Ameen Qudir

Published:
2016-11-16 17:46:43 BdST

স্মৃতিময় সিএমসি – জিললুর রহমান এবং আমরা


 

 


ডা. তৈমুর চৌধুরী
___________________________

কবি জিললুর রহমানের সাথে ঠিক কবে প্রথম পরিচয় হয়েছিল, অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারছি না। মেডিকেল কলেজে তিনি আমার দুই বৎসর সিনিয়র, কিন্তু সম্পর্কটা বরাবরই বন্ধুত্বের। সখ্যতা নিশ্চয় একদিনে হয়নি, কিন্তু শুরুর ঘটনা গুলো কিছুতেই মনে পড়ছে না। আমার মেডিকেল কলেজের পুরো সময়টুকুর স্মৃতি জুড়ে রয়েছেন তিনি। এর শুরু নেই, এর শেষ নেই।

জিললুর রহমান সম্পর্কে স্মৃতিচারন মুলক কিছু লিখতে গিয়ে প্রথমেই যে দৃশ্যটা চোখে ভেসে উঠল, সেটা হলো – মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। আমি আর জিললুর রহমান রিকশায় বসে বৃষ্টিতে ভিজছি। খালি গা, সার্ট কোমরে বাধা, রিকশা চলছে ও আর নিজাম রোড পেরিয়ে খুলসীর দিকে। রাস্তার পাশে কয়েকটি ছেলে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। জিললুর রহমান তখন সদ্য পাশ করে ইউ এস টিসিতে লেকচারার হিসাবে যোগ দিয়েছেন। ছেলেগুলো নিশ্চয় তার স্টুডেন্ট হবে। স্যারকে এই রুপে দেখে নিজেদের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না।

জিললুর রহমান কখনোই অন্যদের দেখিয়ে দেয়া চেনা পথে হাটেননি। ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ কে তোয়াক্কা করেননি। নিজের বিবেক আর হৃদয় দিয়ে পরিচালিত হয়েছেন। অন্যকে খুশী করার জন্য নিজের সঙ্গে আপোষ করেননি। পছন্দ, অপছন্দ বোধ বরাবরই তীব্র। যেখানে মন থেকে সায় পাননি, নীরবে সেখান থেকে সরে গেছেন।

মেডিকেল কলেজের ছাত্র অবস্থাতেই জিললুর রহমান কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। তার কবি পরিচয় শুধু মেডিকেলে কলেজেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তখন চট্টগ্রামে কবিতার উত্তরাধুনিকতা নিয়ে আন্দোলন চলছে, তার একজন অগ্রগন্য সৈনিক তিনি। এটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার। কবিতা লিখছেন, কবিতার ভাংচুর নিয়ে কাজ করছেন, কবি বন্ধুদের সাথে নিয়মিত বসছেন, কবিরা যেসব বাউন্ডুলেপনা করে- তাও চলছে, আমরা যারা অকবি বন্ধু তাদের সাথেও প্রায় প্রতিদিন দীর্ঘ আড্ডা। তারপরেও মেডিকেলের মত কঠিন পড়াশোনা ঠিকঠাকমত করে গেছেন। যেন দশভুজা দুর্গা! প্রায় সময় দেখা যায়, যে ছেলেটা ছাত্র রাজনীতি করছে বা কবিতা লিখছে বা শিল্পসংস্কৃতি নিয়ে মাতামাতি করছে, তার পড়াশোনাটা বাদ পড়ে যায়। জিললুর রহমান ব্যাতিক্রম। তার এরকম কিছু অন্যনতাই আমাকে টেনেছে তার দিকে।

আমাদের সময়ে মেডিকেল কলেজে বন্ধুদের গ্রুপ তৈরি হতো একই বর্ষের সহপাঠীদের মধ্যে অথবা একই ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে। সেরকম বন্ধুতো আমাদের ছিলই, তার বাইরেও কি করে যেন একটা গ্রুপ তৈরি হয়ে গেল। সে গ্রুপে আমাদের ছয় বৎসরের সিনিয়র খুররম ভাই ছিলেন (তখন তিনি ডাক্তার), দুই বৎসর সিনিয়র জিললুর রহমান, তবে সংখ্যায় বেশি ছিল জুনিয়ররা – শিমুল, ইকবাল, ঝেন্টু, জিয়া, বাচিং, মিন্টু, মাসুদ, রাজু, শঙ্কর, বিদ্যুৎ, লিটন, পলাশ এবং অনিয়মিত আরো বেশ কয়েকজন। মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসের স্মৃতিতো অগুনিত। এ লেখায় হয়তো অতি ঘনিষ্ঠ অনেকের নামই উচ্চারিত হবে না। যে গুলোর সাথে জিললুর রহমান এবং ঝালবিতানের আড্ডার সম্পৃক্ততা রয়েছে, শুধু তার কিছু এখানে বলার চেষ্টা করব। প্রায় রোজ বিকেলে আমাদের আড্ডা বসত ঝালবিতানের সামনে। ধুম সেই আড্ডা চলত সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত পর্যন্ত। বিকেল হলেই সবার মধ্যে ছটফটানি শুরু হয়ে যেত আড্ডার জন্য। যে যেখানেই থাকুক, ঠিক সময়মত সবাই জুটে যেত আড্ডায়। সেই আড্ডার মধ্যমনি ছিলেন জিললুর রহমান। এমনিতে চুপচাপ, আগ বাড়িয়ে কারো সাথে কথা বলেন না, কিন্তু প্রিয়জনদের সাথে আড্ডায় তিনি অন্য মানুষ। তার হা হা হাসির শব্দ শোনা যেত ঝালবিতানের সামনের রাস্তা পেরিয়ে ক্যাম্পাসের প্রিন্সিপ্যাল লবি থেকেও। আজ আড্ডায় জিললুর রহমান আছেন কি নাই, আমরা বুঝতে পারতাম দূর থেকেই।

যদিও জিললুর রহমানের বন্ধুর সংখ্যা কম নয়, কিন্তু মানুষের সাথে মেশার ব্যাপারে তিনি বরাবরই ভীষন খুঁতখুঁতে। মনের মত সংগী না হলে তিনি নিজেকে মেলে ধরেন না। আর যখন তিনি নিজেকে মেলে ধরেন, সেই জিললুর রহমানে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নাই। অগাধ পড়াশোনা, জীবন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা, আবার একই সংগে ভীষণ রোমান্টিক! তার একটা কবিতা ছিল এরকম – “দুঃখ পেলে তোমাকেও দুঃখী করে নেব/ সংগী হলে সাথে সাথেই সঙ্গ দিয়ে দেব/ তৃষ্ণা পেলে চুষতে যাব চোখের লোনা জল/ মধ্যরাতে করো না আর ষোলকলার ছল”। তার এরকম কিছু কবিতা আমরা আমাদের বান্ধবীদের চিরকুটে লিখে দিয়ে মুগ্ধ করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু তাকে কখনো কাউকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করতে দেখিনি। এমনি নির্মোহ!

এক এক দিন আড্ডা শেষে আমি চলে যেতাম জিললুর রহমানের সাথে তার বাসায়। কখনো কখনো অন্যরাও থাকতো। জিললুর রহমানের বাবা রাশভারী মানুষ, কলেজের অধ্যাপক। ছোট বোন সিলেট মেডিকেলে পড়ত, আমাদেরই ইয়ারমেট। ছোট ভাই বুয়েটে। বাবা মা আর তিনি –এই তিনজনই তখন সে বাসার বাসিন্দা। খালাম্মার মতন অসাধারন রুপসী আমি আমার জীবনে কম দেখেছি। ভীষণ মায়া করতেন আমাদের! হোস্টেলে থাকি, কি খাই না খাই, উনার ছেলে মেয়েও হোস্টেলে থাকছে, সেই ভাবনা থেকেই হয়তো খুব যত্ন করে খাওয়াতেন। হুটহাট করে অনেকে একসঙ্গে হাজির হতাম, কিন্তু টেবিলে খাবারের বাহার দেখে মনে হত খালাম্মা ঠিক জানতেন আমরা আসবো। একজন কবি বা লেখকের বাসা যেমনটা হওয়ার কথা, জিললুর রহমানের বাসা ছিল তাই। ঘর ভর্তি বই। শুধু কবিতার নয়, নানা স্বাদের বই। বিশেষ যত্ন করে মলাট লাগানো সব বইয়ে। এই একটা ব্যাপারে কৃপন ছিলেন জিললুর রহমান। একেবারেই বই ধার দিতে চাইতেন না। বাসায় বসে যত খুশী পড় আপত্তি নাই, সাথে করে নিয়ে যাওয়া যাবে না। হয়তো অনেক প্রিয় বই হারিয়েই তার এই অভ্যাস হয়েছে। আমার সেই বাসায় যাবার অন্যতম আকর্ষন ছিল তার এই বইয়ের ভান্ডার।

সহপাঠীরা জিললুর রহমানকে কবি বলেই ডাকত। কলেজ ক্যাম্পাসে সাংস্কৃতিক বিষয়ক যে কোন কিছুতেই পরামর্শের জন্য খোজ পড়ত তার। আমাদের ছাত্র ইউনিয়নের একটা সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল, নাম তরঙ্গ। তরঙ্গের সংগে ওতোপ্রতো ভাবে জড়িত ছিলেন জিললুর রহমান। নবীনবরন, বসন্তবরন, বর্ষাবরন বা বিভিন্ন বিশেষ বিশেষ দিবসে তরঙ্গের নানা আয়োজন থাকত। সেসব অনেক অনুষ্ঠানের নেপথ্যের কারিগর ছিলেন জিললুর রহমান। কিন্তু কোন পদ পদবী তিনি কখনোই গ্রহন করতেন না। মুলত ছাত্র ইউনিয়নের ছেলে মেয়েরাই ছিল তরঙ্গের সংগঠক। সীমিত সুযোগে, অল্প খরচে তারা এমন এমন সব অনুষ্ঠান করত, সবার তাক লেগে যেত। জিললুর রহমান কখনো প্রকাশ্য হতেন না। এরকম একজন কবি, কিন্তু ক্যাম্পাসের কোন অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করেছেন বলেও মনে পড়ছে না। নিজের কবিতার ব্যাপারে ছিলেন ভীষণ লাজুক। তার কবিতা যখন পত্রিকায় প্রকাশিত হতো, নিজ থেকে কাউকে জানাতেন না। আমরা পড়ে যখন প্রশংসা করতাম, বিব্রত হয়ে পড়তেন, লাজুক হেসে প্রসঙ্গ এড়াতে চাইতেন।

তরঙ্গের সক্রিয় কর্মীদের মধ্যে একমাত্র জিললুর রহমানই ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন না। ভীষণরকম রাজনীতি সচেতন, সমাজ সচেতন, কিন্তু প্রথাগত কোন রাজনৈনিক দল বা ছাত্র সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততা ছিল না তার। প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে উঠেছিলেন জাসদ ছাত্রলীগের সিটে। অচিরেই মোহভঙ্গ ঘটে। নিজ বুদ্ধিতে জাসদকে ঝেডে ফেলে নগর রাজনীতিতে কিছুদিন হেঁটেছেন ওয়ার্কার্স পার্টি, ছাত্র ঐক্য সহ নানান ঘাটে। সবারই নানা ত্রুটি চোখে পড়ে তার। সবশেষে তাই কবিতার ভেতরেই আকাঙ্ক্ষার মুক্তি খুঁজে নেন। তবে সক্রিয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত না থাকলেও জিললুর রহমানের রাজনীতির তাত্ত্বিক জ্ঞান ছিল অনেক ছাত্রনেতার চেয়েও ভাল। এই নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপ হতো তার সাথে। একটা মজার ব্যাপার হলো, এসব নিয়ে তর্কে তিনি মাঝে মাঝে তার বিশ্বাসের বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে কথা বলতেন। বুঝতে চাইতেন অন্যের ভিতরে কি আছে, কার ভাবনার গভীরতা কতদুর! যে কারনে অনেকে ভুলও বুঝত তাকে।

সক্রিয় ছাত্র রাজনীতি না করলেও নব্বইয়ের এরশাদের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে কারফিউ ভেংগে আমাদের সাথে মিছিল করেছেন জিললুর রহমান। তখন সময়টা ছিল অন্যরকম। সারাদেশ উত্তাল। ১৪৪ ধারা চলছে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমরা ক্যাম্পাস ছাড়িনি। পুলিশ এরেষ্ট করতে পারে সেই ভয়ে রাতে হোস্টেলে থাকিনা। একেকদিন একেক জায়গায়। কখনো গোয়াসিবাগানে চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারীদের বস্তিতে, কখনো কারো বাসায়। তখন জিললুর রহমানের বাসাও ছিল আমাদের একটা আশ্রয়স্থল। নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময়টা আমাদের অনেকের জীবনেরই শ্রেষ্ঠ সময়। ১৪৪ ধারা, কারফিউ ভেঙ্গে মিছিল করছি। পুলিশের সংগে ইট পাথর সম্বল করে লড়াই করছি। কখনো কখনো মিছিলে গুলি চলছে। ঐ সময়টায় একবারও মনে হয়নি, এই গুলি আমারও বুকে লাগতে পারে, মরে যেতে পারি। তবে রাতের বেলা গোয়াছিবাগানের বস্তিতে শুয়ে যখন সারাদিনের কথা ভাবতাম, তখন ভয় করঁত। একবার মিছিলে গুলি হলো, আমি একেবারে মিছিলের সামনে, শ্লোগানের লীড দিচ্ছি। মিছিল ছত্রাখান। কারফিউর কারনে বাইরে আটকা পড়ে ফেলাম। সারারাত ফিরতে পারিনি।(সে এক বিরাট গল্প, এখানে তার বিস্তারিত বর্ননা প্রাসঙ্গিক হবে না)। ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে গেল আমি মারা গেছি, পুলিশ লাশ গুম করে ফেলেছে। সবাই সারারাত জেগে বসে আছে। আমার স্মৃতিচারন হচ্ছে। কেউ কেউ থানা আক্রমনের প্লান করছে। সকালে আমাকে ফিরতে দেখে সবাই ভুত দেখার মত চমকে উঠল। আমার ফেরাতে এই বন্ধুদের চোখে যে আনন্দাশ্রু দেখেছি, তা কোনদিন ভুলার নয়। সেই উত্তাল সময়ে, কলেজ বন্ধ, আমরা যারা আন্দোলনের সাথে সক্রিয় ভাবে জড়িত শুধু তারা কাম্পাসে। বড় সড় মিছিল না নিয়ে ক্যাম্পাসের বাইরে যাই না। পুলিশও ক্যাম্পাসে ঢুকে না। এরমধ্যে এক বেকুব পুলিশ রুগী নিয়ে ইমার্জেন্সিতে এল। তাও আবার গায়ে ইউনিফর্ম। পুলিশ তখন আমাদের জানের শত্রু। আমাদের অনেকেই তখন পুলিশের অকথ্য নির্যাতনের শিকার। হৈহৈ করে ঘেরাও করে ফেলা হলো সেই পুলিশকে। শুরু হলো মার, হাসপাতালে আসা রুগীর এটেন্ডেন্টরাও যোগ দিল তাতে। আমরা বন্ধুরা মোজাম্মেল চত্বরের শিকে বসে আছি। ছুটে গেলাম, এভাবে তো একটা মানুষকে মরতে দেয়া যায় না, সে যেই হোক। চীৎকার করে সবাইকে থামতে বলছি, পুলিশটাকে জড়িয়ে ধরে মার থেকে বাচানোর চেষ্টা করছি। কিছু কিল ঘুষি আমাদের পিঠেও পড়ছে। ক্ষুব্ধ জনতাকে থামাতে ঘোষণা দেয়া হলো, এই পুলিশ এখন একশ বার কানে ধরে উঠবস করবে। জান বাচাতে সেই পুলিশ তার চেয়েও বেশি কিছু করতে রাজি। মোজাম্মেল চত্বরে দাঁড়িয়ে পুলিশ কান ধরে উঠবস করছে, আর তাকে ঘিরে জনগণের বিজয় উল্লাস।

মানবিক মুল্যবোধের দিক থেকে আমরা বন্ধুরা সবাই সমমনা ছিলাম। পাপপুণ্য বোধের একটা সরল হিসাব ছিল আমাদের। কারো ক্ষতি করা, কারো সাথে প্রতারণা করা বা তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করাটাই হলো পাপ, সেটা যে প্রেক্ষিতেই হোক। অন্যায়ের বিরুদ্ধে না দাড়ানোটাও পাপ। ছাত্র ইউনিয়নের শিক্ষা আমাদের এই বোধকে আরো পরিশীলিত করেছিল। বিশেষ কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ততা না থাকলেও, বিশ্বাসে জিললুর রহমান ছিলেন সাম্যবাদী। একানব্বইয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতনের সময়টাতে আমরা সবাই এলোমেলো। সত্তুর বছরের সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের হিসাব মিলানোর চেষ্টা করি, মেলেনা। ব্যার্থ প্রেমিকের মত মুখ করে ঘুড়ে বেড়াই। নানা তত্ত্বকথা আলোচনা করে পরস্পরের কাছ থেকে সান্ত্বনা খোজার চেষ্টা করি। সেই বেদনা ছুয়ে গেছে জিললুর রহমানকেও। তিনিও স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় নীল। সেটা ফুটে উঠে তার ‘গাছের কাহিনী’ কবিতায় - “সত্তুর বয়সী গাছও কি অদ্ভুত থুবড়ে পড়ে মুখ!/ বাঁশবনে বানরের বেহুদা তান্ডবে/ নিবাসীরা ভয়ক্লান্ত কিংবা মুদ্রাদোষে নেহাৎ সন্ত্রস্ত/ (প্রতিবাসী আমরাও ব্যতিক্রম নই)/ বাঁশবন তছনছ,/ লুপ্ত প্রায় প্রাকৃত গৌরব/ ম্লানতায় নির্বাপিত দেদার ঔজ্জ্বল্য আজ/ কোথাও পালটায় রঙ কানুনের/ সামাজিক ভিত নড়ে বেহিসাবী বাতাসে হাওয়ায়/ সত্তুর বয়সী গাছও কি অদ্ভুত থুবড়ে পড়ে যায়!”

নব্বইয়ের গন অভ্যুত্থানের পর দেশকে নিয়ে যা ভেবেছিলাম, তার হিসাব মেলেনি। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও স্বপ্নভঙ্গ হলো। আমরা ক্রমশ রাজনীতি থেকে দূরে সরে যেতে থাকলাম।

জিললুর রহমান তখন ইন্টার্নী করছেন। তার নাইট ডিউটির রাত গুলোতে আমরা হানা দেই রাত দুপুরে। গভীর রাতে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেডাই। মোজাম্মেল চত্বরের লোহার রেলিং-এ বসে, গল্প করি, চা খাই। মেডিকেলের সব ছাত্রদেরই অতি প্রিয় এই মোজাম্মেল চত্বর, প্রায় সারাক্ষনই কেউ না কেউ সেই লোহার রেলিং-এ বসে আড্ডা মারছে। আমাদের একজন প্রফেসর মোহাম্মদ হোসেন স্যার এটা নিয়ে মজা করতেন। ক্লাশের বোর্ডে নিতম্বের ছবি আঁকতেন, সেই নিতম্বে আড়াআড়ি কয়েকটা দাগ দিয়ে বলতেন,- “তোদের প্যান্ট খুললে সবার পাছায় এরকম দাগ পাওয়া যাবে! তোরা ক্যামনে ঘণ্টার পর ঘন্টা ঐ শিকে বসে থাকিস”। সত্যিই তাই! কেন যে সবার এত প্রিয় ছিল ঐ কঠিন আসন! দিনের মধ্যে একবার ওখানে না বসলে শান্তি নাই। এখনও যখন কোন কারনে চিটাগাং যাই, একবার ক্যাম্পাসে যাবোই, মোজাম্মেল চত্বরের লোহার রেলিং-এ বসে এককাপ চা খাবই।

ঐ সময়টাতে আক্ষরিক অর্থেই যখন যা মনে চেয়েছে, করেছি। কোন কোন পুর্নিমার রাতে জিললুর রহমান সহ আমরা কর্নফুলী নদীতে চলে যেতাম। একটা নৌকা ভাড়া করে সারারাত ভেসে বেড়াতাম। উথাল পাথাল জ্যোৎস্নায় নদীর বুকে গল্প, আড্ডা, গান। হেমেল তখনই চট্টগ্রাম রেডিওর তালিকাভুক্ত গায়ক। বলার আগেই গুন গুনিয়ে উঠত। ঝেন্টু এবং জিয়ার গানের গলাও ভাল। তার সংগে যোগ হত আমাদের বেসুরো গলা। তাতে আকৃষ্ট হয়ে একবার নৌ পুলিশ এসে হাজির। গম্ভীর গলায় জানতে চাইল, - “কি হচ্ছে এখানে? এটাকি নাট্যশালা নাকি!” আমাদের হো হো হাসির শব্দে তারা বিরক্ত হয়ে চলে গেল। অন্য কেউ হলে নিশ্চয় পুলিশ ঝামেলা করত। মেডিকেল কলেজের ছাত্র হিসাবে কিছুটা বাড়তি গুরত্ব বা সুবিধা সেইসময়ে আমরা সবখানেই পেতাম।

ঝালবিতানের সেই আড্ডা থেকে কত কিছুই না জন্ম নিয়েছে। কবি, ব্যর্থ কবি, হবু কবি, ফটোগ্রাফার, ফটোগ্রাফারের শিষ্য, গায়ক, বিচিত্র সব মেধার সমন্বিত রুপ ছিল এই আড্ডা। সেই আড্ডাতেই মুখে মুখে তৈরি হয়ে গেল নতুন এক সমাস! একজন একটা বলে তো, অন্যজন আরেকটা যোগ করে। এভাবে কিছুদিনেই দাঁড়িয়ে গেল আদি রসাত্মক এই নতুন সমাস প্রকরণ। তারমধ্যে সবচেয়ে ভদ্রটা, হলো – নৈহাটি, নুনুর উপর হাটাহাটি, পুলসেরাত সমাস! কিছুদিন আগে ঈদ সংখ্যায় চটগ্রামের লেখক হরিশংকর জলদাশের একটা উপন্যাস পড়ছিলাম। সেখানে আমাদের সেই সমাস গুলো পেলাম। ভীষণ মজা লাগল। চট্টগ্রামের কবি সাহিত্যিকদের কেউ কেউ আমাদের সেই আড্ডায় নানা সময়ে এসেছিলেন। হরিশংকর জলদাশ কখনো এসেছিলেন কিনা মনে পড়েনা। হয়তো আমাদের তৈরি সেই সমাস মুখে মুখে অনেকদুর ছড়িয়ে, এই লেখক পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। সেই আড্ডাতে বসেই গান লিখে তাতে সুর বসিয়েছিল হেমেল। দারুন জনপ্রিয় হয়েছিল সেই গান। কবি জিললুর রহমান বেশ কিছু কবিতার খসড়া করেছিলেন এই আড্ডাতে বসেই। এই আড্ডাতে লেখা, আমাকে উৎসর্গ করা তার একটা কবিতার নাম ছিল ‘পা বাড়াও দীপ্তি’। ইকবালকে নিয়ে ‘শ্রাবনের থুথু’ নামে যে কবিতাটি লিখেছিলেন তার কয়েকটা লাইন এরকম – “কোন গোলাপী কনের বিয়ে কে করেছে দান/ বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় নাহি বান/ শ্রাবন বুকে আগুন পোষে হয়না ধারাপাত/ সারাটা মাস পার হলো সে ছিটিয়ে কেবল থুতু/ শ্রাবনের এই বুকে সত্যি আগুন কিছু আছে?” সত্যিকার উত্তরাধুনিক কবিতা। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অন্য মন্ত্র’-এ এই কবিতা দুটো অন্তর্ভুক্ত ছিল।

পাগলামির নিত্য নতুন আইডিয়া আসত ইকবালের মাথা থেকে। একবার তার ইচ্ছে হলো দলবেঁধে রাতে ফুটপাথে ঘুমাবে। রাতজুড়ে রাজপথে যেসব নাটক হয়, ফুটপাথে শুয়ে সেটা দেখবে। কখনো সিনেমার ভুত চাপত মাথায়। তখন ভিসিয়ারের যুগ। একেকবার একেক পরিচালকের সব মুভি। সত্যজিৎ রায়, মৃনাল সেন, ঋত্বিক ঘটক – যখন যার মুভি দেখা হত, সপ্তাহ জুড়ে শুধু তারই মুভি। ক্লাশ, পড়াশোনা সব তখন গোল্লায়! এই মুভি উৎসব হতো কখনো জিললুর রহমানের বাসায়, কখনো ইকবালের বাসায়। ইকবালের বাসা ছিল আমাদের আরেকটা আড্ডার স্থান। কোন কোন দিন ঝালবিতানের আড্ডা থেকে হোস্টেলে না ফিরে কয়েকজন মিলে চলে যেতাম ইকবালের বাসায়। ইকবাল তখনই নামকরা ফটোগ্রাফার, দেশী-বিদেশী বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছে। ইন্টারমেডিয়েট পাশ করার পর ইকবালের বাবা তাকে হজ্ব করিয়ে এনে পৃথিবীর পাঠশালায় ভর্তি করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, -“তোর যা ইচ্ছা তাই কর, আমার চাওয়া একটাই, পড়াশোনাটা ঠিকঠাক মত করবি”। সত্যি সত্যি ইকবাল যা খুশী তাই করত, তবে পড়াশোনাটাও ঠিকমত করত। এখন সে একটা বিশ্বমানের হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। আমাদের মধ্যে তখন একমাত্র গাড়ীওয়ালা হচ্ছে জামাল, নিজেই ড্রাইভ করত। কখনো কখনো রাতে তার গাড়ীতে করে আমরা বের হয়ে পড়তাম। একবার ঝুম বৃষ্টি, তার মধ্যে হাইওয়েতে ছুটছে গাড়ী। ভারী বর্ষনে হেড লাইট জ্বালিয়েও কয়েক হাত দূরে কিছু দেখা যায় না। জামাল রাস্তার পাশে গাড়ী দাড় করিয়ে ফেলল। দ্রব্য গুনে আমরা তখন অন্যজগতে। গাড়ী থেকে দৌড়ে নেমে পড়লাম বৃস্টিতে। জামাল কিছুক্ষন চেষ্টা করল সবাইকে গাড়ীতে উঠাতে। ব্যর্থ হয়ে একসময় নিজেও নেমে পড়ল বৃষ্টিতে। এমনও হয়েছে সারারাত গাড়ী চালিয়ে পৌঁছে গেছি কক্সবাজার। ভোরে কক্সবাজার থেকে নাস্তা করে আবারও চট্টগ্রামের পথে।

একবার জিললুর রহমান, ইকবাল, মাসুদ, আমরা কয়েকজন চলে গেলাম বিজু দেখতে রাঙ্গামাটি। যেখানেই যাই সেখানেই বন্ধু। ইকবালের এক ফটোগ্রাফার বন্ধুর আতিথীয়তায় কাটল কয়েকটা দিন। পার্বত্য অঞ্চলের এই সহজ মানুষ গুলোর সাথে মিশে মুগ্ধতা আর কাটে না। বাঙ্গালীদের প্রতি তাদের ক্ষোভের যুক্তিগ্রাহ্য কারন রয়েছে। জিললুর রহমান তার সংবেদনশীলতা দিয়ে তাদের অন্তরের ক্ষতকে বুঝতে চাইলেন। তারাও আমাদের স্থান দিল হৃদয়ে। চৈত্র সংক্রান্তির বিশেষ ব্যঞ্জন পাচন, সংগে চোয়ানি। কি অপুর্ব তার স্বাদ, কি অভাবনীয় সেই অনুভুতি! আমরাও তাদের অংশ হয়ে গেলাম সেই বর্ষবরনের আনন্দ উৎসবে। বাচিং এর বিয়ে। দলবেঁধে বান্দরবান। বান্দরবানের বুনো সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ, বিস্মিত। পুর্নিমা রাতে পাহাড়ী নদীতে নৌকা নিয়ে উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরে বেড়ানো। নদীর দুপাশের পাহাড়ের গায়ে ঘন অরন্য, তার মধ্যে জোস্নার আলো আধারির খেলা। মনে হয় যেন কোন স্বপ্ন দৃশ্য! নতুন ধরনের যে কোন খাবারেই আমাদের সবার বিপুল আগ্রহ। বাচিং এক রাতে খাওয়ালো শামুক। আদার ঝাল দিয়ে রান্না করা। শামুকের মুখটা খুলে ঠোটে চেপে ধরে সুড়ৎ করে টান দিতে হয়। মুখের মধ্যে চলে আসে শামুকের শাস। আদার ঝালে জ্বলে যাচ্ছে ঠোট, তারপরও খেয়ে যাচ্ছি একটার পর একটা। এত সুস্বাদু খাবার জীবনে কম খেয়েছি। এখনো মুখে লেগে আছে সেই স্বাদ! এভাবে প্রায়ই দল বেধে চলে যেতাম কাছে-দূরে কোথাও। এমনও হয়েছে শুধু বাসের টিকেটের টাকাটা পকেটে নিয়ে চলে গেছি দূরে কোথাও, ওখানে যে বন্ধুর কাছে যাচ্ছি, বাকী দায়িত্ব তার।

আমাদের বন্ধুদের মধ্যে একটা আত্মীয়তার সম্পর্কও হয়ে গেল একসময়। জিললুর রহমানের সাথে বিয়ে হলো ঝেন্টুর বোন রুমীর। এর পিছনেও রয়েছে একটা গল্প। সে গল্পে যাচ্ছি না, প্রাসঙ্গিক অন্য একটা গল্প বলি। ঝেন্টুর ভালবাসর জন সহপাঠী হলি। ধর্মীয় কারনে কোন পরিবারই বিয়েতে রাজি না। সম্পর্ক ভেঙ্গে যায় যায় এমন অবস্থা। ভগ্নীপতি হিসাবে জিললুর রহমান এগিয়ে এলেন। ঝেন্টুর বাবা তখন বেচে নেই। ঝেন্টুর মাকে কিছুতেই রাজি করানো যাচ্ছে না। এরমধ্যে ঝেন্টুর বড় ভাই চায়না পড়তে যেয়ে একজন চাইনীজ মেয়েকে বিয়ে করেছেন, তাই অবস্থা আরো জটিল। খুররম ভাইকে সাথে নিয়ে ঝেন্টুর মাকে বুঝাতে গেলেন জিললুর রহমান। খালাম্মা খুব ধর্মপরায়ন। তার দুর্বলতার জায়গাটাকেই কাজে লাগানোর কৌশল নিলেন। খালাম্মাকে বুঝালেন, বড় ভাইয়ের বিয়ের কারনে একটা মেয়ে মুসলমান হয়েছে। ঝেন্টুর সাথে যদি হলির বিয়ে হয়, তবে আরেকটি মেয়ে মুসলমান হবে। কত সোয়াব হবে খালাম্মার! খালাম্মা ফুসে উঠে চট্টগ্রামের ভাষায় বললেন, “ আঁই কি সাইদী সাব না? প্যারেডর কোনাত বোলাই বোলাই মাইনষেরে মুসলমান বানাইউম!” (আমি কি সাঈদী নাকি, প্যারেড স্কয়ারে ডেকে ডেকে মানুষদের মুসলমান বানাবো?) সেই সময়ে চট্টগ্রামের প্যারেড স্কয়ারে কিছুদিন পর পর দেলোয়ার হোসেন সাইদীর ওয়াজ হতো। এক ধরনের মেলোড্রামা হতো সেখানে। দেখা যেত সাঈদীর ওয়াজ শেষে অন্য ধর্মের কিছু লোক তার কাছে এসে মুসলমান হচ্ছে। তার ওয়াজ কত কার্যকরী সেটা বুঝানোর জন্য এই সাজানো নাটক। সেই সুত্র ধরেই খালাম্মার এই ঐতিহাসিক বক্তব্য। এরপর বহু দিন ধরে খালাম্মার এই কথাটি আমাদের মুখে মুখে ঘুরেছে। একটা সময়ে অবশ্য ঝেন্টু আর হলির পরিণয় হয়। ঝেন্টু এখন বিদেশে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। দীর্ঘদিন বিলেতে ছিল, কিছুদিন হলো অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে।

চট্টগ্রামের কবিকুলের সাথে আমাদের পরিচয় ঘটে জিললুর রহমমানের মাধ্যমে। কবি ইজাজ ইউসুফী, চট্টগ্রামে উত্তরাধুনিক কবিতার পথিকৃৎ। জিললুর রহমানের কিছুটা সিনিয়র, দারুন বন্ধুত্ব তাদের। সেই সুত্র ধরে আমাদের সাথেও সখ্যতা। তারা তখন কবি শামসুর রহমান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এদের উপর কাজ করছেন। তাদের ব্যতিক্রমধর্মী সব সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। বিশাল সেসব সাক্ষাৎকার বই আকারে বের হচ্ছে। এত বড় মাপের কবি, সাহিত্যিকদের সাক্ষাৎকার নিতে কঠিন প্রস্তুতি নিতে হয়। বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন করতে হয়। কখনো খুশী করে, কখনো রাগিয়ে দিয়ে তাদের পেট থেকে কথা বের করতে হয়। সেসব নিয়ে কবিদের আড্ডা সরগরম।

এই কবিকুলের আড্ডা বসত চকবাজারের সবুজ হোটেলে। ঝালবিতানের আড্ডা শেষে জিললুর রহমান চলে যেতেন সবুজের আড্ডায়। সেই আড্ডা একটু দেরীতে শুরু হত, চলত মধ্যরাত পর্যন্ত। আমরাও মাঝে মাঝে সেই আড্ডায় যোগ দিতাম। একপাশের দুটো টেবিল জোড়া দিয়ে চলত সেই আড্ডা। সবুজ হোটেলের মালিক নিজে কবিতা বুঝতেন না, কিন্তু এদেরকে ভীষণ প্রশ্রয় দিতেন। কবিরা যেমন হয়, ভীষন আত্মাভিমানী, জেদী। কাব্য আলোচনায় মাঝে মাঝে ঝগড়া লেগে যেত। টেবিল চাপড়ে নিজের মতামত জাহির করার চেষ্টা। রাগ করে কারো টেবিল ছেড়ে উঠে যাওয়া। এই হৈচৈ-এ নিশ্চয় ব্যবসার ক্ষতি হতো, কিন্তু হোটেল মালিক কখনো বিরক্ত হতেন না। এই দীর্ঘ সময়ে তারা হয়ত কয়েক কাপ চা খেতেন, কিন্তু কখনো টেবিল ছাড়তে বলতেন না। বরং তার আচরনে একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব ছিল, এই কবিরা তার এখানেই বসে। পুলক, শারদ তাদের সংগেও পরিচয় এই আড্ডায়। কাব্য ছাড়াও এই আড্ডায় আলোচনা হত, রাজনীতি, পরনিন্দা, কখনো বা আদি রসাত্মক ভয়াবহ সব কৌতুক! তবে একটা সুর সব বিষয়েই মিশে থাকত, অসাধারন রসবোধ! সবুজ হোটেলের এই আড্ডার যুগপুর্তিতে বড় উৎসব হয়, কবিতা প্রদর্শনী হয়েছিল সবুজ হোটেলে। সেখানে সবুজের কবিদের কবিতার সাথে ঠাই পেয়েছিল কবিতার মতো সুন্দর ইকবালের তোলা ছবিও।

মেডিকেল কলেজের প্রায় পুরো সময়টুকুতে জিললুর রহমানের সাথে একসঙ্গে পথ হেটেছি। তারুন্যের হাজারো অনুভুতির অংশীদার এই কবি বন্ধু। কলেজ ক্যাম্পাসের প্রতিটি ইঞ্চি এখনো চোখ বুজলে দেখতে পাই। মোজাম্মেল চত্বর, প্রিন্সিপ্যাল লবি, অডিটোরিয়ামের সামনে খোলা চত্বর, ক্যান্টিন, ডক্টরস ক্যাফেটেরিয়া – কত ঘটনা, কত স্মৃতি! কলেজ ক্যাম্পাস থেকে পাহাড়ের কোল ঘেঁসে রাস্তা চলে গেছে মেইন হোস্টেলে। একপাশে খোলা মাঠ, অন্যপাশে পাহাড়, মাঝের নিরিবিলি রাস্তা ধরে কত রাতদুপুরে ফিরেছি হোস্টেলে। জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় সময় কেটেছে এখানে। বুকের একটা অংশ এখনো খালি পড়ে আছে সেই প্রিয় প্রাঙ্গণের জন্য, প্রতি মুহুর্তের নর্মসঙ্গী সেইসব বন্ধুদের জন্য।

মান্নাদের সেই বিখ্যাত গান ‘কফি হাউজের সেই আড্ডা’র মতো আমাদের ঝালবিতানের আড্ডাও একসময় ভেঙ্গে যায়। বন্ধুরা ছড়িয়ে পরে দেশে বিদেশে। তবে যে যেখানেই আছে যার যার ঘরানায় সে প্রতিষ্ঠিত। কবি জিললুর রহমান ভাগ্যবান। অনেক পথ পেরিয়ে আবারো তিনি থিতু হয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। সেই বাউন্ডুলে কবি এখন অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান। যদিও অন্য ভুমিকায়, তবুওতো সেই প্রিয় প্রাঙ্গণ! বুক ভরে শ্বাস নিলে এখনো নিশ্চয় তিনি সুবাস পান সেই আনন্দময় সময়ের।

##আমার অতি প্রিয় একজন মানুষ কবি জিললুর রহমান। তার পঞ্চাশতম জন্মবার্ষিকীতে আমার এই নৈবেদ্য!)
__________________________________

 

 


লেখক ডা. তৈমুর চৌধুরী
বিরল প্রতিভাবান লেখক।

পেশায় চিকিৎসক ।
Works at Hamdard Laboratories (waqf) Bangladesh
Studied at Chittagong Medical College

আপনার মতামত দিন:


ক্যাম্পাস এর জনপ্রিয়