি। আমাদের দেশের শিক্ষিত ব্যক্তিরা সামান্য জ্বর, ঠান্ডা হলেও ছূটে যান বিশেষগ্গ ডাক্তারের কাছে।এ যেন মশা মারতে কামানের ব্যবহার। পছন্দ করেন নাম করা ডায়াগনস্টিক সেন্টার যেমন- পপুলার,স্কয়ার,ল্যাব এইড এসব যায়গায় যেতে।
সর্দি,জ্বর নিয়ে যাওয়া শিক্ষিত মানুষরা পছন্দ করেন পরীক্ষা করাতে। পরীক্ষা ছাড়া চিকিৎসা তাদের মনপূত হয় না।ডাক্তারগণও বুঝেই যান সামান্য জ্বর নিয়ে যারা এসব যায়গায় আসে তাদের টাকার থলে টা ভর্তিই থাকে।রোগীর মন জয় করতে দিয়ে দেন টেস্ট। খরচ হয় হাজার হাজার টাকা আর লাভ হয় ডায়াগনস্টিকের।
রোগী খুশি,ডাক্তার খুশি, আর ডায়াগনস্টিক তো মহা খুশি। এভাবেই গড়ে উঠছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রচলন।


শুধুঅহেতুক এসব জ্বর,সর্দিতে আক্রান্ত রোগীর চাপে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ প্রতিদিন মাত্রাধিক রোগী দেখতে বাধ্য হন। রোগীদের সময় দেন ৫ মিনিট।
আবার এসব শিক্ষিত মানুষই প্রশ্ন তোলেন ৫ মিনিটেই দুইটা ঔষধ লিখে হাজার টাকা ফি নিচ্ছেন ডাক্তার সাহেব। কি হাস্যকর তাই না? অন্যদিকে ৫ মিনিট শুনে জটিল রোগ ডায়াগনোসিস সম্ভব হচ্ছে না। তাই যাদের আসলেই সময়ের প্রয়োজন তাদেরকে ডাক্তর তার প্রয়োজনীয় সময়টুকু দিতে পারছেন না।


সত্যিকার অর্থে কোন ডাক্তারই আপনাকে গলা কাটার সাহস পাবেনা যদি না গলাটা এগিয়ে দেন।
তবে ডাক্তারদের মধ্যেও পারসেন্টেজ খাওয়া নতুন কিছু নয়। এর সংখ্যা খুব নগন্য। আপনি দু একজনকে দিয়ে বাকি সবাইকে বিচার করতে পারেন না। যদি তাই না হতো তবে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক পদক চিকিৎসায় পাওয়া সম্ভব ছিল না।
আমি আপনি কেউ এধরণের অপ- চিকিৎসা পদ্ধতি চাই না।
সচেতন হোন।
নিজ দায়িত্বে সঠিক জায়গায় যান, দেখবেন ঠকবেন না।
আর আপনার অধিকারও ক্ষুন্ন হবে না।
________________________________

 

লেখক ডা. উজ্জ্বল হোসেন । মেডিকেল অফিসার।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ।

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়