Ameen Qudir

Published:
2020-04-09 20:45:06 BdST

একজন বীরের জন্য শোকগাঁথা


 

ডেস্ক

____________________

একজন বীরের জন্য শোকগাঁথা ও স্মৃতিকথা লিখেছেন চট্টগ্রাম  মেডিক্যাল কলেজের ২৮ ব্যাচের দুই মেধাবী প্রাক্তন ডা. বি এম আতিকুজ্জামান‎ ও ডা. তিতাস মাহমুদ ।

ডা. বি এম আতিকুজ্জামান‎
_____________________________
এই কিছুক্ষন আগে আমার খুব কাছের বন্ধু ডাঃ আব্দুল মাবুদ চৌধুরী আমাদের ছেড়ে চলে গেলো। ডাঃ আব্দুল মাবুদ চৌধুরী সবার কাছে পরিচিত ছিল
ফয়সাল নামে। প্রায় দু সপ্তাহ করোনা ভাইরাসে ভুগে লন্ডনের একটি হাসপাতালে ফয়সাল শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করলো;

আমার খুব কাছের বন্ধুদের মাঝে এই প্রথম একটি বন্ধু হুট্ করে আমাদের ছেড়ে চলে গেলো। ব্যাপারটা খানিকটা কল্পনার ও বাইরে। ফয়সাল তো এতো সহজে চলে যাবার মতো নয়।

১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে আমরা এক সাথে ভর্তি হলাম। সিলেট ক্যাডেট কলেজের একজন চৌকষ সুদর্শন মেধাবী ছাত্র ফয়সাল খুব সহজেই আমাদের প্রিয় একজন বন্ধু হয়ে গেলো। বন্ধু থেকে আমাদের নেতা , সারা কলেজের নেতা। সৎ, অকুতোভয়, প্রচন্ড সাহসী এবং পরিশ্রমী ফয়সাল খুব সহজেই আমাদের মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র সংসদের সমাজসেবা সম্পাদক হয়ে গেলো। ১৯৯১ সালের ৩০শে এপ্রিলে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের প্রানহানি ঘটে। কয়েক গুন মানুষ হয় গৃহহারা। তীব্র খাদ্য এবং পানীয় জলের সংকট। সময়টা আমাদের পেশাগত পরীক্ষার ঠিক আগে। পরীক্ষার পড়াশুনা বাদ দিয়ে অসহায় মানুষদের জন্য সাহায্যের পাশাপাশি “খাবার স্যালাইন “ তৈরী করে ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকাতে তা পৌঁছে দেবার একটি যুগান্তরকারী কাজ শুরু করলো সে। দিন রাত ২৪ ঘন্টা স্বেচ্ছাশ্রম দিলো মেডিক্যাল কলেজের সব ছাত্র ছাত্রীরা। হাজার হাজার প্যাকেট খাবার স্যালাইন তৈরী হতো সেখানে। ওর প্রায়াসে বেঁচে গেলো হাজারো প্রাণ।

ভালো ভালো সব পরিকল্পনা থাকতে তার।মেডিক্যাল কলেজে সমাজসেবা সম্পাদক থাকাকালে একটি ‘মেধাবী ছাত্র অনুদান ফান্ড ‘ গঠন করেছিল সে নানা জনের কাছ থেকে অনুদান নিয়ে। একজন দরিদ্র মেধাবী ছাত্রকে তা প্রদান করা হতো।

চমৎকার আবৃত্তিকার, অভিনেতা এবং নাট্য নির্দেশক ছিল ফয়সাল। মেডিক্যাল কলেজে থাকাকালীন সময়ে যে কোনো সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাঝে তার ছিলো সৃজনশীল উপস্থিতি।

মেডিক্যাল কলেজ শেষ করে আফ্রিকার জাম্বিয়াতে একসাথে কাটিয়েছিলাম কিছুদিন আমরা। সবার প্রিয়পাত্র ফয়সাল ছিল ‘হরফুন মৌলা’ বা সকল কাজের কাজী। ফয়সালের একটি অনন্য সাধারণ গুন ছিলো তার সততা , দৃঢ়তা এবং আন্তরিকতা। আর সে জন্য যে ই তার সংস্পর্শে এসেছে সেইই হয়ে গিয়েছে তার ভক্ত। প্রচন্ড আতিথেয়তা পরায়ন এবং পরোপকারী ছিল ফয়সাল। পরিচিত যে কেউ লন্ডনে আসলেই ফয়সালের অতিথি তাকে হতেই হতো।

প্রচন্ড দেশপ্রেমিক ফয়সালের বরাবরই ইচ্ছে ছিলো দেশের জন্য কাজ করা। ইংল্যান্ডে ইউরোলোজির অস্ত্রপ্রচারের বিশেষজ্ঞ হবার পরেই প্রতি বছর কমপক্ষে দুবার বাংলাদেশে সে যেতো গরিব রোগিদের বিনামূল্যে অস্ত্রপ্রচার করানোর জন্য এবং নতুন প্রজন্মের ইউরোলজিস্ট তৈরী করবার জন্য। ফয়সাল বাংলাদেশ ইউরোলোজিক্যাল সোস্যাইটির একজন প্রধান উপদেশক ছিলো।

বাংলাদেশ না থেকেও বাংলাদেশী রোগীদের নিয়মিত টেলিফোন বা ইন্টারনেটে বিনামূল্যে জটিল রোগের জরুরী কনসালটেন্সি করতো ফয়সাল। সেখান থেকেই তার স্বপ্ন তৈরী হয়েছিল বাংলাদেশের বাইরে থাকা ডাক্তারদের নিয়ে একটি টেলিমেডিসিনের নেটওয়ার্ক তৈরী করা। এটি নিয়ে ফয়সাল অনেকদূর কাজ করেছিল এবং এবছরের শীতের ছুটিতে আমাদের একসাথে বাংলাদেশে যাবার কথাও ছিল তা বাস্তবায়নের জন্য।

যে কোনো সামাজিক সাংস্কৃতিক কাজের নেতৃত্ব দেবার একটি আজন্ম গুন ছিল ফয়সালের। আর সে জন্য সে সব শ্রেণীর মানুষের কাছে সে ছিলো প্রিয়।

এতো ব্যস্ততার মাঝেও প্রেমে পড়বার সুযোগ হয়েছিল ফয়সালের। ফয়সালের যোগ্য প্রেমিকা এবং সহধর্মিনী রানী সব সময়ই ফয়সালের পাশে ছিলো এবং তার মানবিক কাজগুলোতে সাহায্য করেছে। পেশাতে রানী একজন মনোচিকিৎসক এবং ফয়সালের মানবিক গুণাবলীকে সে বরাবরই সামনে এগুতে সাহায্য করেছে। ফয়সাল ছিল একজন অসাধারণ বাবা এবং স্বামী। একমাত্র ছেলে ইন্তিসার আর একমাত্র মেয়ে ওয়ারিশা বরাবরই ফয়সালের চোখের মনি। আমি জানি না কিভাবে আমরা তাদের পিতৃশোক ভাগ করে নেবো।

বন্ধুবৎসল ফয়সাল কোনোদিন মুছে যাবে না তার বন্ধু, স্বজনদের মন থেকে।তার অকাল প্রয়াণ আমাদের সবার মনে রেখে দিয়ে গেলো গভীর ক্ষত। এ মুছবার নয়। বন্ধুদের ডাকে ফয়সাল গিয়েছে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত।টরন্টো থেকে স্মোকি মাউন্টেন , সিডনি থেকে স্কটল্যান্ডের হাইলান্ডে বন্ধুদের টানে ফয়সাল চলে যেতো অকৃপণভাবে।

ঈর্ষণীয় প্রাণশক্তির অধিকারী ফয়সাল সত্য কথা বলতে কোনোদিন পিছপা হয়নি। নিস্বার্থভাবে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে নিজেই যখন করোনা ভাইরাস এ আক্রান্ত হয়ে বাসাতে কোয়ারেন্টিনে ছিলো তখন নিঃসংকোচে সাহসীভাবে লিখেছিলো : “ যারা আমাদের বলেছিল এই রোগটি তেমন ভয়ংকর নয়, সমস্ত দোষ তাদের। তারা বলেছিল এটি সাধারণ এক ধরনের ফ্লু । কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আর এখন অনেক বেশি দেরি হয়ে গিয়েছে।”

এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে সরাসরি লিখেছিলো সে : “Dear and Respectable Prime Minister Mr Boris Johnson,
Please ensure urgently Personal Protective Equipment (PPE) for each and every NHS health worker in UK. Remember we may be doctor/ nurse/ HCA/ allied health workers who are in direct contact with patients but we are also human being to practice human right like others to live in this world disease free with our family and children. People appreciate us and salute us for our rewarding job which are very inspirational but I would like say, we have to protect ourselves and our families/ kids in this global disaster/Crisis by using appropriate PPE and remedies. I hope we are by default entitled to get this minimal support for our safe medical practice. Otherwise in future our children will loose interest to go Medical school . We also should get first track facilities for corona virus testing to help our patient to prevent disease spreading.”

নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে মুক্তপ্রাণ সত্যভাষী ফয়সাল চিকিৎসকদের একজন হয়ে সত্য কথা বলতে পিছু হটেনি।

সদা হাস্যোজ্জ্বল ফয়সাল নেই ভাবতে চোখ ভোরে যাচ্ছে জলে, গলা ভার হয়ে আসছে।

ওর অকাল প্রয়ানে ওর পরিবারের, আমাদের, বাংলাদেশের আর মানবতার বড়ো ক্ষতি হয়ে গেলো। ফয়সালকে পরম করুনাময় স্বর্গের সবচে উপরের আসনে রাখুন এ প্রার্থনা করি।

---------------------

ডা. তিতাস মাহমুদ
সিএমসি ২৮
___________________

প্রাক কথন:
নিচের লেখাটি পুরোনো। ডিসেম্বর ২, ২০১৯ এ লেখা। লেখাটি আমাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ২৮তম ব্যাচের সীমাবদ্ধ গ্রুপের, ফেসবুক পাতায় পোস্ট করেছিলাম। আমরা প্রায় একবছর সময় হাতে রেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ২০২০ ডিসেম্বরে আমাদের ব্যাচের একটি মেগা রিউনিয়ন করবো কক্সবাজারে। ইংল্যান্ডের বন্ধু, ফয়সালের মস্তিষ্ক শিশু এটা। ওর সাথে রাতে দীর্ঘক্ষণ আলাপ হতো। ফয়সালের কেবল একটাই কথা, ‘ দ্যাখ তিতাস, আমাদের সবার বয়স বাড়ছে। আবার কখন কার সাথে দেখা হয়, আদৌ আর হবে কী না! রিউনিয়নটা করতেই হবে।‘

মেডিকেল ক্যাম্পাস ছাড়ার পর সারাবিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছি আমরা। শুরুর দিকে অনেকেই নিরুৎসাহিত করে বলতো, ‘ ধুর! খামোখাই এসব! ৫০ জনও হবে না।’ ফয়সাল ফোন করতো। একটু দুশ্চিন্তা হতো ওর। আমার খারাপ হতো মেজাজ। তখনই বলা যায়, অনেকটা রাগের মাথায় নিচের লেখাটা লিখেছিলাম। লেখাটির নিচে ফয়সাল একটি উত্তর দিয়েছিল, সেটার স্ক্রীনশটও মন্তব্য কলামে দিয়েছি। আ হা! সেই আমার বন্ধু, ফয়সাল! ফেসবুকে আমার লেখার নিচে আর কোনোদিন মন্তব্য লিখবে না। রাত বিরাতে হন্তদন্ত হয়ে ম্যাঞ্জারে ফোন করে বলবে না, ‘ তিতাস, বেডরুম ছেড়ে একটু বাইরে আয়; শায়লার ঘুম যেন না ভাঙ্গে। মাথায় একটা প্ল্যান আসছে।’

পুনশ্চ:
ডা. আব্দুল মাবুদ চৌধুরী ফয়সাল স্থানীয় সময় রাত ১০:৩৫ মিনিটে লন্ডনের কুইন্স হাসপাতালের আইসিইউতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। হাসপাতালে যাওয়ার আগ মুহূর্তেও সে আমাকে বলেছিলো, ‘ না টেস্ট করিনি। আমার তো কোন শ্বাসকষ্ট, কফ বা কাশি নেই। শুধু ভীষণ জ্বর আর ডায়রিয়া।’ যাই হোক, তবু ধারণা করা হচ্ছে, সে কোভিড ১৯ রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। কারণ এই কুৎসিৎ করোনা ছাড়া তার অকাল মৃত্যুর আর কোন কারণই থাকতে পারে না।

 
আমাদের ব্যাচে সব’চে একরোখা যদি কেউ থাকে, সে হচ্ছে Abdul Mabud Chowdhury ফয়সাল। যেকোন অন্যায়ের মুখের উপর সে সরাসরি কথা বলতে পারে। কারণ সে পুরোপুরি সৎ এবং নিষ্ঠাবান। কোন রকম অনিয়ম, অনাচার কিংবা অসত্যকে সে প্রশ্রয় দেয় না বলেই, ও একটু ঘাড়ত্যাড়া। ওর এই ত্যাড়ামির মূল শক্তি হচ্ছে, সে প্রচন্ডভাবে আত্মবিশ্বাসী। সে ভালো করে জানে, সব অলসতা দূরে ঠেলে মাঠে নেমে, নিজ হাতে কাজ করলে একদিন ওর পাশে শুভাকাংখীরা জড়ো হবেই। কঠোর পরিশ্রমী আর কাজে এক’শ ভাগ স্বচ্ছতা আছে বলেই, ফয়সাল কোন কাজে হাত দিলে, তা থেকে পিছ’পা হয় না।

সে বছর একানব্বইয়ে চট্টগ্রামে ভয়াবহ ঘুর্ণিঝড়ে পুরো শহর হঠাৎ নির্বাক এবং হতভম্ব হয়ে পড়ে। প্রলয়াঙ্কারী ঝড় থেমে গেলে চারদিকে অগনিত লাশ, অসহায় মানুষ। গোটা নগরী ভূত প্রেতের মতো স্তব্দ এবং বিধ্বস্ত। সেই কিংকর্তব্যবিমুঢ় অন্ধকার আর ধ্বংসস্তুপ ঠেলে চট্টগ্রাম মেডিকেলের ছাত্র সংসদ ভবনে যে যুবকটি সর্বপ্রথম আলো জ্বেলেছিল, সে ছিল ফয়সাল। সেদিনও ওর আশে পাশে খুব কমসংখ্যক মানুষ ছিল। সে জানে, এটাই মানুষের নিয়ম। প্রথম প্রথম সাইড লাইন থেকে দুর্মুখেরা ফিস্ ফিস্ করবে। রাতদিন ওর পাগল পাগল কান্ড দেখে মুচকী হাসবে। ওরা উৎসাহ তো দেবেই না, নিয়ত নিরাশাবাদী মানুষেরা শুধু বলবে হতাশার কথা। যেমন এখন আমরা বলছি, ‘ধুর! অসম্ভব! খামোখাই এইসব। রিউনিয়নে ৫০ জনেরও বেশি হবে না।’

একেবারে শূন্য থেকে খাবার স্যালাইনের প্রজেক্টকে ফয়সাল, আমার এখনো মনে আছে, ধীরে ধীরে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলো। তৎকালীন দেশের বহু বড় বড় নেতা কর্মী এসে ওর প্রজেক্টকে বাহবা দিয়ে গেছে। এই হচ্ছে ফয়সাল। আর কেউ কাজ না করলেও সে একাই একটা পুরো শহরকে কাঁপিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। তাই আমাদের এই ৫০ কী ৬০ এসব সংখ্যা, ওকে মোটেই বিচলিত করে না। ও শুধু জানে, ২০২০ ডিসেম্বর, আমাদের চমেক ২৮ তম ব্যাচের রিউনিয়ন, একটি অবশ্যম্ভাবী ঘটনা।

সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ ভাবে রাতদিন বিভোর হয়ে সে কাজ করে যাচ্ছে। বন্ধুদের দু’দিন পর পর নিরলস ফোন করছে, হন্যে হয়ে স্পনসর খুঁজছে। আমি নিশ্চিত প্রাথমিক কাজ গুলো গুছিয়ে নিয়ে সে সবাইকে দায়িত্ব বিলি বন্টন করে দেবে। প্রথমে ভিত্তি, তার’পর ছাদ, একটি বাড়ির তৈরীর সবচেয়ে কষ্টের কাজ এ দুটো। আমার মনে হয় না, ফয়সাল ছাড়া আমাদের ব্যাচে অন্য আর কেউ আছে, এই দুরহ কাজ দু’টো মাথায় নিতে পারতো। ফয়সাল প্রাথমিক সব গোছগাছ করে দিলে, এরপর আমরা সবাই প্রবল খুশিতে ‘রিউনিয়ন’ বাড়ির দরজা, জানালায় পর্দা লাগাবো, বাহারি সিলিঙ ফ্যান ঝুলাবো, ছাদ বাগানের গাছে পানি দিবো, প্রিয় গাড়ির রঙ পছন্দ করবো .....

@ নোঙ্গর  Returns

আপনার মতামত দিন:


ক্যাম্পাস এর জনপ্রিয়