Ameen Qudir

Published:
2017-02-24 16:11:08 BdST

আমি মানুষ নই , আমি ডাক্তার !


 

 

 




রাহাত আহমেদ , ইন্টার্ন চিকিৎসক , রামেক
____________________________

বছর দুয়েক আগে ইংল্যান্ডে একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় । এই দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেই সময় ডেভিড ক্যামেরুন সরকার তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে !!! কেন সেই ইন্টার্ন চিকিৎসক কার ড্রাইভিং করে বাসায় ফেরার পথে এক্সিডেন্ট করলো !

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে, ইংল্যান্ডে একজন ইন্টার্ন চিকিৎসকের কর্মঘন্টা সপ্তাহে ৩৬ ঘন্টা ও প্রতি রবিবার ছুটি !


তারমানে, একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক প্রতি সপ্তাহে একদিন ছুটিসহ দিনে ৬ ঘন্টা ডিউটি করে !

তবে, সেই সপ্তাহে অর্থাৎ যেই সপ্তাহে তার এক্সিডেন্ট হয়, সেই ইন্টার্ন চিকিৎসক ওভারটাইমসহ টোটাল ৭২ ঘন্টা ডিউটি করে !!! অর্থাৎ সপ্তাহে একদিন ছুটি সহ প্রতিদিন ১২ ঘন্টা করে !!!
এরপর সরকারের তরফ থেকে, ইন্টার্ন চিকিৎসকদেরকে ওভারটাইম করতে নিরুৎসাহিত করা হয় !

মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশে একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক গড়ে প্রতিদিন ডিউটি করে ১৬-১৮ ঘন্টা করে !!! আর ছুটি, সেই তো অধরা !!! আমাদের প্রতি সপ্তাহে কোন ছুটি নেই !!! অর্থাৎ বাংলাদেশে প্রতিটি ইন্টার্ন চিকিৎসককে সপ্তাহে সাত দিনই ডিউটি করতে হয় গড়ে ১৬ ঘন্টা করে !!! অর্থাৎ প্রতি সপ্তাহে ১১২ ঘন্টা করে ( কোন রকম সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়াই !!! ) ।

আসুন এইবার একটু ইন্টার্ন চিকিৎসকদের বেতনের দিকে নজর দেয়া যাক।

ইংল্যান্ডে একজন ইন্টার্ন চিকিৎসকের বার্ষিক বেতন গড়ে ৩৫,০০০হাজার পাউন্ড অর্থাৎ বাংলায় ৩৫ লক্ষ্য টাকা। সেই হিসেবে তারা প্রতিমাসে পায় (বংলায়) প্রায় ৩ লক্ষ্য টাকা !!! আমেরিকাতে বার্ষিক বেতন গড়ে $৩৮,০০০- $৪৩, ০০০ টাকা অর্থাৎ বাংলায় প্রায় ঐ ৩৫ লক্ষ্যের মতই হবে !!! অর্থাৎ প্রতিমাসে প্রায় ৩ লক্ষ্য টাকা !!!
আবার ওভারটাইম করলে ঘন্টা প্রতি ১২-১৫ ডলার/পাউন্ড বেতন দেয় !!! তারা মানে, (বাংলায়) প্রতি ঘন্টায় ১২০০-১৫০০ টাকা !!!
আর বাংলাদেশে একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক বেতন পায় প্রতিমাসে ১৫০০০ টাকা !!! সেই হিসেবে বার্ষিক বেতন হলো ১,৮০,০০০ টাকা !!!

এখন যদি ঘন্টা প্রতি হিসেব ধরি, তাহলে প্রতি ঘন্টায় একজন বাংলাদেশী ইন্টার্ন চিকিৎসক বেতন পায় ৩১ টাকা করে !!!
আর ইংল্যান্ড আমেরিকায়........

তথাপি, ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান দেশের একজন ইন্টার্ন চিকিৎসককে প্রতিদিন ৬-৮ জন শিক্ষিত ও উচ্চ শিক্ষিত মানুষের চিকিৎসা করতে হয় !!! আর বাংলাদেশে একজন ইন্টার্ন চিকিৎসককে গড়ে প্রতিদিন ১৫০ জন অশিক্ষিত /অর্ধশিক্ষিত/কোন পাতি নেতার ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার চিকিৎসা করতে হয় !!!

এখন আপনার প্রশ্ন হতে পারে, বাংলাদেশ আর ইংল্যান্ড /আমেরিকা কি এক !!


ও বাবা, আপনি আমার কাছে ইংল্যান্ড /আমেরিকার মত সেবা আশা করবেন আর আমাকে সেদেশের ডাক্তারদের মত যথাযথ সন্মানী ও বিশ্রাম দিবেন না তা কি হয় ! সাথে সাথে আপনার ব্যবহারও ইংল্যান্ড /আমেরিকার অধিবাসীদের মতই হতে হবে , তাই নয় কি ?

এখন বর্তমান প্রেক্ষাপটে আসি, সম্প্রতি একটার পর একটা অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেই চলেছে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সাথে !!!
দিনে ২৪ ঘন্টায় ১৬ ঘন্টা ডিউটিরত একজন ইন্টার্ন চিকিৎসকের কাছে আপনি কেমন ব্যবহার আশা করেন !
তার উপর, সরকারী হাসপাতালে আসা অধিকাংশ রোগীর আত্মীয়স্বজনই অশিক্ষিত অথবা অর্ধশিক্ষিত !!! তাদেরকে একটা জিনিস ১০ বার করে বোঝানোর পরও একই ভুলটাই করে !!! তাহলে ১৬ ঘন্টা ডিউটিরত একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক তার মেজাজটা কতক্ষণ ধরে রাখতে পারে !

 

আপনি ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা দিবস পালন করেন, আর আমি রোগী দিবস পালন করি !
যেখানে আপনি শুক্রবারে ছুটি কাটান আর আমি তখনো রোগীর ১ মাসের পচা পা ড্রেসিং করি !!!
যেখানে আপনি ৮ ঘন্টা ডিউটি করে রাতে পরিবারের সাথে প্রশান্তির ঘুম দেন আর তখন আমি গরুকে বাঁচাতে গিয়ে আগুনে পুরো শরীর দগ্ধ এক নারীর গা ড্রেসিং করে মলম লাগিয়ে দেই !!!
এরপরও কি আপনি রাতভর পুড়া রোগীর ড্রেসিং করা একজন ইন্টার্ন চিকিৎসকের কাছে ঐ দিন ভোরেই ভালো ব্যবহার আশা করবেন !

 

আপনি ইন্টার্ন চিকিৎসকের কাছে মুখে মধু ঝরা ভালো ব্যবহার চান ??? তাহলে আমাকে উপযুক্ত বিশ্রামসহ, উপযুক্ত কর্মঘন্টার সাথে সাথে উপযুক্ত সন্মানীও দিতে হবে !!! তাহলে সপ্তাহে একদিন ছুটিসহ দিনে ৬ ঘন্টা ডিউটি করলে আমাদের মুখেও মধুর বন্যা বয়ে যাবে _____________

ভাই আপনার জীবন আছে তাই আপনি জীব, আর আমাদের জীবন আছে তাই আমরা ডাক্তার !!!

কোন ইন্টার্ন চিকিৎসক যদি আপনার অনভিপ্রেত কৃতকর্মের জন্য আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করেও ফেলে, আপনার উচিৎ হবে তা সহ্য করে দুঃখ প্রকাশ করা । কারন হয়তো সেই চিকিৎসকটিই সারারাত জেগে কোন না কোন রোগীর চিকিৎসা করেছে !!! জানি বাংলাদেশে এমন শালীন ব্যবহার আশা করা দিবাস্বপ্নেরই নামান্তর !

 


তবুও বলছি, আপনারা যদি কন্টিনিউয়াসলি ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সাথে এমন দুর্ব্যবহার করতেই থাকেন তাহলে আমরা কিন্তু আর বাংলাদেশে থাকবোনা , বাইরের দেশে চলে যাবো ।


বাইরে বাংলাদেশী ডাক্তারদের অনেক চাহিদা, উন্নত পরিবেশ , উন্নত সন্মানী, উন্নত কর্মঘন্টা !!! এমন অনেক উদাহরণ দেয়া যায় যেমন,,,,
বাংলাদেশী চিকিৎসক ডা. শফি আহমেদের অস্ত্রোপচার লাইভ দেখেছেন বিশ্বের ১৩০টি দেশের চিকিৎসকগন। লন্ডনের রয়েল হাসপাতালে একজন রোগীর শরীরে তিনি এ অস্ত্রোপচার করে ইংল্যান্ডের বর্ষসেরা ডাক্তার নির্বাচিত হয়েছেন !!! আমেরিকার দুইটি অঙ্গরাজ্যের সেরা ডাক্তার হলো দুইজন বাংলাদেশী !!!! সৌদিআরব, ইরান, ওমান, কুয়েত সহ মিডল ইষ্টের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশী ডাক্তারগন অত্যন্ত সুনামের সাথে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেমন, সুইডেন, আয়ারল্যান্ডেও বাংলাদেশী ডাক্তার কম নয়!!!

কিছুদিন আগেই বাংলাদেশের দুই চিকিৎসা বিজ্ঞানীর আবিষ্কার সারা বিশ্বে লিভারসংক্রান্ত রোগের চিকিৎসায় এক নতুন যুগের সৃষ্টি করেছে। স্বীকৃতি মিলেছে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনসহ (এফডিএ) একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে।
ইতিমধ্যে কিউবা এ ফর্মুলা ব্যবহার করে ওষুধ তৈরি করে তা ‘হেপাটাইটিস বি’ চিকিৎসায় ব্যবহারও করছে।


যাদের হাত ধরে এ বিস্ময়কর অর্জন তারা হলেন- জাপান প্রবাসী বাংলাদেশী লিভার বিশেষজ্ঞ ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) হেপাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)। ডাঃ শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর স্যারের অধিনে শত শত জাপানী চিকিৎসকগন রিসার্চ করছেন !!!
এইগুলো, বাংলাদেশী ডাক্তারদের সাফল্যের এক নগণ্য উদাহরণ মাত্র !!!

শোন বাঙ্গালী, তোমরা যদি আমাদের প্রাপ্য সন্মান আমাদেরকে না দিতে পারো , তাহলে আমরাও আমাদের উপযুক্ত স্থান খুঁজে নিব । যেখানে আমাদের মেধার, কর্মের মূল্যায়ন হয়, হবে ও হচ্ছে সেখানেই আমরা যেতে বাধ্য হবো !!! এত সুলভ মূল্যে হাতের নাগালে এত ভালো চিকিৎসা আর কোথাও পাবেনা তোমরা !!! আমরা আছি এখনো, কারন আমাদের দেশপ্রেম এখনো প্রবল । দয়া করে, প্রবাল অশুভ আন্দোলনের আঘাতে আমাদের দেশপ্রেমের শক্ত খুটিকে নড়বড়ে করে দিওনা !

 

১০০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে হাসপাতালে ২৫০০ হাজার রোগীকে সারা বিশ্বে একমাত্র আমরাই প্রতিনিয়ত চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছি !!! অথচ কোন অর্গানোগ্রাম নাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে !!! ১৫০ জন রোগীর চিকিৎসার ভার নিতে মাত্র হয় একজন ডাক্তারকে !!! উপজেলাগুলোতে ডাক্তারের বসার জন্য টেবিল আছে, চেয়ার নাই, মাথার উপরের ছাদ যেকোন সময় ভেঙে পড়তে পারে !

 

এমন নজীর বিশ্বে আর কোথাও পাবেনা তোমরা !!! তার উপর অধিকাংশ রোগীই অশিক্ষিত /অর্ধশিক্ষিত !!! এক কথা হাজার বার বলা লাগে তাদেরকে বোঝানোর জন্য !!! আর কিছু শিক্ষিত রোগী আসলেও তারা পরিচয় দেয় উমুক পাতি নেতার তিন নম্বর ছাগলের বাচ্চা আমি , আমার চিকিৎসা ভালো করে করতে হবে !!!!

শত প্রতিকূলতার পরেও মাঝে মাঝে নিজের গায়ে নিজেই চিমটি কেটে পরিক্ষা করে দেখি, আমি কি এখনো মানুষ আছি নাকি ডাক্তার !

বিঃদ্রঃ শজিমেক ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে এই লেখা ।

_____________________________
রাহাত আহমেদ

Intern Doctor at Rajshahi Medical College Hospital, Rajshahi, Bangladesh

আপনার মতামত দিন:


ক্যাম্পাস এর জনপ্রিয়