Dr.Liakat Ali
Published:2023-05-06 14:16:51 BdST
মেডিকেলে ভর্তির জন্য বৈধ শিক্ষার্থী সলিলের ৪৪ বছরের লড়াই, ২ কোটি টাকা দিতে সিএমসি অধ্যক্ষকে নির্দেশ সর্বোচ্চ আদালতের
ডেস্ক
_________
অবশেষে বেলা শেষে জয়লাভ করলেন তিনি। কিন্তু জীবন থেকে হারিয়ে গেছে সোনালী যৌবন, হারিয়ে গেছে ৪৪ বসন্ত।
জয় পেয়ে চোখের জলে ভাসছেন তিনি। কি অপরাধ তার। কেন তাকে ৪ দশকের বেশি সময় ধরে এমন হয়রানি করা হল। কেন তাকে মেডিকেল কলেজে পড়তে দেওয়া হলো না। কেন ডাক্তার হতে পারলেন না তিনি। রাষ্ট্র এতো নিষ্ঠুর কেন। লড়াই করে ক্লান্ত অবসন্ন তিনি। কিন্তু দমে যান নি। সত্যর মৃত্যু নেই। সত্যের জয় হয়েছে অবশেষে।
বান্দরবান সদরের সারদা চরণ চক্রবর্তীর ছেলে সলিল কান্তি চক্রবর্তী আট ভাই-বোনের মধ্যে পঞ্চম। ১৯৭৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে ১৯৭৮-৭৯ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তির আবেদন করেন। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রয়োজনীয় সব শর্ত পূরণ করেন। ভর্তি হতে যাবেন, ঠিক এ সময় কলেজের ভর্তি বাছাই কমিটি সলিল কান্তির বিরুদ্ধে মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকের নম্বরপত্রসহ শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কাগজপত্র জালিয়াতির অভিযোগ তোলে। ভর্তি প্রক্রিয়া থেকে তাকে বাদ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ভর্তি প্রক্রিয়ায় জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার সুপারিশও করে তারা।
অভিযোগ অস্বীকার করে সলিল কান্তি ভর্তির চেষ্টা চালিয়ে যান। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে বিশেষ বিবেচনায় ভর্তি নিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের দপ্তরে আবেদন করেন। তাঁর এমন এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সলিল কান্তি চক্রবর্তীকে চিঠি দিয়ে জানায়, তাঁর বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ দুর্নীতি দমন ব্যুরোতে তদন্তাধীন। সংস্থাটি সিদ্ধান্ত জানালে তবেই তাঁর ভর্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
১৯৯৪ সালের ২ আগস্ট সে সময়ের দুর্নীতি দমন ব্যুরোর সুপারিশে জালিয়াতির অভিযোগে সালিল কান্তির বিরুদ্ধে বান্দরবান থানায় মামলা করে পুলিশ। মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতে এসএসসি ও এইচএসসির নম্বরপত্রসহ অন্যান্য শিক্ষাসংশ্লিষ্ট জাল কাগজপত্র তৈরির অভিযোগ আনা হয় মামলায়। চার বছর ধরে চলে মামলার তদন্ত। এই চার বছরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয় পাঁচবার। ১৯৯৮ সালে মামলার অভিযোগপত্র দেয় অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ওই বছর ১ সেপ্টেম্বর সলিল কান্তি চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বান্দরবানের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত। ২০০০ সালের ২১ আগস্ট এ মামলার রায় হয়। বান্দরবানের অতিরিক্ত জেলা হাকিম শাহ মোকসেদ আলী জালিয়াতির অভিযোগ থেকে সলিল কান্তি চক্রবর্তীকে বেকসুর খালাস দেন। তত দিনে সলিল কান্তির বয়স চল্লিশ।
এ রায়ের পর ২০০১ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সলিল কান্তি চক্রবর্তীর ভর্তির সুপারিশ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুই পরিচালক স্বাস্থ্যসচিবকে তিনবার চিঠি দেন। এতে কাজ না হওয়ায় ২০০৩ সালের ২৪ জুন সলিল কান্তি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির জন্য স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর কাছে লিখিত আবেদন করেন। একের পর এক এমন আবেদনের ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ১৭ মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে সলিল কান্তির ভর্তির বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে চিঠি দেন। এতেও কাজ না হওয়ায় ওই বছর ২৮ অক্টোবর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দপ্তরে আবেদন করেন। এতে ফল না পেয়ে ২০০৫ সালের ১৫ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষকে আইনি নোটিশ পাঠান সলিল কান্তি। নোটিশে ১৫ দিনের মধ্যে তাঁর ভর্তির পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করা হয়। সাড়া না পেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন তিনি।
#হাইকোর্টের_রায় ও #পর্যবেক্ষণ : রিটের প্রাথমিক শুনানির পর উচ্চ আদালত ২০০৫ সালের ২৫ জুন সলিল কান্তি চক্রবর্তীর ভর্তি নিয়ে রুল জারি করেন। আর অন্তর্বর্তী আদেশে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের চলতি শিক্ষাবর্ষে (২০০৫-০৬) তাঁকে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি করতে বিবাদীদের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং তাঁর ভর্তির ক্ষেত্রে বিবাদীদের ইচ্ছাকৃত বিলম্বের জন্য তাঁকে কেন আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে। চূড়ান্ত শুনানির পর ২০০৭ সালের ১ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে রুল যথাযথ ঘোষণা করার পাশাপাশি ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষে তাঁকে ভর্তি করাতে নির্দেশ দেওয়া হয়। হাইকোর্টের রায়ের সময় সলিল কান্তির বয়স ৪৪ বছর।
সলিল কান্তি চক্রবর্তীর এ ঘটনাকে ‘মর্মান্তিক’ উল্লেখ করে হাইকোর্ট রায়ে বলেছেন, ১৯৭৯ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে সলিল কান্তি চক্রবর্তী ভর্তির আবেদনের ১৫ বছর পর ১৯৯৪ সালের ২ আগস্ট তাঁর বিরুদ্ধে জালিয়াতির মামলা করা হয়। মামলার বিষয়ে দুর্নীতি দমন ব্যুরোর কথিত সিদ্ধান্ত জানতে ১৫ বছর অপেক্ষা করাতে তাঁকে বাধ্য করা হয়েছিল। এরপর আদালতের সিদ্ধান্ত জানতে লেগে যায় আরো ছয় বছর।
উচ্চ আদালতের রায়ে আরো বলা হয়েছে, বিবাদীরা সময়োপযোগী পদক্ষেপ না নেওয়ায় চিকিৎসক হতে চাওয়া সলিল চক্রবর্তী বিপর্যস্ত হয়েছেন। তাঁর জীবন থেকে ২৩টি সোনালি বছর হারিয়ে গেছে। বিচারিক আদালতের খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে বিবাদীরা আপিল করেনি। অন্যদিকে সলিল কান্তির বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপও নেয়নি। এ ধরনের নিষ্ক্রিয়তায় এটাই প্রতীয়মান হয় যে বিবাদীদের নিছক অবহেলা ও স্বেচ্ছাচারিতা সলিল কান্তি চক্রবর্তীর সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করেছে।
ওই বছরই হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ওই আবেদনের শুনানির পর হাইকোর্টের রায়টি স্থগিত করা হয়। এরপর লিভ টু আপিল করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত বুধবার সে আপিলই খারিজ করে রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত। রায়ে মামলার খরচ হিসাবে সলিল কান্তি চক্রবর্তীকে দুই কোটি টাকা দিতে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আপনার মতামত দিন: